`আন্তর্জাতিক` ফুটবলে প্রথম শিরোপা
দুলাল মাহমুদ
১৯ আগস্ট ২০২১
ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশে যখন তুমুল উন্মাদনা, জাতীয় দল তখনো এক অপূর্ণতার নাম। স্বাধীনতার পর ২৪ বছরে ২২টি আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টে শূন্য হাতে ফেরার পর বাংলাদেশ প্রথম শিরোপা জিতেছিল ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত চার জাতি ফুটবল টুর্নামেন্টে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০ ধারাবাহিকে আজ সেই সাফল্যের গল্প।
এর আগে প্রায় ২৪ বছরে ২২টি আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্ব অবশ্যই এর বাইরে। এতগুলো আসরে অংশ নিয়েও কখনো শিরোপা জিততে পারেনি বাংলাদেশ। আর তখন ফুটবলের উত্তাল কাল। জাতীয়ভাবে ফুটবল নিয়ে চরম উম্মাদনা। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ফুটবল। অথচ ঘরোয়া ফুটবল মন রাঙালেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বরাবরই মন খারাপের অনুভূতি হয়েছে। জাতীয় দলের ক্রমাগত ব্যর্থতায় একরকম হতাশায় পেয়ে বসে ফুটবল অনুরাগীদের। ততদিনে বিশ্ব ফুটবলের স্বাদ পাওয়ায় দর্শকদের রুচি বদলে যেতে থাকে। আন্তর্জাতিক ফুটবলে ক্রমাগত ব্যর্থতায় দেশীয় ফুটবল বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায়।
এমন একটা সন্ধিক্ষণে ১৯৯৫ সালের নভেম্বরে অপ্রত্যাশিতভাবে শিরোপা জয় করে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে ২৬ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চার জাতির ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। 'আন্তর্জাতিক' টুর্নামেন্টে এটি বাংলাদেশের প্রথম শিরোপা জয়। এর আগে ১৯৮৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপে শিরোপা জিতে ছিল বাংলাদেশ লাল দল। সে অর্থে লাল দলটিকে জাতীয় দল বলার সুযোগ নেই। তাছাড়া টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া অন্য দলগুলোও জাতীয় দল ছিল না। অবশ্য চার জাতি ফুটবলে মিয়ানমার আর শ্রীলঙ্কার জাতীয় দল খেললেও সিঙ্গাপুরের জাতীয় দলের পরিবর্তে খেলেছে সশস্ত্র বাহিনী দল। সে ক্ষেত্রে একটুখানি খুঁতখুতানি হয়তো রয়ে গেছে। তখন এ নিয়ে আক্ষেপ করার কিছু ছিল না। বাংলাদেশ ফুটবল দল যে শিরোপা জিততে পারে, সেই আত্মবিশ্বাস অর্জন করাটাই ছিল অনেক বড় রসদ। এই শিরোপা এনে দেয় সেই আত্মবিশ্বাস।
এর আগে ১৯৮৪ সালে নেপালে প্রথম সাফ গেমস ফুটবল, ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের পেশোয়ারে কায়দে আজম ফুটবল, ঢাকায় সাফ গেমস ফুটবল এবং ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে চতুর্থ সাফ গেমস ফুটবলের ফাইনালে উঠলেও শিরোপা জিততে পারেনি বাংলাদেশ।
