গতির নেশায় বুঁদ শোয়েব আখতার
উৎপল শুভ্র
১৩ আগস্ট ২০২১
তাঁর আগে-পরে অনেকের নামের পাশেই `গতিতারকা` বিশেষণ বসেছে। তবে গতির ঝড়ে পুরো বিশ্বের মনোযোগ কেড়ে নেওয়ায় শোয়েব আখতারের তুলনা খুঁজে পাওয়া ভার। শোয়েবেরও এক সময় ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠেছিল বলের গতি। যেন তিনি বুঁদ গতির নেশায়। কারণ তো ছিলই।
প্রথম প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ১৯৯৯। প্রথম আলো।
শোয়েব আখতার কেন এ কথা বলেছেন, তা অনুমান করতে পারি। যতটা না তিনি বলেছেন, তার চেয়ে বেশি মিডিয়া তাঁকে দিয়ে বলিয়েছে। ডেনিস লিলি উপদেশ বিলানোর সুযোগটাও পেয়ে গেলেন এ কারণেই। নইলে অনেকের মতেই ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে কমপ্লিট ফাস্ট বোলার যা বললেন, আট মাস আগে নিজেই শুনেছি তা শোয়েব আখতারের মুখ থেকে।
গত মার্চে ঢাকায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল খেলতে যখন ঢাকা এলেন, এখনকার মতো সেনসেশন না হলেও তখনো শোয়েব আখতার বড় এক তারকা। যে দুটি বল পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছে তাঁকে, তার টাটকা স্মৃতি তখন সবার মনে৷ ইডেন গার্ডেনে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ম্যাচে পরপর দুটি টর্নেডো গতির ইয়র্কারে রাহুল দ্রাবিড় আর শচীন টেন্ডুলকারের স্টাম্প এলোমেলো করে দিয়ে শোয়েব তখন পেস সাম্রাজ্যের নতুন অধীশ্বর। আগের বছর অক্টোবরে যখন ঢাকা এসেছিলেন (মিনি বিশ্বকাপে), কেউ তাঁকে পাত্তাই দেয়নি তেমন। অথচ এবার ঘটনা অন্যরকম। বিশ্বের দ্রুততম বোলার হিসেবে তাঁকে মোটামুটি মেনে নিয়েছে সবাই। ঢাকায় টেস্ট শুরু হওয়ার আগের রাতে ইন্টারভিউয়ে প্রথম প্রশ্নটিই ছিল এ নিয়ে: 'এই যে সবাই আপনাকে বিশ্বের দ্রুততম বোলার বলছে, এটা নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগে?' শোয়েব মৃদু হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, 'ভালো তো লাগেই। তবে শুধু দ্রততম হয়ে তো আর লাভ নেই। উইকেট নিতে হবে। যদি দ্রুততম না হয়েও উইকেট পাওয়া যায়, তাতেই আমি খুশি।'
কথাগুলো এর মধ্যে কোথাও পড়েছেন? পড়তে পারেন, কারণ কদিন আগে শোয়েব আখতার সম্পর্ক বলতে গিয়ে মোটামুটি এই কথাগুলোই বলেছেন ডেনিস লিলি, 'নিজের ব্যক্তিগত লক্ষ্য নয়, দলের কথা ভাবো। দলের কথা ভাবা মানেই উইকেট নেওয়ার চেষ্টা করা।' শোয়েব আখতার নিজেই তো সেই চেষ্টাকেই তাঁর আসল লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেছেন অনেক আগেই। তাহলে লিলির আবার তাঁকে সেসব মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন পড়ল কেন?
