রেকর্ডের কথা বলতেই তা করে ফেললেন সাকিব!
উৎপল শুভ্র
১২ আগস্ট ২০২১
২০১৪ সালে খুলনায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টের আগে একটা রেকর্ডের কথা মনে করিয়ে দিলাম আর কদিন পর ওই টেস্টেই তা করে ফেললেন সাকিব! এই ভুতুড়ে কাণ্ড তো আমার নিজেরই অভিজ্ঞতা। খুলনার ওই টেস্টে বোথাম আর ইমরানের পাশে বসেছিলেন, বছর তিনেক পর ঢাকায় অস্ট্রেলিয়াকে হারানো টেস্টে হ্যাডলির পাশে। ধারাবাহিকের শেষ পর্বে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের সঙ্গে সাকিবের তুলনা।
সাকিবের চরিত্র-চিত্রণ অনেক হলো। আবারও হয়তো একটু করতে হতে পারে। আপাতত আবার একটু খেলায় ফিরি। সাকিব মনেপ্রাণে চাইলেই যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারেন, প্রায় মিথে রূপান্তরিত যে ধারণার কথা শুরুর দিকেই বলেছি, সেটির বড় প্রমাণটাই তো দেওয়া হয়নি। ঘটনাচক্রে আমিও যেটির সঙ্গে জড়িয়ে। ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা এবং ওই সময়টায় নানা অপপ্রচার পেছনে ফেলে ২০১৪ সালের অক্টোবরে মাঠে ফিরেছেন সাকিব। ঢাকায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের প্রথম দিনেই নিয়েছেন ৬ উইকেট। আরেকবার 'সাকিবীয়' প্রত্যাবর্তনের জন্য অভিনন্দন জানাতে সেই রাতেই সাকিবকে ফোন করলাম। কী ভেবে যে ওই প্রসঙ্গটা তুলেছিলাম, ভেবে এখনো একটু অবাকই লাগে। আগেও একবার তা লিখেছি বলে কথোপকথনের ওই অংশটা হুবহু তুলে দিতে পারছি—
সাকিব, অলরাউন্ডারদের মধ্যে একটা কীর্তি আছে শুধু ইয়ান বোথাম ও ইমরান খানের।
—কী সেটা?
একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট।
–ভালো হলো। জানা থাকল।
নতুন টার্গেট সেট করে ফেললেন নাকি?
ওপ্রান্ত থেকে একটু হাসির আভাস পাওয়া গেল, 'সামনে একটা কিছু থাকলে ভালোই হয়।'
খুলনায় পরের টেস্টেই যে তা করে ফেললেন, এটাকে আমি এখনো স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারি না। অতিপ্রাকৃত কিছু মনে হয়। প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে থাকায় ওই টেস্টের শেষ দিন মাঠে থাকতে পারিনি। এর আগেই প্রথম ইনিংসে সাকিবের সেঞ্চুরি করা হয়ে গেছে, জিম্বাবুয়ের প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়াও। জিম্বাবুয়ের দ্বিতীয় ইনিংসের আগেই প্রথম আলোতে ছাপা হয়ে গেছে আমার লেখা, 'সাকিবকে ডাকছেন ইমরান ও বোথাম'। লেখাটার কথা মনে থাকার আরেকটা কারণও আছে। বিকেলে যশোর থেকে ঢাকা ফেরার ফ্লাইট। সকালে মাঠে গিয়ে লাঞ্চ পর্যন্ত খেলা দেখার পর হোটেলে লেখাটা শুরু করতে না করতেই যশোর এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হওয়ার সময় হয়ে গেল। যশোর এয়ারপোর্টে অর্ধেকটা মতো এগিয়ে