`লিটল মাস্টার` যেন আরও `লিটল`!
উৎপল শুভ্র
১১ আগস্ট ২০২১
তাঁর পরে `লিটল মাস্টার` ডাকা হয়েছে অনেককেই। তবে ক্রিকেটের আদি `লিটল মাস্টার` হানিফ মোহাম্মদই। পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন ঠিক পাঁচ বছর আগে এই দিনে। প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পাকিস্তানি গ্রেটকে নিয়ে উৎপল শুভ্রর নতুন ধারাবাহিক। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের এক সন্ধ্যায় করাচিতে তাঁর বাড়িতে কাটানো এক সন্ধ্যার স্মৃতিচারণা।
‘লিটল মাস্টার’কে এতটা ‘লিটল' দেখাবে এটা ভাবিনি। এর আগে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে দেখেছি, দেখেছি ১৯৯৯ বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের দিন পাকিস্তান দলের নেট প্র্যাকটিসের সময়ও। তখনো দেখে একটু বিস্ময়ই জেগেছে—এই ছোটখাটো লোকটিই ট্রুম্যান-স্ট্যাথাম-গিলক্রিস্টদের ছোড়া আগুনে গোলার সামনে অমন বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন, লড়েছেন অমন বীরত্বের সঙ্গে! ১৬ ঘণ্টা ১০ মিনিট ব্যাট করে হেরে যাওয়া টেস্ট ম্যাচ ড্র করেছেন, পাকিস্তানের পক্ষে টেস্টে প্রথম জোড়া সেঞ্চুরি, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে তাঁর ৪৯৯ রেকর্ড হয়ে ছিল ৩৫ বছর। ২০০১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় তাঁর করাচির ইউনিভার্সিটি রোডের বাড়িতে হানিফ মোহাম্মদকে দেখে সেই বিস্ময়ও ম্লান। হানিফ মোহাম্মদ যেন আরও ছোট হয়ে গেছেন!
পরনে একটা হাওয়াই শার্ট আর প্যান্ট, চোখে সেই পরিচিত চশমা—মিনিট দশেক অপেক্ষার পর যে ভদ্রলোক সামান্য খোঁড়াতে খোড়াতে সামনের সোফায় এসে বসলেন, ড্রেসিংরুমে ঢুকতেই হাসিমুখ যে বিশাল ছবিটি স্বাগত জানিয়েছিল, সেটির সঙ্গে তাঁকে মেলানোই মুশকিল । সেই ছবিটি যৌবনের হানিফ মোহাম্মদের। বলেও ফেললাম কথাটা। হানিফ মোহাম্মদ হাসলেন, 'আই অ্যাম অ্যান ওল্ড ম্যান নাউ।'
তিন মাস পরই ৬৭তম জন্মদিন, সে হিসেবে তো ‘ওল্ড ম্যানই’। নাতি-নাতনির সঙ্গই তখন তাঁর আনন্দের প্রধান উৎস। ছেলে শোয়েব মোহাম্মদের দুই সন্তান শেহজার আর শেহজিনের সঙ্গেই কাটে দিনের বেশির ভাগ সময়। ইন্টারভিউয়ের মাঝখানে ১১ বছর বয়সী শেহজার দুবার এসে বসলও দাদার পাশে। কারণটা শুধুই ছেলেমানুষী কৌতূহল নয়। একদিন যে তাকেও এমন ইন্টারভিউ দিতে হবে, এ নিয়ে যে কোনোই সন্দেহ নেই ওই পুঁচকে ছেলেটির মনে! হেসে উড়িয়ে দেবেন না কথাটা। হানিফ মোহাম্মদের কথাটা শুনে নিন আগে, ‘শেষ পর্যন্ত কী হবে, কে জানে! তবে এখন পর্যন্ত ও যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে বিশ্ব ক্রিকেটের মোহাম্মদ পরিবার থেকে আরেকজন উপহার পাওয়ারই কথা। প্রতিভার ব্যাপারটা পুরোপুরি বোঝা যাবে চার-পাঁচ বছর পর, তবে এটুকু বলতে পারি, আমাদের কেউই ওর মতো এতটা ক্রিকেটের পাগল ছিলাম না।'
