এখন কী বলবেন সুনীল গাভাস্কার?
উৎপল শুভ্র
২৬ আগস্ট ২০২১
সুযোগ থাকলে হেডিংলি টেস্টের প্রথম দিন শেষে সুনীল গাভাস্কারকে অবশ্যই লর্ডসে আগের টেস্ট শেষে তাঁর মন্তব্যগুলো মনে করিয়ে দিতাম। ইংল্যান্ডকে চরম তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা ওই মন্তব্য কি এখন তাঁকে গিলে খেতে হচ্ছে না! এমনিতে যেকোনো কিছু বলার সময় চরম পরিমিতিবোধের পরিচয় দেওয়া সুনীল গাভাস্কার কি তাহলে অমন বলেছিলেন ভারতীয় দর্শককে খুশি করতে!
হেডিংলি টেস্টের প্রথম দিনটা কীভাবে শেষ হয়েছে জানেন নিশ্চয়ই। সংখ্যায় দিনটার চিত্র আঁকলে তা এমন: ভারত ৭৮, ইংল্যান্ড ১২০/০।
এমন হতেই পারে। যদিও টেস্ট ক্রিকেটে খুব বেশি হয়নি। টেস্টের প্রথম দিনে পরে ব্যাটিং করা দল কোনো উইকেট না হারিয়ে লিড নিয়ে নিয়েছে, এর আগে এই ঘটনা ঘটেছে মাত্রই দুবার। সর্বশেষ সেই ২০১০ সালে, মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার ৯৮ রানের প্রথম ইনিংসের জবাবে ইংল্যান্ড দিন শেষ করেছিল বিনা উইকেটে ১৫৭ রানে। প্রথম ঘটনাটা ২০০১ সালে হ্যামিল্টনে। পাকিস্তানের ১০১ রানের জবাবে প্রথম দিন শেষে নিউজিল্যান্ডের স্কোর ছিল ১৬০/০।
হেডিংলি টেস্টের প্রথম দিনের ঘটনাপ্রবাহের আরেকটি ব্যতিক্রমী দিক আছে। এক দলের সবাই মিলে করা রান আরেক দলের ওপেনিং জুটিরই টপকে যাওয়া। এর আগে ভারতের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তিনবার। এই রেকর্ডটাতেই একটু সময় দিতে চাই। খুব কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম, দিনশেষের পর্যালোচনায় সুনীল গাভাস্কার এ নিয়ে কী বলেন। সেই অপেক্ষায় কোনো ফল হলো না। গাভাস্কারের কথা শুনতে এমনিতেই ভালো লাগে। তবে হেডিংলির প্রথম দিন শেষে তাঁর কথা শুনতে এত আগ্রহের বিশেষ একটা কারণ তো থাকতেই হবে। সেই কারণ লর্ডসে আগের টেস্ট ম্যাচটির শেষে তাঁর মন্তব্য। সুযোগ থাকলে আমি অবশ্যই তাঁকে যা মনে করিয়ে দিতাম। এরপর উৎকর্ণ হয়ে থাকতাম তাঁর উত্তর শুনতে।
তা লর্ডস টেস্ট শেষে কী বলেছিলেন সুনীল গাভাস্কার? যদি সেদিন আপনি সনি সিক্সে ম্যাচ শেষে ‘এক্সস্ট্রা ইনিংস’-এর আলোচনাটা শুনে থাকেন, তাহলে আপনার তা ভোলার কথা নয়। না দেখে/শুনে থাকলে বলে দিচ্ছি। এর আগে প্রেক্ষাপটটা। ভারত ওই টেস্টে যেভাবে জিতেছে, চার ফাস্ট বোলার মিলে যেভাবে ৫১.৫ ওভারেই ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংস শেষ করে দিয়েছে, তা দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। ইংল্যান্ডকে অলআউট করে দেওয়ার জন্য বিরাট কোহলির ৬০ ওভারই যথেষ্ট বলে মনে করার আত্মবিশ্বাসও নাড়া না দিয়ে পারেই না। এজন্য আপনাকে ভারতীয় বা ভারত ক্রিকেট দলের সমর্থক হওয়ার প্রয়োজন নেই। লর্ডস টেস্টে ভারতের পারফরম্যান্স যাকে বলে এ প্লাস।
ভারতের এমন জয়ে সুনীল গাভাস্কারের আন্দোলিত হওয়াটা তাই খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটির প্রকাশভঙিটা একটু অস্বাভাবিকই লেগেছিল সেদিন। তিনি সুনীল গাভাস্কার বলেই তা আরও বেশি। কোনো কিছু নিয়ে মন্তব্য করায় পরিমিতিবোধ সুনীল গাভাস্কারের চরিত্রের বড় বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সেদিন একটু বেশিই যেন আবেগে ভেসে গেলেন।
যেটা কানে লেগেছিল, তা গাভাস্কারের বলার ধরন। যাতে ইংল্যান্ডের প্রতি চূড়ান্ত তাচ্ছিল্য মিশে ছিল। যা চরম রূপে প্রকাশিত হয়েছে সিরিজ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণীতে। এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন না করার পরও গাভাস্কার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ‘ফোর জিরো’ ঘোষণা করে দিলেন।
ভূমিকা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। সুনীল গাভাস্কার কী বলেছিলেন, সংক্ষেপে তা একটু আগে বলে নিই…