প্রকৃত অর্থেই এই শিরোপার জন্য প্রস্তুত ছিল না দেশের ফুটবল অনুরাগীরা। আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশ খেলবে আর ব্যর্থ হবে, এটাই মোটামুটিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। সে কারণে মোনেম মুন্নার নেতৃত্বে দলটি মিয়ানমারে খেলতে যায় অনেকটাই নীরবে। জার্মান কোচ অটো ফিস্টারের অধীনে খেলোয়াড়রা নামকাওয়াস্তে মাত্র কয়েক দিন প্রশিক্ষণ নেন। মূলত সাফ গেমসের প্রস্তুতি হিসেবে এই টুর্নামেন্টে অংশ নেয় বাংলাদেশ। সে কারণে নতুন কয়েক জন খেলোয়াড়কে জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্ত করেন কোচ। সব মিলিয়ে এই টুর্নামেন্ট নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ ছিল না।
যদিও এশিয়ান গেমস ফুটবলের এক সময়ের চ্যাম্পিয়ন মিয়ানমারের আগের মতো সেই দাপট নেই। তারপরও ফুটবলের সেই কৌলীন্য তো তারা হারিয়ে ফেলে নি। সেটা শুরুতেই বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দেয় দলটি। প্রথম ম্যাচে স্বাগতিক মিয়ানমারের কাছে ০-৪ গোলে হারার পর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আশা করাটা হয়ে ওঠে অনেকটা সুদূরের স্বপ্ন। অবশ্য স্বপ্ন কখনও কখনও এমনভাবে সত্য হয়ে যায়, যা কল্পনাকেও হার মানিয়ে দেয়৷
মিয়ানমারের বিপক্ষে উদ্বোধনী ম্যাচে বাংলাদেশ একদম এলোমেলো হয়ে যায়। স্বাগতিকরা প্রথমার্ধেই তিনটি গোল করে। তবে একাধিক খেলোয়াড় রদবদল করায় দ্বিতীয়ার্ধে অনেকটা গুছিয়ে খেলে বাংলাদেশ। যে কারণে অনেক বেশি গোল হজম করতে হয়নি। দ্বিতীয় ম্যাচে সিঙ্গাপুর সশস্ত্র বাহিনীর বিপক্ষে প্রথম একাদশে পাঁচ জন খেলোয়াড় পরিবর্তন করেন অটো ফিস্টার। বাংলাদেশ ভালো খেললেও রঞ্জনের দেওয়া একমাত্র গোলে জয়ী হয়। তৃতীয় ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চমৎকার খেলে বাংলাদেশ। ২২ মিনিটে পরিকল্পিত একটি আক্রমণ থেকে জয়সূচক একমাত্র গোলটি করেন মিজান।
সিঙ্গাপুর এবং শ্রীলঙ্কাকে হারানোর পরও বাংলাদেশকে নিয়ে আশাবাদী হওয়া যায়নি। কেননা ফাইনালে মুখোমুখি হতে হয় শক্তিশালী মিয়ানমারের। এই দলের বিপক্ষে অতীতটা ছিল দুঃস্বপ্নের। সত্তর দশকে মারদেকা কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে ৬-০ ও ৭-১ গোলে হারার রেকর্ড রয়েছে। তাছাড়া টুর্নামেন্টে তিন ম্যাচে খুব সহজেই জিতে স্বাগতিকরাই ছিল হট ফেবারিট। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা-ও ছিল। দুই হলুদ কার্ডের কারণে ফাইনালে খেলতে পারেন নি দুই ম্যাচে বাংলাদেশের জয়ের নায়ক রঞ্জন ও মিজান। সঙ্গত কারণেই অনেকটাই দুর্বল হয়ে যায় দলের আক্রমণভাগের শক্তি।
আন্ডারডগ হয়েই বাংলাদেশ ৪ নভেম্বর ফাইনাল ম্যাচে খেলতে নামে। তাদের তো হারানোর কিছু ছিল না। হয় এসপার না হয় ওসপার, এই মনোভাব নিয়ে খেলেছে। দলের বিভিন্ন পজিশন অদলবদল করে টিম মাঠে নামান কোচ। সামনে থেকে সাহসিকতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন ড্যাশিং অধিনায়ক. মোনেম মুন্না। নিজেদের নিংড়ে দেন খেলোয়াড়রা। দলের সবাই সেদিন কম-বেশি ভালো খেলেছেন। তবে কঠিন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে জয়টা সহজে পাওয়া যায়নি। যথেষ্ট ঘাম ঝরাতে হয়েছে সবাইকে। অতীতে এমন বাংলাদেশকে খুব একটা দেখা যায়নি।