রাখার পর যেটি শেষ করলাম ঢাকায় এয়ারপোর্টে নামার পর। মেইল করে অফিসেও পাঠালাম সেখান থেকেই। বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসই তখন শেষ হয়নি। পরদিন সকালেই বাংলা একাডেমিতে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে চলে যাওয়ায় খেলা দেখা হচ্ছে না। বিকেলের দিকে সেখানেই পেলাম খবরটা— সাকিব কীর্তিটা করে ফেলেছেন! নতুন বলে বোলিং শুরু করে ৪৪ রানে ৫ উইকেট নিয়ে জিতিয়েও দিয়েছেন বাংলাদেশকে।
স্বীকার করে নেওয়াই ভালো, মনে হলো যেন আমাকেও জিতিয়ে দিয়েছেন! পরে খুলনা থেকে সহকর্মীর ফোনে জানলাম, খেলা শেষে পুরস্কার বিতরণীতে সাকিব আমার সঙ্গে সেই কথোপকথনের কথা বলেছেন। পরে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়ে দিয়েছেন, সবার মনে কৌতূহল জাগিয়ে তোলা সেই ‘ওয়ান জার্নালিস্ট' এর নাম-পরিচয়ও। সাংবাদিকতার জীবনে হাতে গোনা যে কবার গর্বের অনুভূতি হয়েছে, এটি তার একটি। সেটি সাকিব আমার নাম বলেছেন, এ কারণে নয়। এমন অবিস্মরণীয় এক কীর্তিতে আমার পরোক্ষ কোনো অবদান থাকলেও থাকতে পারে ভেবে। সাকিবকে অভিনন্দন জানিয়ে পাঠানো খুদে বার্তায় একবার লিখতেও চেয়েছিলাম, 'লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির'। শিশির-সংক্রান্ত কোনো রসিকতা সাকিবের জন্য স্পর্শকাতর হতে পারে ভেবে তা আর লিখিনি!
খুলনায় ইমরান-বোথামের পাশে বসলেন। এর তিন বছর পর ঢাকায় হ্যাডলির পাশে। একই সময়ের 'ফ্যান্টাস্টিক ফোর’-এর অন্যজন, কপিল দেবের নামটা যে আসছে না, তার কারণ, কপিলের অনেক অত্যাশ্চর্য কীর্তি থাকলেও বাকি তিনজনের মতো সুনির্দিষ্ট কোনো রেকর্ড নেই। ভাবলে একটু অবাকই লাগে, সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের চার-চারজন একই সঙ্গে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন বিশ্ব ক্রিকেট। এই চারজনের আগে-পরে সর্বকালের সেরা স্বীকৃতির দাবিদার শুধুই দুজন—স্যার গ্যারি সোবার্স ও জ্যাক ক্যালিস। এই ছয়জনের তুলনায় কোথায় থাকবেন সাকিব?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করেছিলাম অলরাউন্ডারের প্রথাগত সংজ্ঞা ধরে। সেই সংজ্ঞাটা হলো, আদর্শ অলরাউন্ডার তাঁকেই বলে—ব্যাটসম্যান বা বোলার দুই ভূমিকাতেই দলে যিনি জায়গা পেতে পারেন। এই শর্ত ছয়জনই পূরণ করেন। এরপর যে প্রশ্নটা আসে, দুটিতেই তাঁরা সমান ভালো কি না। এটির উত্তর খোজারও মোটামুটি সর্বজনগ্রাহ্য একটি পদ্ধতি আছে-ব্যাটিং আর বোলিং গড়ের পার্থক্য। এটা যত কম হয়, ততই ভালো। এই মানদণ্ডে সাকিবের চেয়ে এগিয়ে থাকেন কপিল দেব, রিচার্ড হ্যাডলি ও ইয়ান বোথাম (কপিল ১.৪, হ্যাডলি ৪.৮৬, বোথাম ৫.১৫, সাকিব ৮.৩৬)। ইমরান খানের ক্ষেত্রে পার্থক্যটা ১৪.৮৮।
