একসঙ্গে ত্রয়ীর বিদায়

উৎপল শুভ্র

১৩ আগস্ট ২০২১

একসঙ্গে ত্রয়ীর বিদায়

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের তিন `গ্রেট` রিচার্ডস-মার্শাল-ডুজনের টেস্ট ক্রিকেট থেকে বিদায় একই টেস্টে। একসঙ্গে তিন গ্রেটের টেস্ট ছাড়ায় তাঁদের পূর্বসুরি অস্ট্রেলিয়ার গ্রেগ চ্যাপেল, ডেনিস লিলি ও রডনি মার্শ। উত্তরসুরি অস্ট্রেলিয়ারই ওয়ার্ন-ম্যাকগ্রা-ল্যাঙ্গার। কেমন ছিল তাঁদের শেষ টেস্ট?

একই দিনে একটা দলের সেরা ব্যাটসম্যান, সেরা বোলার ও সেরা উইকেটকিপার বিদায় নিলে সেই শূন্যতা কেমন হয়, তা খুব ভালো জানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। যে তিনজনের কথা হচ্ছে, তাঁরা তো শুধু ওই দলেরই না, তর্কযোগ্যভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট ইতিহাসেরই সেরা। ১৯৯১ সালে সেই শূন্যতার সঙ্গে পরিচয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের; যখন ভিভ রিচার্ডস, ম্যালকম মার্শাল ও জেফ ডুজন একই সঙ্গে টেস্ট ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টেনেছিলেন।

এর আগে-পরে আরও দুবার টেস্ট ক্রিকেট এমন তিনজন মহারথীকে একসঙ্গে বিদায় বলতে দেখেছে। ক্যারিবীয় ত্রয়ীর বিদায়ের বছর সাতেক আগে অস্ট্রেলিয়ারও হয়েছে একই রকম শূন্যতার অনুভব। তাদের বরং একটু বেশিই। সেই কারণটা একটু পরেই জেনে যাবেন। শুধু একসঙ্গে বিদায়েই মিল নয়; ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ত্রয়ীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ান ত্রয়ীর আরও মিল আছে এবং তা রীতিমতো অবাক করে দেওয়ার মতো। দলের সেরা ব্যাটসম্যান, সেরা বোলার ও সেরা উইকেটকিপার কথাটা এখানেও প্রযোজ্য। অনুমিতভাবে নামগুলোই শুধু আলাদা। ভিভ রিচার্ডসের বদলে গ্রেগ চ্যাপেল, ম্যালকম মার্শালের বদলে ডেনিস লিলি ও জেফ ডুজনের বদলে রডনি মার্শ।

চ্যাপেল-লিলি-মার্শের বিদায়ের ২৩ বছর পর ওই তিনজনের মতোই সিডনিতে শেষ টেস্ট খেলেন অস্ট্রেলিয়ার সর্বজয়ী এক দলের তিন সদস্য। পার্থক্য বলতে এখানে কোনো উইকেটকিপার ছিলেন না। একজন ওপেনার, বাকি দুজন বোলার। ওপেনার জাস্টিন ল্যাঙ্গার রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়া অস্ট্রেলিয়ার ওই দলে ম্যাথু হেইডেনের ওপেনিং পার্টনার। বোলার দুজন রীতিমতো কিংবদন্তি। গ্লেন ম্যাকগ্রা ও শেন ওয়ার্ন।

একটু আলাদা আলাদা করেই বলি।

শেষ টেস্ট খেলার এসসিজির ড্রেসিংরুমে রডনি মার্শ, ডেনিস লিলি ও গ্রেগ চ্যাপেল। ছবি; গেটি ইমেজেসগ্রেগ চ্যাপেল-ডেনিস লিলি-রডনি মার্শ
অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তান, সিডনি, ১৯৮৪

পাকিস্তানের বিপক্ষে পাঁচ টেস্ট সিরিজের শেষটিকে তাঁদের জীবনেরও শেষ টেস্ট বানিয়ে ফেলার পর তিন বন্ধু যখন বিয়ারে গলা ভেজাচ্ছেন, তাঁদের নামের পাশে গর্বের কিছু রেকর্ড। ডেনিস লিলি শেষ করেছেন ৩৫৫ উইকেট নিয়ে, টেস্ট ক্রিকেটে তখন যা সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ড। সবচেয়ে বেশি ডিসমিসালের রেকর্ডটি রডনি মার্শের অধিকারে। কী আশ্চর্য, সেই সংখ্যাটাও কিনা ৩৫৫!

