সাফ গেমসে এককভাবে সোনা জয়ের হ্যাটট্রিক
যেখানে অনন্য মোখলেসুর রহমান
দুলাল মাহমুদ
১৩ আগস্ট ২০২১
টানা তিনটি সাফ গেমসে এককভাবে স্বর্ণপদক জিতেছেন মোখলেসুর রহমান। যে কৃতিত্ব বাংলাদেশের আর কোনো ক্রীড়াবিদের নেই। স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০ ধারাবাহিকে আজ এই কৃতি ব্রেস্ট স্ট্রোক সাঁতারুর কীর্তিগাথা।
সাঁতারু বললে সার বেঁধে অনেকগুলো নাম চলে আসে। ইংলিশ চ্যানেল জয়ী ব্রজেন দাস, আবদুল মালেক, মোশাররফ হোসেন খান, সরদার মোহাম্মদ ইদ্রিস, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সাঁতার কেটে আলোড়ন সৃষ্টিকারী অরুণ নন্দী, কানাইলাল শর্মা প্রমুখ। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সাঁতারু মোখলেসুর রহমান নামটি হয়তো সেভাবে হয়তো পরিচিত নয়। না থাকার কারণ, পরবর্তীকালে তিনি সাঁতারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। বিদেশে পাড়ি দেওয়ার কারণে তিনি অনেকটাই লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। আর কে না জানে, চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল হতে খুব বেশি সময় লাগে না। তবে তিনি যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, তেমনটা আর কারও নেই। সেটা কখনও আড়াল করা যাবে না।
বুক সাঁতারে টানা তিনটি সাফ গেমসে ব্যক্তিগত ইভেন্টে স্বর্ণপদক জয় করেছেন মোখলেসুর রহমান। বাংলাদেশের আর কোনো ক্রীড়াবিদের যে সাফল্য নেই। দক্ষিণ এশীয় ক্রীড়াঙ্গনে তাঁর যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৭ সালে ভারতের কলকাতায় অনুষ্ঠিত সাফ গেমস দিয়ে। সেবার তিনি ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। বলা যায়, এই গেমসের মাধ্যমে তিনি হাত মকশো করেন। তারপর নিজেকে ধাপে ধাপে মেলে ধরেন।
কিন্তু মোখলেসের নাম বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে ইতিহাস হয়ে আছে ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত সাফ গেমসের কারণে। সেই গেমসে লজ্জাকর এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। স্বর্ণপদক হয়ে উঠে সোনার হরিণ। দেশের সন্মান রেখেছিলেন একমাত্র মোখলেস। ২২ অক্টোবর ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে তিনি স্বর্ণপদক জয় করেন। ১.১০.০৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে গড়েন সাফ রেকর্ড। সেবারের সাফ গেমসে একটি মাত্র স্বর্ণপদক পাওয়া যায় মোখলেসের কৃতিত্বে। দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে পাকিস্তানের মাটিতে প্রথম জাতীয় সংগীত বাজানোর গৌরব তাঁর। তাঁর এই কৃতিত্বে আনন্দে কেঁদেছিলেন ব্রজেন দাসসহ সেখানে উপস্থিত সবাই। এ কারণেও বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে তিনি আলাদাভাবে সম্মানিত হওয়ার দাবি রাখেন। সেবার ৪ × ১০০ মিটার মিডলে রিলে দলের হয়ে রৌপ্য ও ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। রিলে দলে তাঁর সঙ্গে ছিলেন দ্বীন ইসলাম, আবদুস সালাম ও হারুন অর রশিদ। তিনি চমৎকার সাঁতরালেও অল্পের জন্য রিলেতে স্বর্ণপদক জয় করা হয়নি। তবে এখানেই তিনি থেমে থাকেননি।
১৯৯১ সালে শ্রীলঙ্কার কলম্বোয় বাংলাদেশের চারটি স্বর্ণপদকের একটি তাঁর। ইসলামাবাদে দেশের সন্মান রক্ষা করেছিলেন তাঁর প্রিয় ইভেন্ট ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে। কলম্বোয় এই ইভেন্টে একেবারে শেষ মুহর্তে তিনি স্বর্ণপদক হারিয়ে ফেলেন। স্টার্টিংটা খারাপ হওয়ার পরও তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন। মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবেছিলেন শ্রীলঙ্কার জেভিয়ারকে। জেভিয়ার বেশ পিছিয়ে পড়ায় শেষ দশ মিটারে কিছুটা গা ছেড়ে দেন। সেই সুযোগে ডান দিক থেকে তাঁকে পেরিয়ে গিয়ে স্বর্ণপদক ছিনিয়ে নেন আরেক লঙ্কান ইন্তিখাব সিকান্দার। তাঁকে রৌপ্যপদক নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এই ইভেন্টে স্বর্ণপদক হারানোর পর মোখলেস রাতে ঘুমাতে পারেননি। অনেকক্ষণ কেঁদেছেন। কাঁদতে কাঁদতে ২০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে স্বর্ণপদক জয়ের ব্যাপারে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন।