মুন্না ক্যারিয়ারের অন্যতম একটি সেরা টুর্নামেন্ট খেলেন। প্রতিটি ম্যাচেই তিনি প্রতিপক্ষের আক্রমণ রুখে দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের আক্রমণ গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা রাখেন। তাঁর এই খেলা পুরো দলকে উজ্জীবিত করে। অসাধারণ খেলেন রকিব। ফাইনালে দুটি গোলেরই উৎস ছিলেন তিনি। এছাড়াও ভালো খেলেছেন মামুন জোয়ার্দার, সোহেল আল মাসুম, মাসুদ রানা, হাসান আল মামুন, সোহেল রেজা, আরমান, নকিব, পনির ও পান্নু। প্রথমার্ধের ২৬ মিনিটে মামুন জোয়ার্দার হেডে গোল করে দলকে এগিয়ে নেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে খেলায় সমতা আনে মিয়ানমার। দ্বিতীয়ার্ধের পঞ্চম মিনিটে হেডে গোল করে দলকে এগিয়ে নেন নকিব। এই গোল হজমের পর তা পরিশোধের জন্য মরীয়া হয়ে উঠে মিয়ানমার। কিন্তু বাংলাদেশের রক্ষণভাগ প্রতিরোধ গড়ে তোলায় তাদের সব আক্রমণ নিস্ফল হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ। এই জয় সেই সময় দারুণভাবে উদ্বেলিত করে ফুটবল অনুরাগীদের।
ফাইনালে প্রথম একাদশে খেলেন: গোলরক্ষক পনির, রাইট-ব্যাক হাসান আল মামুন, দুই স্টপার অধিনায়ক মোনেম মুন্না ও সোহেল রেজা, লেফট ব্যাক সােহেল আল মাসুম, মিডফিল্ডার আরমান মিঞা, আজিমউদ্দীন, মাসুদ রানা ও রকিব, ফরোয়ার্ডে মামুন জোয়ার্দার ও নকিব। দ্বিতীয়ার্ধে পনির আঘাত পেলে তাঁর পরিবর্তে খেলেন পান্নু। এছাড়া টুর্নামেন্টে খেলেছেন বরুণ, ছোট মুন্না, আলফাজ, রঞ্জন, মিজান ও ফরহাদ। এই টুর্নামেন্টের মাধ্যমে আন্তজার্তিক ফুটবলে অভিষেক হয় পান্নু, হাসান আল মামুন, সোহেল রেজা, সোহেল আল মাসুম ও আজিমউদ্দীনের।
বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হবে, তা আয়োজকদেরও ভাবনায় ছিল না। চ্যাম্পিয়ন এবং রানার্সআপ দলের প্রাইজমানি ছিল যথাক্রমে ১০ ও ৫ হাজার ডলার। মিয়ানমারকে চ্যাম্পিয়ন ধরে নিয়ে স্থানীয় মুদ্রা এবং বাংলাদেশ রানার্সআপ হবে, এটা মনে করে মাঠে ৫ হাজার ডলার নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হলে আয়োজকরা দারুণ বিপাকে পড়ে যায়। তখন তাদের কাছে ১০ হাজার ডলার ছিল না। যে কারণে মাঠে প্রাইজমানি দেওয়া সম্ভব হয়নি। কালোবাজার থেকে ডলার ক্রয় করতে হওয়ায় বাংলাদেশ দল পুরো প্রাইজমানি পায়ওনি।
বাংলাদেশের শিরোপা জিততে না পারার বদনাম খানিকটা হলেও ঘুচিয়েছে মিয়ানমারের চার জাতি ফুটবল টুর্নামেন্টের মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালে নেপালে এবং ২০১০ সালে ঢাকায় এস এ গেমসে এবং ২০০৩ সালে ঢাকায় সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ ফুটবল দল। তবে প্রথম শিরোপা জয়ের গৌরবের ব্যঞ্জনা অবশ্যই অন্য রকম।