টেস্ট ক্রিকেটে বোলার-উইকেকিপার যুগলবন্দিতে সবচেয়ে বেশিবার ব্যাটসম্যানের প্রাণ হরণের রেকর্ড এখনো এই দুজনের। স্কোরকার্ডে ‘ক মার্শ ব লিলি’ লেখা হয়েছে ৯৫ বার। ক্যারিয়ার শেষে দুজনের শিকার-সংখ্যাও মিলে যাওয়াটা তাই একটু ভুতুড়েই লাগে। গ্রেগ চ্যাপেল তখন অস্ট্রেলিয়ার সফলতম অধিনায়ক, টেস্ট ইতিহাসেই তাঁর সামনে ছিলেন শুধু ক্লাইভ লয়েড।

রেকর্ড গড়ে আর মাইলফলক ছুঁয়ে শেষ টেস্টটা রাঙিয়ে দিয়েছিলেন তিনজনই। প্রথম বোলার হিসেবে ডেনিস লিলি ছুঁয়েছিলেন ৩৫০ উইকেটের মাইলফলক। দুই ইনিংসেই নিয়েছিলেন ৪টি করে উইকেট। উইকেট নিয়েছিলেন শেষ বলেও। রডনি মার্শ ৯৬তম টেস্ট খেলতে নেমে ভেঙে দিয়েছিলেন উইকেটকিপার হিসেবে অ্যালান নটের সবচেয়ে বেশি টেস্ট খেলার রেকর্ড। 

গ্রেগ চ্যাপেল অভিষেক টেস্টের মতো শেষ টেস্টেও সেঞ্চুরি করেন। ১৮২ রানের এক ইনিংস খেলে পান ম্যাচ-সেরার স্বীকৃতি। যা খেলার পথেই ডন ব্র্যাডম্যানের ৬৯৯৬ রানের অস্ট্রেলিয়ান রেকর্ড টপকে সেটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন ৭১১০ রানে। বিদায়বেলায় ব্যক্তিগত সাফল্যের উদযাপনটা এত দারুণ হতো না, যদি দল না জিতত। সেদিক থেকেও পূর্ণতা। অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল ১০ উইকেটে। সব মিলিয়ে গ্রেগ চ্যাপেলের বিদায়টা এর চেয়ে ভালো হতে পারত বলে মনে হয় না।

তিনজনের বিদায়ের পর
একসঙ্গে এই তিনজনকে হারানোর ধাক্কা সামলাতে অনেক দিন লেগেছে অস্ট্রেলিয়ার। এরপর টানা চারটি টেস্ট সিরিজে হারতে হয়েছে, জেতা হয়নি পরের ৮টিতেই, যার মধ্যে ছিল দুটি অ্যাশেজও। অথচ এঁদের বিদায়ের ঠিক আগের মৌসুমেই অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করেছিল অস্ট্রেলিয়া, সর্বশেষ ১০ সিরিজে হেরেছিল মাত্র দুটিতে।ভিভ রিচার্ডস, ম্যালকম মার্শাল ও জেফ ডুজন: শেষটা ভালো হয়নি তাঁদেরভিভ রিচার্ডস- ম্যালকম মার্শাল-জেফ ডুজন
ওয়েস্ট ইন্ডিজ-ইংল্যান্ড, ওভাল ১৯৯১

বিদায়ের সময় অস্ট্রেলিয়ান ত্রয়ীর মতো ক্যারিবীয় ত্রয়ীরও দেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রান, উইকেট ও ডিসমিসালের রেকর্ড। রিচার্ডসের ৮৫৪০ রানের চেয়ে তখন রান বেশি শুধু সুনীল গাভাস্কার ও অ্যালান বোর্ডারের। মার্শালের ৩৭৬ উইকেটের চেয়ে বেশি উইকেট রিচার্ড হ্যাডলি ও ইয়ান বোথামের। ডুজনের চেয়ে বেশি ডিসমিসাল শুধু রডনি মার্শের।

বিদায়টাকে অবশ্য অস্ট্রেলিয়ানদের মতো স্মরণীয় করে রাখতে পারেননি এঁরা তিনজন। ব্যক্তিগত সাফল্যে তো নয়ই, দলীয় সাফল্যেও নয়। মার্শাল মাত্র ২ উইকেট নিতে পেরেছিলেন ওই টেস্টে। ডুজন দুই ইনিংসে করেছিলেন ০ আর ৫। রিচার্ডস প্রথম ইনিংসে ২, দ্বিতীয় ইনিংসে ৬০। দ্বিতীয় ইনিংসে ৬০ রানের ইনিংসটার অন্য একটা গুরুত্ব ছিল। টেস্টে রিচার্ডসের ব্যাটিং অ্যাভারেজ ৫০-এর ওপরে থাকাটা নিশ্চিত হয়েছে এতেই।। যদিও এ নিয়ে ভিভ রিচার্ডসের তখন খুব খুশি হওয়ার মতো অবস্থা নয়।

