ব্রিজটাউন টেস্টের সেই ম্যারাথন ইনিংস

রেকর্ড বলে ৯৭০ মিনিট, হানিফ বলতেন ৯৯৯

উৎপল শুভ্র

১৪ আগস্ট ২০২১

রেকর্ড বলে ৯৭০ মিনিট, হানিফ বলতেন ৯৯৯

হানিফ মোহাম্মদকে বোঝাতে দুটি সংখ্যাই যথেষ্ট। ৩৩৭ ও ৪৯৯। প্রথমটি ব্রিজটাউনে টেস্ট ক্রিকেটের দীর্ঘতম ইনিংস, দ্বিতীয়টি তখন ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে সর্বোচ্চ। ৩৩৭-এর স্মৃতিচারণা করতে করতে হানিফ অবশ্য দাবি করেছিলেন, রেকর্ড বইয়ে ৯৭০ মিনিট লেখা থাকলে কি হবে, তিনি ব্যাটিং করেছিলেন ৯৯৯ মিনিট। দিয়েছিলেন প্রমাণও।

১৯৫৮ সালের জানুয়ারির ব্রিজটাউন টেস্ট সাক্ষী হয়ে আছে হানিফের বিস্ময়কর মনোসংযোগ ও প্রয়োগক্ষমতার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৯ উইকেটে ৫৭৯ রান তুলে প্রথম ইনিংস ঘোষণা করার পর পাকিস্তান অলআউট হয়ে গিয়েছিল মাত্র ১০৬ রানে। সেই প্রথম ইনিংসে ১৭ রান করতেই দারুণ লড়তে হয়েছিল হানিফকে, 'অমন ফাস্ট উইকেটে এর আগে কোনোদিনই খেলিনি আমি। তার ওপর তখন তো আর হেলমেট ছিল না। শুধু হেলমেট কেন, এখনকার মতো এলবো গার্ড, চেস্ট গার্ড এমনকি থাই প্যাড পর্যন্ত ছিল না। বোলিংও ছিল খুব ভালো–গিলক্রিস্ট, স্মিথ, সোবার্স, অ্যাটকিনসন ব্রাদার্স, ভ্যালেন্টাইন...।'

প্রায় গ্ল্যাডিয়েটরের রূপ ধরে ব্যাট করতে নামা এখনকার ব্যাটসম্যানরা কল্পনাই করতে পারবেন না ব্যাপারটি। হেলমেট, থাই প্যাড, চেস্ট গার্ড কিছুই নেই–বোলারদের ছুঁড়ে দেওয়া আগুনের গোলা সামলাতে শুধু ব্যাটই ছিল তখন ব্যাটসম্যানদের সম্বল! থাই গার্ডের বিকল্প হিসেবে হানিফ মোহাম্মদ ট্রাউজারের বাঁদিকের পকেটে ভরে নিয়েছিলেন মোটা একটা রুমাল, ভাবা যায়! সেই টেস্টটি ছিল ছয় দিনের। তখন তো আর ওভারের সংখ্যা বেঁধে দেওয়া ছিল না, পাঁচ ঘণ্টা করে ছয় দিন খেলে মোট ৩০ ঘণ্টা পুরো করার ব্যবস্থা।

৪৭৩ রানে পিছিয়ে থেকে পাকিস্তান যখন ফলো অন করতে নামল, ম্যাচের তখনো সাড়ে তিন দিন বাকি। ম্যাচের ফলাফল নিয়ে কারো মনেই কোনো সন্দেহ নেই, কতক্ষণে তা শেষ হয়, সেটিই ছিল প্রশ্ন। হানিফও কি তা-ই ভেবেছিলেন? হানিফ বললেন,  'সত্যি বলতে কি আমি কোনো কিছুই ভাবিনি। ইমতিয়াজকে নিয়ে যখন ওপেন করতে যাই, যত বেশি সময় সম্ভব টিকে থাকার চিন্তাই ছিল শুধু মাথায়। ৯১ রান করার পর ইমতিয়াজ গিলক্রিস্টের বলে এলবিডব্লউ হয়ে যায়, যদিও ও ছিল আনলাকি, আমার ধারণা, বলটি লেগ স্টাম্পের বাইরে চলে যাচ্ছিল। এক দিন কাটিয়ে দিলাম, এরপর দুই দিন...।'