বিকেলে তাঁর ইন্টারভিউ চেয়ে যখন টেলিফোন করি, হানিফ মোহাম্মদ তখন শেহজারকে প্র্যাকটিস করাতে নিয়ে যাচ্ছেন। 'ক্রিকেটই ওর ধ্যানজ্ঞান। এত দিন ও পেপসি ক্রিকেট ক্লিনিকে ছিল। এখন তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওর জন্য কাস্টমস স্পোর্টস ক্লাব মাঠে দু-তিন ঘন্টার জন্য সাড়ে তিন শ রুপি দিয়ে নেট ভাড়া করতে হয়'—হানিফ যখন এ কথা বলছেন, শেহজার একটু দূরে দাঁড়িয়ে শ্যাডো প্র্যাকটিস করায় মগ্ন। স্বাভাবিক এটাই। মোহাম্মদ পরিবারের রক্তেই যে ক্রিকেট। পাকিস্তানে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট শুরু হওয়ার পর এই ১৯৯৯ পর্যন্ত মোহাম্মদ পরিবারের কেউ না কেউ ছিলই সার্কিটে।
ওয়াজির মোহাম্মদ (২২), হানিফ মোহাম্মদ (৫৫), মুশতাক মোহাম্মদ (৫৭) এবং সাদিক মোহাম্মদ (৪১) চার ভাই মিলে খেলেছেন মোট ১৭৩টি টেস্ট। পাকিস্তানের পক্ষে করেছেন ১০.৯৩৮ রান এবং ২৯টি সেঞ্চুরি। আরেক ভাই রাইস মোহাম্মদ অল্পের জন্য মিস করেছেন টেস্ট ক্রিকেটের গৌরব, ১৯৫৫ সালে এই ঢাকাতেই ভারতের বিপক্ষে টেস্ট শুরুর আগের দিন অধিনায়ক তাঁকে পরদিন খেলার কথা জানিয়ে দিলেও ম্যাচের দিন সকালে তিনি হয়ে যান দ্বাদশ ব্যক্তি। ১৯৫২ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত পাকিস্তানের খেলা প্রথম ১০১টি টেস্টের মধ্যে মাত্র একটিতেই দলে ছিলেন না মোহাম্মদ ভাইদের কেউ। এসব তথ্য পুরো ক্রিকেট বিশ্বেরই জানা। হানিফ মোহাম্মদ সগর্বে জানালেন, মোহাম্মদ পরিবারের উৎপন্ন ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটারের সংখ্যা ১০।
পাঁচ ভাইয়ের পর হানিফের ছেলে শোয়েব তো টেস্টই খেলেছেন ৪৫টি। রাইসের তিন ছেলে আসিফ, শাহিদ ও তারিক এবং সাদিকের ছেলে ইমরান টেস্ট পর্যন্ত যেতে না পারলেও খেলেছেন ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট। ক্রিকেট ইতিহাসে এক পরিবার থেকে ১০ জন ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটার বেরোনোর আর কোনো উদাহরণ নেই। তেমনি ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে এক ইনিংসে তিন ভাইয়ের সেঞ্চুরি করার একমাত্র উদাহরণটিও মোহাম্মদদেরই গড়া। ১৯৫৪-৫৫ মৌসুমের কায়েদ-ই-আজম ট্রফির ফাইনালে কম্বাইন্ড ইউনিভার্সিটির বিপক্ষে করাচির হয়ে ওয়াজির করেন ১১৮, রাইস ১১০ এবং হানিফ ১০৯।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের কথোপকথনে এই প্রসঙ্গেই প্রথম পেয়েছিলাম হানিফ মোহাম্মদের রসবোধের পরিচয়, ‘আমরা বয়স অনুযায়ী রান করেছিলাম সে ম্যাচে।'
চলবে...