সোবার্স ও ক্যালিসের ক্ষেত্রে সেটি (২৩.৭৫ ও ২২.৭২) সবচেয়ে বেশি হওয়ার বড় কারণ ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁদের অসাধারণত্ব। ব্যাটিং গড়ের বিবেচনায় এঁরা দুজনই যে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের দলে থাকেন। কমপক্ষে ২০ ইনিংস খেলেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ব্যাটিং গড়ের দিক থেকে সোবার্স ১২ নম্বরে, ক্যালিস ১৭ নম্বরে। আট হাজারি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তো সোবার্সই সবার ওপরে (৫৭.৭৮), ক্যালিস তিনে (৫৫.৩৭)। দুজনের মাঝখানে শুধু কুমার সাঙ্গাকারা (৫৭.৪০)। ব্যাটিং-বোলিং গড়ের পার্থক্য দিয়ে অলরাউন্ডারের ভালো-মন্দ নির্ধারণের প্রচলিত প্রথাটা নিয়ে অবশ্য একটা প্রশ্ন তোলাই যায়। কেউ ব্যাটিং-বোলিং দুটিতেই খুব ভালো হলে তো পার্থক্যটা বড়ই হবে। কারণ, ব্যাটিং গড় বাড়তে থাকবে, কমতে থাকবে বোলিং গড়।
ব্যাটিং-বোলিং গড়ের পার্থক্যে সাকিবকে সেরাদের পাশেই পাওয়ার পর কৌতূহলটা বেড়ে গেল । সাকিবের ৫০তম টেস্ট শেষে রেকর্ড ঘেঁটে দেখেছিলাম, ৫০ টেস্ট শেষে আর কারোরই তিন হাজার রান আর ১৫০ উইকেট ছিল না। ২০১৯ সালের শুরুতে বাংলাদেশের ১১ ক্রিকেটারকে নিয়ে 'এগারো' বইটা শেষ করার সময় সাকিব টেস্ট খেলেছিলেন ৫৫টি। এ কারণেই দেখতে চেয়েছিলাম, ৫৫ টেস্ট শেষে কেমন ছিল বাকি পাঁচজনের পারফরম্যান্স। পাশাপাশি সাজানোর পরই বিষম চমক! সাকিব তো কারও চেয়ে একটুও পিছিয়ে নন। তাঁর চেয়ে রান বেশি ছিল শুধু সোবার্সের, কিন্তু উইকেট আবার ৮৬টি কম। উইকেট বেশি বোথাম-ইমরান-হ্যাডলি-কপিল চতুষ্টয়ের, রানে আবার সাকিব চারজনের চেয়েই এগিয়ে। ক্যালিস রান-উইকেট দুটিতেই সাকিবের চেয়ে পিছিয়ে। এরপর আর ৩টিই টেস্ট খেলেছেন সাকিব। ৫৮ টেস্ট শেষেও হিসাবটা মোটামুটি একই রকম আছে (উপরের ছক দ্রষ্টব্য)। সাম্প্রতিক সময়ের সেরা অলরাউন্ডার বেন স্টোকসকেও যোগ করে নিয়েছি তালিকায়। রান-উইকেট দুটিতেই এগিয়ে সাকিব। উইকেটে তো অনেক বেশি।
টেস্টেই যদি এমন হয়, তাহলে ওয়ানডেতে আরও ভালো বলে বিবেচিত সাকিব তাঁদের তুলনায় কোথায় থাকবেন? সোবার্সের সঙ্গে তুলনা অর্থহীন। ওয়ানডেই খেলেছেন মাত্র একটি। নিয়তির পরিহাসই বলতে হয়, প্রায় সবার চোখেই সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের ওয়ানডেতে কোনো রানই নেই! রানের ঘরে শূন্য আর উইকেটের ঘরে ১—এই হলো সোবার্সের ওয়ানডে ক্যারিয়ার। বাকিদের মধ্যে ক্যালিস আর কপিল সাকিবের চেয়ে বেশি ওয়ানডে খেলেছেন, ইমরান-বোথাম-হ্যাডলি কম। তারপরও পথ তো একটা বের করে নেওয়াই যায়। সাকিব এখন পর্যন্ত ওয়ানডে খেলেছেন ২১৫টি। তা ২১৫টি ওয়ানডে খেলার পর ক্যালিস আর কপিলের পারফরম্যান্স কেমন ছিল, এটা দেখলেই তো হয়। আর ইমরান-বোথাম-হ্যাডলির সঙ্গে তুলনা করতে সাকিবের ক্যারিয়ার ধরে পিছিয়ে গেলেই জানা যায়, এই তিনজনের ক্যারিয়ারের সমান ম্যাচ খেলার পর কেমন করেছিলেন তিনি।
