রত্নগর্ভা মায়ের নাম আমির বী
উৎপল শুভ্র
১২ আগস্ট ২০২১
চার ছেলে টেস্ট ক্রিকেট খেললে সেই মাকে তো রত্মগর্ভা বলতেই হয়। মোহাম্মদ ভাইদের মা আমির বী নিজেও ছিলেন খেলোয়াড়। ব্যাডমিন্টন ও ক্যারম খেলে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। মায়ের উৎসাহ আর প্রশ্রয়ের কথা যেমন বলেছিলেন হানিফ মোহাম্মদ, তেমনি কিছু ছেলেমানুষীর কথাও।
১৯৬৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করাচিতে হানিফের খেলা শেষ টেস্টে অভিষেক সাদিক মোহাম্মদের। মুশতাক মোহাম্মদ ছিলেন আগে থেকেই। একই টেস্টে তিন ভাই খেলার মাত্র তৃতীয় উদাহরণ এটি। মোহাম্মদ ভাইদের ক্ষেত্রে সেটিই যে একমাত্র উদাহরণ হয়ে থাকবে—সেটি তখন মোটেই ভাবেননি হানিফ। কিন্তু সেই টেস্টের পরই একরকম বাধ্য হয়েই অবসরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে হয় তাঁকে।
কেন, কীভাবে তা হয়েছিল, তা-ও বললেন হানিফ মোহাম্মদ। কথা বলেন অনুচ্চ স্বরে, তারপরও হতাশা-তিক্ততা-ক্ষোভ সবই ফুটে উঠল তাতে, 'সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল হাফিজ কারদার কয়েকজন সাংবাদিককে দিয়ে আমাকে খবর পাঠান, নিজে থেকে অবসর না নিলে আমাকে বাদ দেওয়া হবে। আমার ভাইদের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রচ্ছন্ন হুমকি ছিল এর সঙ্গে। অথচ তখন আমার বয়স মাত্র ৩৪, আরও তিন-চার বছর খেলার ক্ষমতা আছে—এটা কদিন আগে কারদারই বলেছিলেন আমাকে। জানি না, যার অধিনায়কত্বে আমার টেস্ট খেলার শুরু, তিনি কেন এমন করলেন!"
সেই 'অবিচারের' স্মৃতি আমৃত্যু পুড়িয়ে গেছে হানিফ মোহাম্মদকে, তবে ছেলে শোয়েব এর চেয়েও বড় অবিচারের শিকার হয়েছে বলেই দাবি করেছিলেন তিনি, 'শোয়েবকে কখনই স্বস্তিতে খেলতে দেওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত তো ফর্মে থাকতেই বাদ দিয়ে দেওয়া হলো।‘ এর আগেই অবশ্য আরেকটি ইতিহাস গড়া হয়ে গেছে মোহাম্মদদের। টেস্ট ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি করা একমাত্র পিতা-পুত্র হিসেবে রেকর্ডবুকে নাম উঠে গেছে হানিফ-শোয়েবের। একটা সময় টেস্টে পাকিস্তানের পক্ষে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটি ছিল হানিফ মোহাম্মদের আর ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড শোয়েব মোহাম্মদের। শোয়েবের ১২৬ রানের রেকর্ড এখন অতীত হয়ে গেলেও ১৯৫৭-৫৮ সিরিজে ব্রিজটাউনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হানিফের অপরাজিত ৩৩৭ রানের সেই মহাকাব্যিক ইনিংস এখনো হয়ে আছে পাকিস্তানের পক্ষে টেস্টে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।
হানিফ মোহাম্মদের দাবি যদি সত্যিই হয়, তাহলে প্রশ্ন জাগতে বাধ্য, মোহাম্মদ পরিবারের ছেলে বলে যেখানে শোয়েব মোহাম্মদের বাড়তি সুবিধা পাওয়ার কথা, সেখানে তাঁর প্রতি অবিচার হলো কেন? হানিফের ধারণা এর মূলে আছে হিংসা, ‘মোহাম্মদ পরিবারের এমন সাফল্য অনেকেই সহ্য করতে পারে নি। দেশভাগের পর ভারতের জুনাগড় থেকে সহায় সম্বলহীনভাবে এখানে এসেছিলাম আমরা। শুরু থেকেই আমাদের সংগ্রাম করতে হয়েছে, আমাদের পক্ষে কথা বলার কেউ ছিল না। কিন্তু আমাদের পারফরম্যান্সের কারণে কেউ আমাদের আটকাতে পারেনি।'