ইংল্যান্ডের ওপেনারদের টেকনিক যাচ্ছে তাই। ব্যবহার করেছিলেন ludicrous শব্দটা, যেটার বাংলা করা যায় ‘রীতিমতো হাস্যকর’। হাসিব হামিদ চূড়ান্ত নার্ভাস। বাটলার সাদা বলের ক্রিকেটে ভালো, কিন্তু লাল বলে চলে না। ব্যাটিংয়ে জো রুট আর জেমস অ্যান্ডারসন ছাড়া ইংল্যান্ডের এই দলটার কিচ্ছু নেই। বিখ্যাত টিভি সিরিজের অনুকরণে যেটিকে গাভাস্কার বলেছিলেন ‘টু অ্যান্ড আ হাফ ম্যান টিম’।
লর্ডসে দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ডের অমন বাজে পারফরম্যান্সের পর এই কথাগুলোর একটাও অযৌক্তিক বলে মনে হয়নি। যেটা কানে লেগেছিল, তা গাভাস্কারের বলার ধরন। যাতে ইংল্যান্ডের প্রতি চূড়ান্ত তাচ্ছিল্য মিশে ছিল। যা চরম রূপে প্রকাশিত হয়েছে সিরিজ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণীতে। এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন না করার পরও গাভাস্কার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ‘ফোর জিরো’ ঘোষণা করে দিলেন। বিশেষজ্ঞ ধারাভাষ্যকার হিসেবে এমন মতামত দেওয়ার অধিকার গাভাস্কারের অবশ্যই আছে। কিন্তু ওই যে বললাম, বলার ধরন। ‘ফোর জিরো’ ভবিষ্যদ্বাণীতে একটু তো অবাক হয়েছিলামই, তবে গাভাস্কারের পরের কথাটা একেবারে হতভম্ব করে দিয়েছিল। লর্ডস টেস্টের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গাভাস্কার যখন বললেন, প্রথম ইনিংসে রুটের ব্যাটিংয়ের সময় কিছুক্ষণ বাদ দিলে এই টেস্টে ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল; মনে হলো ভুল শুনছি না তো!
প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ড লিড নিয়েছে, হোক না তা মাত্র ২৭ রানের, প্রথম চার দিন স্বাগতিকরাই একটু এগিয়ে ছিল। শেষ দিনের খেলা শুরুর সময়ও তিনটি সম্ভাব্য ফলের মধ্যে তিন নম্বরে ছিল ভারতের জয়। ইংল্যান্ডের জয় আর ড্র এর আগে। সবচেয়ে বেশি ছিল সম্ভবত ইংল্যান্ডের জয়ের সম্ভাবনাই। ঋষভ পন্ত আউট হয়ে যাওয়ার পর যা আরও বেড়ে যায়। হাতে ৪ উইকেট নিয়ে ১৫৪ রানে এগিয়ে থেকে দিন শুরু করা ভারত লিডটা মাত্র ১৩ রানই বাড়াতে পেরেছে ততক্ষণে। এরপর ম্যাচটা তো ঘুরে গেল মোহাম্মদ শামি আর জসপ্রীত বুমরাহর ৮৯ রানের রেকর্ড জুটিতে। তা এই জিনিস কি প্রতিদিন হয় নাকি! হয় না বলেই তো এটি রেকর্ড। তাহলে ভারতের একাধিপত্য কোথায় দেখলেন সুনীল গাভাস্কার?
এই প্রশ্নের চেয়েও বড় একটা প্রশ্ন আপনার মনে উঁকি দিচ্ছে বলে অনুমান করছি। লর্ডস টেস্ট শেষ হয়েছে নয় দিন আগে, এখন এই পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটছি কেন? শুরুর অনুচ্ছেদটা পড়লেই কারণটা খুঁজে পাবেন। যে ইংলিশ ওপেনারদের অমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলেছিলেন গাভাস্কার, তাদেরকে ভারতের পুরো দলের স্কোর টপকে যেতে দেখেই আসলে গাভাস্কারের ওই দিনের কথাগুলো আবার মনে হলো। এ জন্যই এমন কৌতূহল ছিল গাভাস্কার কী বলেন শোনার জন্য।
হ্যাঁ, এটা লর্ডসের ওপেনিং জুটি নয়। ডম সিবলি বাদ পড়েছেন। রোরি বার্নসের সঙ্গে হেডিংলিতে ওপেন করছেন হাসিব হামিদ। তাতে কি, এদের পক্ষেও তো কিছু করা সম্ভব বলে মনে হয়নি গাভাস্কারের কথায়।
বার্নসকে দারুণ কোনো ব্যাটসম্যান মনে হওয়ার কারণ হয়তো খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনো, তবে রান তো যৎকিঞ্চিৎ করেছেন। অ্যাশেজে সেঞ্চুরি আছে, সেঞ্চুরি আছে নিউজিল্যান্ডে, তৃতীয় ও সর্বশেষ সেঞ্চুরিটা তো নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এই লর্ডসেই। আর সুনীল গাভাস্কারের মতো ক্রিকেট-প্রাজ্ঞের তো এটা অজানা থাকার কোনো কারণই নেই, কোনো পারফরমারকেই একেবারে বাতিল ঘোষণা করে দিতে নেই। কারণ নিজের কথা নিজেকেই গিলে খেতে হতে পারে।
তাহলে গাভাস্কার কেন অমন বলেছিলেন? কেন যেন মনে হয়, লোকরঞ্জন প্রবণতার শিকার হয়ে। ভারতীয় দর্শকেরা যা শুনতে চায়, তা-ই বলেছেন। তাঁর কথা ইংলিশরাও শুনছে জানলে গাভাস্কার অমন বলতেন বলে মনে হয় না। পৃথিবীটা তো এখন এভাবেই চলছে। পাবলিক যা পড়তে চায়, মানুষ যা শুনতে চায়...লেখা বলেন বা কথা বলা...সেটাই হয়ে উঠছে চূড়ান্ত বিবেচনা।
সুনীল গাভাস্কারও তাতে গা ভাসাবেন বলে আশা করিনি বলেই না এত কথা!