পড়ল, কারণ মাঝেমধ্যে ওই আসল কাজটিকে ভুলে গতির নেশাতে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছেন শোয়েব আখতার। ঘণ্টায় ১০০ মাইল গতিতে বল করার রেকর্ডটা এখানেই ভেঙে দিতে চাই...অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছেই শোয়েবের মুখে এই ঘোষণা, এরপর ব্রিসবেন টেস্টে তাঁর গতির নেশায় ছোটা এই উপদেশ দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
তবে শোয়েবের এই ঘোষণা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ যোগ করার আছে। শোয়ের এটা বলেছেন ঠিকই, তবে শুরুতেই যে ইঙ্গিত, আসলে বলতে বাধ্য হয়েছেন তিনি, সেটা কী রকম? তা বোঝাতে গেলে একটু বিস্তারিত হতে হবে। ইডেন গার্ডেনে এই জোড়া শেলের আগেই শোয়েব-ঝড়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ক্রিকেট বিশ্বের। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ডারবান টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট ছিল তাঁর বোলিং সামর্থ্যের প্রথম প্রমাণ। গতির ঝড় তোলার যে ক্ষমতা, সেটি এর আগেই দেখানো হয়ে গেছে জোহানেসবার্গ টেস্টে। ‘সে টেস্টে আমি ১৬৭ কিলোমিটার গতিতেও বল করেছিলাম। মাঠে খেয়াল করিনি, পরদিন কার কাছ থেকে যেন শুনলাম'...ডারবান টেস্টের প্রসঙ্গ তোলায় শোয়ের নিজেই জানিয়েছিলেন জোহানেসবার্গের কথা।
এরপর থেকেই আসলে প্রশ্নটা নিয়মিত শুনে যেতে হচ্ছে শোয়েবকে। 'আপনি তো বিশ্বের দ্রুততম বোলার, তা আর কত জোরে বল করতে চান?' এরকম প্রশ্নের জবাব দিতে দিতেই বিশ্বকাপে গেলেন। সেখানে গিয়েই তো শোয়েব সেনসেনশনের আসল গল্প শুরু এবং শুরু সেই গল্পে জেফ টমসনকে টেনে আনারও।
বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে খেলল পাকিস্তান ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে। ইংলিশ প্রেস তখন থেকেই আক্রান্ত 'শোয়েব ম্যানিয়া'য়। সেটিকে অবশ্য অস্বাভাবিকও বলা যায় না। শোয়েব তাঁর ওপর এসে পড়া স্পটলাইটটাকে কখনোই সরতে দেননি। তাঁর চেয়ে বেশি রান করেছেন অনেকে, নিয়েছেন বেশি উইকেটও, কিন্তু প্রশ্নটি যদি হয়, এককভাবে বিশ্বকাপকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছেন কে, তাহলে উত্তর একটাই–শোয়েব আখতার।
শোয়েবের বোলিংই তাঁকে আলোচনায় আনার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তাঁর প্রসঙ্গ উঠলেই বাকি সব চাপা পড়ে গিয়ে জেগে থাকল একটাই বিষয়–কী জোরেই না বল করে ছেলেটি! প্রথম ম্যাচ থেকেই ছড়িয়ে দেওয়া হলো 'মহাজরুরি' প্রশ্নটাও। ইতিহাসে প্রথম বোলার হিসেবে কী ঘন্টায় ১০০ মাইল গতিতে বল করতে পারবেন শোয়েব আখতার? এসবে জেফ টমসন টুকটাক আলোচনায় আসছিলেন। ভালোমতো এলেন সুপার সিক্স শুরুর আগের দিন। বিশ্বকাপের প্রাথমিক পর্বে কথাবার্তা যা হয়েছে, তার সবই অনুমাননির্ভর। সুপার সিক্সের ম্যাচগুলো থেকেই