সেই সংগ্রামে মোহাম্মদ ভাইদের সবচেয়ে বড় প্রেরণা ছিলেন মা আমির বী। মা তিনি নিজেও ছিলেন খেলোয়াড়। ব্যাডমিন্টন ও ক্যারম খেলে অনেক পুরস্কার জিতেছেন, ছেলেরাও খেলার স্বার্থে তার কাছ থেকে পেয়েছেন সব ধরনের প্রশ্রয়। ভারত থেকে পাকিস্তানে পাড়ি জমানোর দুবছর পরই মারা যান মোহাম্মদ ভাইদের বাবা। এরপর থেকে হানিফ মোহাম্মদদের মা-বাবা দুই-ই তিনি। কোনো ম্যাচ থাকলে সন্ধ্যায় ছেলেদের পারফরম্যান্স জানার জন্য ছটফট করতেন মা এবং অবধারিতভাবেই কারো না কারো ওপর রেগে যেতেন। সেই রাগ যে সব সময় বাজে পারফরম্যান্সের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকত, তা নয়।
এ রকমই একটি মজার ঘটনা বলতে গিয়ে হাসি ফুটে উঠল হানিফের মুখে, “কায়েদ-ই-আজম ট্রফির একটি ম্যাচে আমি আর মুশতাক খেলছিলাম পিআইএর পক্ষে আর করাচির পক্ষে সাদিক । সাদিকের রান যখন ৯৬, আমি মুশতাককে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ থেকে সরিয়ে দ্বিতীয় গালিতে নিয়ে যাই। এই ফিল্ডিং পরিবর্তনের পর পরই সাদিক মুশতাককে ক্যাচ দেয়। রাতে আম্মা এ কথা জানার পর আমার ওপর ভীষণ রেগে যান। আমি যতই তাকে বোঝাতে যাই, এটা ছিল শুধুই খেলা, ততই রাগ বাড়ে তাঁর। আমার কারণে ছোট ভাই সেঞ্চুরি পায়নি, এটা তিনি মানতেই পারছিলেন না। ওই ঘটনার পর দুদিন আমার সঙ্গে কথাই বলেননি তিনি।'
৫৫ টেস্টে ১২টি সেঞ্চুরিসহ ৪৩.৯৮ গড়ে তার রান ৩৯১৫. পাকিস্তানের পক্ষে টেস্টে প্রথম জোড়া সেঞ্চুরি। পাকিস্তান থেকে বেরোনো প্রথম ‘গ্রেট' ব্যাটসম্যানও তো তিনি। তারপরও হানিফ মোহাম্মদ নামটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাকি সব কিছু ছাপিয়ে জ্বলজ্বল করে ওঠে দুটি সংখ্যা—৩৩৭ ও ৯৭০। আরেকটি সংখ্যা ৪৯৯-ও মনে হয় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। ১৯৫৭-৫৮ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ব্রিজটাউন টেস্টে ৯৭০ মিনিট ব্যাট করে অবিশ্বাস্যভাবে ম্যাচ বাঁচানো সেই ৩৩৭ এবং এর এক বছর পর ভাওয়ালপুরের বিপক্ষে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে ৪৯৯ রানের রেকর্ড ভাঙা ইনিংস দুটিই হয়ে আছে হানিফ মোহাম্মদের গ্রেটনেসের সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
পাকিস্তান থেকে বেরোনো প্রথম 'গ্রেট' ব্যাটসম্যান বলছিলাম, একদিক থেকে সেটাই হয়েছিল হানিফের কাল, হাতে সব স্ট্রোকই ছিল তাঁর, ক্যারিয়ারের শুরুতে ছিলেন দারুণ আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান, কিন্তু দলের স্বার্থে সব ভুলে শুধু উইকেটে টিকে থাকার দিকেই মন দিতে হয়েছিল তাঁকে। এবং এই টিকে থাকার দিকে মন দিয়েই হানিফ মোহাম্মদ গড়েছেন তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বিখ্যাত কীর্তিটি।
চলবে...