শিল্পীর তুলিতে আঁকা হানিফ মোহাম্মদ

বড় ভাই ওয়াজির মোহাম্মদ ছিলেন হানিফের প্রেরণার সবচেয়ে বড় উৎস, সঙ্গে যোগ হয়েছিলেন অধিনায়ক আবদুল হাফিজ কারদারও, 'আমার রুমমেট তখন ওয়াজির ভাই, তিনি তো আমাকে উৎসাহ দিতেনই। অধিনায়ক কারদারও প্রতিদিনই খেলা শেষে আমাদের রুমে আসতেন। আমি খেলা শেষে মিউজিক শোনা বা পাকিস্তানি খাবার খাওয়ার জন্য বন্ধুদের বাড়িতে যেতাম। ফেরার পর দেখতাম, কারদার আয়নায় আমার জন্য “ইউ আর দ্য অনলি হোপ’, ‘ইউ ক্যান ডু ইট’–এ রকম সব মেসেজ লিখে রেখে গেছেন। শেষ দিনের আগের রাতে তিনি লিখলেন, 'কাল টি পর্যন্ত যদি টিকে থাকতে পারো, তাহলেই আমরা ম্যাচ বাঁচিয়ে ফেলব।' কাকতালীয়ভাবে পরদিন টি'র একটু আগে আমি ব্র্যাডম্যানের ৩৩৪ রান পেরিয়ে গেলাম। টি'র ঠিক পরই অফ স্পিনার ডেনিস অ্যাটকিনসনের একটি লাফিয়ে ওঠা বল আমার ব্যাটের প্রায় হ্যান্ডেলে লেগে পেছনে গেল, উইকেটকিপার গ্যারি আলেকজান্ডার বাতাসে লাফিয়ে নিলেন দারুণ এক ক্যাচ।'

পঞ্চম দিন চা বিরতির সময় ব্রিজটাউনের কেনসিংটন ওভাল থেকে বেরিয়ে আসছেন ৩৩৪ রানে অপরাজিত হানিফ মোহাম্মদততক্ষণে ম্যাচ বাঁচানোর অবিশ্বাস্য কাজ করা হয়ে গেছে হানিফ মোহাম্মদের। সেই আনন্দের মধ্যেও অবশ্য একটু বিষাদ ঠিকই ছুঁয়ে যাচ্ছিল হানিফকে, 'ম্যাচ বাঁচিয়ে ফেলেছি, সেজন্য খুশি লাগলেও লেন হাটনের ৩৬৪ রানের রেকর্ডের এত কাছে এসে আউট হয়ে যাওয়ায় একটু খারাপও লাগছিল।' এত বছর পর সেই ইনিংসটির দিকে ফিরে তাকালে প্রথম কী মনে পড়ে হানিফ মোহাম্মদের? 'মনোসংযোগ। এক মুহূর্তের জন্যও আমার মনোসংযোগে চিড় ধরেনি। আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে। আমি তখন বাউন্সার দিলেই হুক করতাম, গিলক্রিস্টকেও তা-ই করছিলাম। কিন্তু গিলক্রিস্টের মতো উইকেটও এতই দ্রুত ছিল যে, আমার টাইমিং হচ্ছিল না। একটি ওভার শেষে অন্য প্রান্তে যাওয়ার সময় ক্লাইড ওয়ালকট আমাকে বললেন, 'তুমি গিলক্রিস্টকে হুক করতে যেও না। হি ইজ টু কুইক ফর ইউ।' ওয়ালকটের এই পরামর্শ আমার অনেক কাজে এসেছে।