মাঠে বোলারদের বলের গতি মাপার যন্ত্র, সংক্ষেপে অনেকেই সেটিকে বলেন 'স্পিডগান'। ওভালে অস্ট্রেলিয়া-ভারত ম্যাচ দিয়ে সুপার সিক্স শুরু, সে ম্যাচের আগের দিন স্পন্সর ফেডারেল এক্সপ্রেস এটিকেও করে তুলল বড় এক নিউজ আইটেম। গতির লড়াই উদ্বোধন করতে মাঠে এসে উপস্থিত জেফ টমসন, উপস্থিত মানে তাঁকে উপস্থিত করানো হলো। বড় ভূমিকাটা অবশ্যই অর্থকড়ির। পরদিনের ম্যাচের প্রতিদ্বন্দ্বী দু'দলের দুই পেস তারকা গ্লেন ম্যাকগ্রা ও জাভাগল শ্রীনাথকে দু'পাশে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে পোজও দিলেন 'থম্মো'। মজার ব্যাপার হলো, ম্যাকগ্রা-শ্রীনাথ-ফ্লেমিং-প্রসাদ এদেরকে সামনে রেখেও স্পিডগান নিয়ে যতবার কথা হলো, ততবারই শোয়েবের মুখ ভেসে উঠলো সবার চোখের সামনে। তাঁর কথাই হলো বেশি, যেন শোয়েব আখতারের জন্যই এই আয়োজন।
জেফ টমসনকে বেছে নেওয়ার কারণটা জানা ছিল সবারই। তারপরও প্রেস রিলিজ দিয়ে তা জানানো হলো স্পন্সরদের পক্ষ থেকে। সেই প্রেস রিলিজের মূল কথা, এ পর্যন্ত ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুততম বলটি টমসনই করেছেন। সত্তরের দশকে ঘণ্টায় ৯৯.৭ মাইল বেগে বল করার রেকর্ড আছে টমসনের। কিন্তু সে সময় কী এত আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল, কতটা নির্ভুল ছিল এই পরিসংখ্যান? এক সাংবাদিক সাহস করে টমসনকে প্রশ্নটা করেও ফেললেন। টমসন একটুও রাগলেন না, উল্টো হেসে বললেন, 'এটি যখন রেকর্ড করা হয়, তখন তো আমি সেরা ফর্মে নেই। তাছাড়া ঘটনাটি কাঁধের অস্ত্রোপচারের পর।' তাহলে কী এর আগে ১০০ মাইল গতিতে বল করা হয়ে গেছে আপনার? টমসন আবারও হাসলেন, 'কে জানে!'
'গতিতে হয়তো শোয়েবই প্রথম হয়েছে। তাতে কি? ওর চেয়ে নিখুঁত বোলিং করেছে ডোনাল্ড। বয়স হোক, একদিন শোয়েবও বুঝবে গতিটাই ফাস্ট বোলিংয়ের শেষ কথা নয়'–শোয়েব আখতার সম্পর্কে হানসি ক্রনিয়ে
সুপার সিক্সের দ্বিতীয় ম্যাচেই অনুমাননির্ভরতার রহস্য পেরিয়ে শোয়েব এসে দাঁড়ালেন স্পিড গানের বাস্তবতার সামনে। নটিংহামের ট্রেন্টব্রিজে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ম্যাচ। এক দলে শোয়েব আখতার-ওয়াসিম আকরাম, বিপক্ষে অ্যালন ডোনাল্ড-শন পোলক-ল্যান্স ক্লুজনার। শোয়েব বনাম ডোনাল্ড–গতির লড়াই আগাম জমিয়ে তুলতে স্লোগান তোলা হলো এটি। সেই লড়াইয়ে বিপুল ব্যবধানে জিতলেন শোয়েব (সর্বোচ্চ গতির বলটি ছিল ঘণ্টায় ৯৫ মাইল)। কিন্তু স্কোরবোর্ডের চেয়ে হয়তো ফেডেক্সের 'ডিসপ্লে বোর্ডে'র দিকেই বেশি তাকাচ্ছিলেন তিনি। যে কারণে ম্যাচ-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে হানসি ক্রনিয়ে মৃদু হেসে বলার সুযোগ পেলেন, 'গতিতে হয়তো শোয়েবই প্রথম হয়েছে। তাতে কি? ওর চেয়ে নিখুঁত বোলিং করেছে ডোনাল্ড। বয়স হোক, একদিন শোয়েবও বুঝবে গতিটাই ফাস্ট বোলিংয়ের শেষ কথা নয়।' নিজে থেকেই টেনে আনলেন ওয়াকার ইউনিসকে, 'ওয়াকারও কো খুব ফাস্ট ছিল। পার্থক্য হলো, ও শেষ দিকে এমন মার খেত না।' অধিনায়ক ওয়াসিম আকরাম সংবাদ সম্মেলনে আসেননি, পরদিন পত্রিকায় তাঁর কলামে ঘোষণা করে দিলেন, 'এক ওভারে ১৭ রান দিয়ে শোয়েরই আমাদের ডোবাল।'