২০০ মিটাএর শুধু স্বর্ণপদকই জয় করেননি, ইন্তিখাব সিকান্দারকে হারিয়ে প্রতিশোধও নেন। ইন্তিখাব প্রাণপণ চেষ্টা করেও তাঁর নাগাল পাননি। তিনি সময় নেন ২.৩৪.৭২ সেকেন্ড। গড়েন নতুন সাফ রেকর্ড। এছাড়া ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে রৌপ্য ও ৪ × ১০০ মিটার মিডলে রিলে দলের হয়ে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। তাঁকে নিয়ে ক্রীড়ানুরাগীদের কৌতূহল ছিল, ১৯৯৩ সালে দেশের মাটিতে কি তিনি স্বর্ণপদক জয় করতে পারবেন? তাহলে অ্যাথলেট শাহ আলমের পর টানা তিনটি সাফ গেমসে স্বর্ণপদক জয় করার গৌরব অর্জন করবেন। এবার ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে স্বর্ণজয়ী বাংলাদেশেরই কারার মিজানুর রহমান। শেষ পর্যন্ত মোখলেসই স্বর্ণপদক জয় করে স্থাপন করেন নতুন মাইলফলক। সময় নেন ১.১০.৩২ সেকেন্ড। ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে রৌপ্য ও ৪ × ১০০ মিটার মিডলে দলের হয়ে ব্রোঞ্জ পদকও জেতেন মোখলেস। রিলে দলে তাঁর সঙ্গে ছিলেন সেলিম মিয়া, কাওসার আহমেদ ও হারুন অর রশিদ।
অ্যাথলেট শাহ আলমও পর পর তিনটি সাফ গেমসে স্বর্ণপদক জয় করেছিলেন। কিন্তু প্রথমবার এককভাবে নয়, জিতেছিলেন স্বর্ণপদক জয়ী রিলে দলের সদস্য হিসেবে। আর মোখলেস তিনটি গেমসে স্বর্ণপদক জয় করেন এককভাবে। যে গৌরব আর কারও নেই। সাফ গেমসের বাইরে ১৯৯০ সালের নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড কমনওয়েলথ গেমস, চীনের বেইজিং এশিয়ান গেমসসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন মোখলেস।
সাঁতারের নন্দনকানন নারায়ণগঞ্জের কাশীপুরের সন্তান মোখলেস। হাঁটতে শেখার আগেই সাঁতার শেখে এই এলাকার শিশুরা। আর বয়স একটু বাড়ন্ত হলে জাতীয় পর্যায়ে সাফল্য পাওয়াটা তো ঐতিহ্যই। মোখলেসও তাঁর ব্যতিক্রম নন। জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় তিনি নিজেকে মেলে ধরেন। ১৯৮০ সালে জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় অনূর্ধ্ব-১০ বছরের প্রতিযোগিতায় ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে প্রথম হন। ১৯৮১ সালে অনূর্ধ-১২ বছরের প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক এবং ১৯৮৩ সালে অনূর্ধ্ব-১৭ প্রতিযোগিতায় ১০০ ও ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকেও জয়ী হন।
১৯৮৫ সাল থেকে বড়দের গ্রুপে অংশ নেন। সেবার ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক এবং ১৯৮৬ সালে ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ব্রোঞ্জ পদক পান। ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি ১০০ ও ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ১৯৯০ সালে ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক, ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক ও ৪ × ১০০ মিটার মিডলে রিলে দলের হয়ে রৌপ্যপদক লাভ করেন। ১৯৯১ সালে তিনি ফিরে আসেন স্বমহিমায়। বুক সাঁতারে তাঁর প্রিয় দুই ইভেন্টে স্বর্ণপদক পুনরুদ্ধার করেন। ১৯৯২ সালে পঞ্চম বাংলাদেশ গেমসে তিনটি স্বর্ণপদক জয় করে তিনি হন অন্যতম সেরা খেলোয়াড়।
বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি মোখলেসকে ১৯৮৯ ও ১৯৯১ সালে সেরা সাঁতারু এবং ১৯৯৩ সালে বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ নির্বাচিত করে। ১৯৮৯ সালে তিনি পেয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরষ্কার।
দক্ষিণ এশীয় গেমসে দিয়েই সাধারণত বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের সাফল্য পরিমাপ করা হয়, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সাঁতারু মোখলেসুর রহমান যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, নিঃসন্দেহে তা আলাদা মর্যাদার দাবিদার।