হানিফ মোহাম্মদের মনে পড়ে আরেকটি স্মৃতি এবং সেটি রীতিমতো ব্যতিক্রমী, “শেষ দিনের খেলা শুরুর আগে নেটে প্র্যাকটিস করার সময় সে ইনিংসে আমাকে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ফেলা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পেসার এরিক অ্যাটকিনসন এসে বল করতে শুরু করল আমি যেমন অবাক হলাম, তেমনি স্থানীয় সাংবাদিকরাও তা-ই। তারা এসে অ্যাটকিনসনকে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, একটু পরে খেলা আর তুমি প্রতিপক্ষের নট আউট ব্যাটসম্যানকে নেটে বল করছ! অ্যাটকিনসন জবাব দিলেন, 'দুদিন তো আমি ওকে আউট করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে দেখলাম, আমি বুঝে গেছি ওকে আউট করা আমার কাজ নয়।' আমার মনে হয়, টেস্ট ক্রিকেটে কোনো বোলারের প্রতিপক্ষের নেটে এসে বল করার আর কোনো উদাহরণ নেই।” টেস্টে সর্বোচ্চ রানের বিশ্ব রেকর্ড ভাঙতে না পারলেও দীর্ঘতম ইনিংস খেলার যে রেকর্ড গড়েছিলেন হানিফ মোহাম্মদ, সেটি ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের দীর্ঘতম ইনিংসের রেকর্ড হিসেবে টিকে ছিল ৪০ বছরেরও বেশি। সেই রেকর্ড ভেঙে গেলেও টেস্টে দীর্ঘতম ইনিংসের রেকর্ডটি ভাঙবে বলে মনে হয় না । হানিফ অবশ্য তা মানতে চাইলেন না, 'রেকর্ড নিয়ে এমন বলা যায় না। তবে এই রেকর্ডটি ভাঙতে হলে অনেক কিছু পক্ষে থাকা চাই।'

সেই গ্রামাফোন রেকর্ড, যেটিতে আছে হানিফের ৯৯৯ মিনিট ব্যাটিং করার প্রমাণ। ডানে হানিফের অমরত্বের সাক্ষী সেই স্কোরবোর্ড। ছবি: হানিফ মোহাম্মদের আত্মজীবনী থেকে

তা হানিফের ইনিংসটা কত মিনিট স্থায়ী হয়েছিল? রেকর্ড বইয়ে লেখা আছে ৯৭০ মিনিট। কিন্তু এ নিয়ে আপত্তি আছে হানিফের।সেই ইনিংস শেষে একটি গ্রামোফোন রেকর্ড উপহার পেয়েছিলেন, যাতে ছিল তার ইনিংসটির ধারাবিবরণী। আউট হওয়ার পর হানিফ যা শুনেছিলেন, এই গ্রামোফোন রেকর্ডটিও প্রমাণ দেয় তারই—ওই ইনিংসটি ছিল ৯৯৯ মিনিটের। কিন্তু 'ক্রিকেটের বাইবেল' উইজডেন অ্যালমানাক অনড় রয়েছে সেই ৯৭০ মিনিটেই । হানিফ ওই প্রমাণ পাঠানোর পর ওই ৯৭০ মিনিট-এর পর শুধু লেখা হয়েছে, 'হানিফ মনে করেন আসলে তা ৯৯৯ মিনিট'।

তাঁর কীর্তি থেকে ২৯ মিনিট কমিয়ে দেওয়া নিয়ে হানিফ মোহাম্মদকে বেশ ক্ষুব্ধই মনে হয়েছিল। তা স্বীকার করতেও কোনো দ্বিধা ছিল না তাঁর, 'কেন ক্ষুব্ধ হবো না? সত্যিই যদি আমি ৯৯৯ মিনিট ব্যাটিং করে থাকি, রেকর্ডে কেন ৯৭০ মিনিট লেখা থাকবে? আপনিই বলুন না, এটা কি ঠিক?'

চলবে...

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×