প্রশ্নটা কিন্তু তাতে থামল না। 'এই ম্যাচে কি আপনি টমসনকে টপকে যেতে পারবেন', 'ঘণ্টায় ১০০ মাইল কী এই ম্যাচেই'...প্রতিটি ম্যাচের আগেই অবধারিতভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেতে হলো শোয়েবকে। সাংবাদিকরা এসব প্রশ্ন করে আশা করেছেন একটাই উত্তর। 'হ্যাঁ, এই ম্যাচেই ১০০ মাইল গতিতে করব'– শোয়েব এটা বললেই তো দারণ হেডলাইন হয়। শোয়েব কিন্তু শুরুতে সেই হেডলাইন দেননি। ফাইনালের দুদিন আগে দুদলের যে অফিসিয়াল সংবাদ সম্মেলন হলো, সেদিন পর্যন্তও এ জাতীয় প্রশ্নের উত্তর, 'চেষ্টা করে দেখব। তবে এটাই আমার মূল লক্ষ্য নয়। দলের কাজে আসতে পারাটাই আমার কাছে আসল।' যতদূর মনে পড়ে, ফাইনালের আগের দিনই প্রথম সেই কাক্ষিত হেডলাইনটি দিলেন শোয়েব, 'আমি চেষ্টা করব। কে জানে, হয়তো কালই হয়ে যাবে।'
এর চেয়েও মজার একটা কথা বললেন কিছুক্ষণ পর। কী একটা টিভি চ্যানেলের জন্য তাঁর সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন সাবেক ভারতীয় পেসার অতুল ওয়াসন। 'ঘণ্টায় এক শ মাইল গতিতে বল করতে পারবে? তাহলে নিল আর্মস্ট্রংয়ের প্রথম চাঁদের মাটিতে পা ফেলার মতো একটা ব্যাপার হবে। পারবে টমসনকে হারাতে?' ওয়াসনের এই প্রশ্নে শোয়েব মাথা নাড়তে নাড়তে উত্তর দিলেন, 'না, আমি টমসন হতে চাই না। শুনেছি ওর লাইন, লেংথ খুব ভালো ছিল না।'
ঔদ্ধত্য না আত্মবিশ্বাস? আপনি যেভাবে দেখেন। তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত, তাঁকে নিয়ে এই যে মাতামাতি, এটি খুবই পছন্দ করেন শোয়েব। প্রশ্ন করতে পারেন, 'এটি আবার বলার মতো কী হলো? এ তো সবাই পছন্দ করবে।' তা হয়তো করবে, তারপরও লাইমলাইটে থাকাটা সবাই সমানভাবে উপভোগ করতে জানেন না। এমনকি কাউকে কাউকে দেখলে মনে হয়, অস্বস্তি হচ্ছে এই অখণ্ড মনোযোগে। শোয়েব এরকম নন। বরং তাঁকে নিয়ে এই হইচই তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেন 'পিন্ডি এক্সপ্রেস'। হইচইটা যাতে এমনই থাকে, হয়তো সে কারণেই আগের সিদ্ধান্ত বদলে রান আপও কমাননি। ঢাকায় দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারেই বলেছিলেন, 'ইমরান ভাই, ওয়াসিম আকরাম ভাই সবাই এই লম্বা রান আপ কমাতে বলছেন। কিন্তু সামনে বিশ্বকাপ, এ সময় ঝুঁকি নিতে চাই না। তবে বিশ্বকাপের পর কমিয়ে দেব।'
বিশ্বকাপ গেছে, কাঁধের ইনজুরিতে পড়েছেন, কিন্তু রান আপ আর কমাননি। গতির প্রশ্নে আপোস করতে চান না শোয়েব আখতার। সেটিই তো স্বাভাবিক। গতির ঢেউয়ের মাথায় চড়েই তো তাঁর এই নাম-যশ-খ্যাতি-অর্থ-বিত্তের চূড়ায় ওঠা।