নিজের এবং দলের পারফরম্যান্স নিয়ে যাঁর অসম্ভব গর্ব ছিল, জীবনের শেষ টেস্টেই যে তাঁকে দেখতে হয়েছে অভাবনীয় সব দৃশ্য। সাত বছরের মধ্যে প্রথম ফলো অন করছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড বলে তা আরও বাড়তি মাত্রা পেয়ে যাচ্ছে। যাদের বিপক্ষে ৫-০ স্কোরলাইন তো এক সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য নিয়মই হয়ে গিয়েছিল। আর এখানে, সেই ইংল্যান্ডই কিনা ২২ বছরের মধ্যে প্রথম ফলো অন করতে বলছে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে! এমন কিছু তো রিচার্ডস-মার্শাল-ডুজনের অভিজ্ঞতাতেই ছিল না। ইনিংস পরাজয় এড়াতে পারলেও ঠিকই হারতে হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ৫ উইকেটে জিতে সিরিজে ২-২ সমতা এনেছিল ইংল্যান্ড।

তিনজনের বিদায়ের পর
এমন তিনজন খেলোয়াড় একসঙ্গে ‘অতীত’ হয়ে যাওয়াটাও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে খুব একটা ভোগায়নি। ১৯৭৮ সালে সর্বশেষ টেস্ট সিরিজ হারা দলটির অপরাজিত থাকার রেকর্ড বজায় ছিল ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ এই ত্রয়ীর বিদায়ের চার বছর পরও বিশ্বের সেরা দলের স্বীকৃতিটা ওয়েস্ট ইন্ডিজই পেয়ে এসেছে।

সেই এসসিজি ড্রেসিংরুমেই ল্যাঙ্গার, ম্যাকগ্রা ও ওয়ার্নের বিদায়ী ছবিশেন ওয়ার্ন, গ্লেন ম্যাকগ্রা ও জাস্টিন ল্যাঙ্গার
অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড, সিডনি, ২০০৭

এক শর বেশি টেস্ট খেলেছেন, এমন তিনজন ক্রিকেটারের এক সঙ্গে বিদায়ের একমাত্র ঘটনা এটি। ওয়ার্ন তখন টেস্ট ইতিহাসের সফলতম স্পিনার, ম্যাকগ্রা সফলতম পেসার, রান-সেঞ্চুরির কোনো রেকর্ড না থাকলেও ল্যাঙ্গার অবশ্যই অস্ট্রেলিয়ার সাফল্যের অন্যতম রূপকার হিসেবে স্বীকৃত। ২৩ বছর আগে চ্যাপেল-লিলি-মার্শের সঙ্গে এই তিনজনের শুধু বিদায়ী টেস্টের ভেন্যুই মিলে যায়নি, মিল আছে সাফল্যেও। এই টেস্টে ১০ উইকেটে জিতে অস্ট্রেলিয়া আবারও সিরিজে ৫-০ হোয়াইটওয়াশ করেছিল ইংল্যান্ডকে। ম্যাকগ্রা দুই ইনিংসেই নিয়েছিলেন ৩টি করে উইকেট। লিলির মতো তাঁরও টেস্ট ক্রিকেটে শেষ বলে উইকেট।

ওয়ার্ন দুই ইনিংসে মাত্র একটি করে উইকেট নিলেও দলের জয়ে বড় অবদান ছিল তাঁর। সেই অবদান ব্যাট হাতে। ৬৫ বলে ৭১ রান করে ওয়ার্নই অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসের সর্বোচ্চ স্কোরার। ল্যাঙ্গার প্রথম ই্নিংসে করেছিলেন ২৬, দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ২০। তবে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের সময় উইকেটে থাকাটা  অবশ্যই বাড়তি তৃপ্তি দিয়েছে তাঁকে। যদিও উইনিং শটটি মেরেছিলেন তাঁর ওপেনিং পার্টনার হেইডেন।

তিনজনের বিদায়ের পর
ওয়ার্ন-ম্যাকগ্রা-ওয়ার্ন থাকতে সর্বশেষ ১৬টি টেস্ট সিরিজের মাত্র একটাই হেরেছিল অস্ট্রেলিয়া (২০০৫ সালের অ্যাশেজ), কিন্তু তাদের বিদায়ের পর পরের ৮টি সিরিজের ৩টিতেই হারতে হয়েছে। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে একটি করে, অন্যটি অ্যাশেজে।        

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×