এভাবে হিসাব-নিকাশ করে শ্রেষ্ঠত্বের মীমাংসা হয় কি না জানি না, তবে এই সিদ্ধান্তে তো অবশ্যই পৌঁছানো যায় যে, সাকিব আল হাসান ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন।
সেই হিসাব কী বলছে? হিসাব বলছে, সাকিবের সমান ২১৫টি ওয়ানডে খেলার পর রান-উইকেট দুটিতেই পিছিয়ে ছিলেন কপিল। ক্যালিস রান করেছিলেন ১০৭৪ বেশি, কিন্তু উইকেট নিয়েছিলেন ৮৩টি কম। এবার সাকিবের চেয়ে কম ম্যাচ খেলা তিনজনে আসি। ১৭৫ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ইমরান রান-উইকেট দুটিতেই ১৭৫ ম্যাচের সাকিবের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। বোথাম খেলেছেন ১১৬টি ওয়ানডে। সমসংখ্যক ওয়ানডে খেলার পর সাকিব উইকেট নিয়েছিলেন একটি কম, কিন্তু রান করেছিলেন ১১৪৮ বেশি। হ্যাডলি ১১৫ ম্যাচের রেকর্ডের সঙ্গে সাকিবের ১১৫ ম্যাচ মেলালে হ্যাডলি উইকেট নেওয়ায় ১৬টিতে এগিয়ে থাকেন, কিন্তু রান করায় পিছিয়ে থাকেন ১৪৩১।
এভাবে হিসাব-নিকাশ করে শ্রেষ্ঠত্বের মীমাংসা হয় কি না জানি না, তবে এই সিদ্ধান্তে তো অবশ্যই পৌঁছানো যায় যে, সাকিব আল হাসান ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন।
সেটিও সাকিবের নামের পাশে আরও কিছু নাম্বার যোগ করে, এমন একটা বিষয় বাদ দিয়েই। ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় ক্যালিস ২৫টি আন্তর্জাতিক টি টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন, সাকিব খেলেছেন ৮৪টি। বাকিদের ক্ষেত্রে টি টোয়েন্টির প্রশ্নই আসছে না। খেলোয়াড়ি জীবনে তাঁরা তো এর নামই শোনেননি। ক্যালিস ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ-টিগ মিলিয়ে মোট ১৭৬টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন, সাকিব খেলেছেন প্রায় দ্বিগুণ (৩৩৬)। ক্যালিসের মোট টি-টোয়েন্টি ম্যাচের প্রায় অর্ধেকই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর। যেখানে আজ এই লিগ, কাল ওই লিগে টি-টোয়েন্টি খেলে বেড়ানোর ধকল সয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিবের ওই পারফরম্যান্স।
এসব বিবেচনায় নিয়ে ক্রিকেটার হিসেবে সাকিবের অসাধারণত্বের সঙ্গে আরেকটা ব্যাপারেও আবার নিঃসন্দেহ হয়ে যাচ্ছি। সাকিব আল হাসানের মূল্য বাংলাদেশ এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। সত্যিকার অর্থেই তা বুঝতে হয়তো ক্রিকেট থেকে সাকিবের বিদায় নেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
(সমাপ্ত)