স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০

আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে প্রথম স্বর্ণপদক জয়ী নারী কাজী শাহানা পারভীন

দুলাল মাহমুদ

৮ আগস্ট ২০২১

আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে প্রথম স্বর্ণপদক জয়ী নারী কাজী শাহানা পারভীন

`প্রথম`-এর একটা আলাদা মহিমা সব সময়ই থাকে। শুটার কাজী শাহানা পারভীনের এমনই একটা `প্রথম`-এর গৌরব আছে। বাংলাদেশের প্রথম মেয়ে হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে স্বর্ণপদক জয়। স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০ ধারাবাহিকের এই পর্বে কৃতি এই শুটারের গল্প।

একটা ধাঁধা দিয়েই শুরু করা যাক। আপনাদের কারও কি স্মরণ আছে, দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে কিংবা আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম স্বর্ণপদক জিতেছেন কোন নারী? একটু বোধহয় হিমসিম খেতে হচ্ছে। তাই না? আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে আমাদের যা কিছু সাফল্য, তার বড় একটা অংশ এসেছে শুটিংয়ে। দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে সবচেয়ে বেশি পদক এসেছে লক্ষ্যভেদের এই খেলায়। আর এর অন্যতম ভাগীদার হলেন নারীরা। 

কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাকে খানিকটা বদলে দিয়ে লেখা যেতে পারে, অর্ধেক তার ‘আনিয়াছে’ নারী, অর্ধেক তার নর। অর্ধেক না হলেও তাঁদের কৃতিত্ব কোনো অংশে কম নয়। আর এ ক্ষেত্রে সবার আগে যাঁর নামটি আসে, তিনি হলেন কাজী শাহানা পারভীন। ১৯৯১ সালে শ্রীলঙ্কার কলম্বো সাফ গেমসে শুটিংয়ে স্বর্ণপদক জয় করে বাংলাদেশের মেয়েদের মধ্যে তিনি প্রথম অর্জন করেন এই গৌরব। শুটিং সেবারই প্রথম সাফ গেমসে অন্তর্ভুক্ত হয়।তবে আগের চারটি সাফ গেমসে অন্য কোনও খেলাতেও বাংলাদেশের কোনো মেয়ে স্বর্ণপদক জিততে পারেননি।

পাকিস্তান আমল থেকে পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের নারীরা প্রতিযোগিতামূলক শুটিংয়ে অংশ নিয়ে আসছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আমলে যে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, শাহানা তাঁদের অন্যতম। পারিবারিক সূত্রে বালিকা বয়সেই শুটিংয়ে আগ্রহী হয়েছিলেন। নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাব শুটিংয়ের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত। তিনি ছিলেন এই ক্লাবের সদস্য। এ ক্লাবেই অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তোলেন। 

১৯৭৮ সালে প্রথম বাংলাদেশ অলিম্পিকে নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের হয়ে .২২ ওপেন সাইট রাইফেল ক্যাটাগরিতে বালিকা ও মহিলা দুই বিভাগেই স্বর্ণপদক জয় দিয়ে শুরু হয় তাঁর পথ চলা। এরপর কখনো কখনো লক্ষ্য কিছুটা লক্ষ্যহীন হলেও তিনি কিন্তু তাঁর মূল লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত রৌপ্য আর ব্রোঞ্জ পদকে সীমাবদ্ধ থাকলেও ১৯৮৩ সাল থেকে প্রতি বছর জাতীয় শুটিং প্রতিযোগিতায় এক বা দুটি স্বর্ণপদক পাওয়া তাঁর রুটিনে পরিণত হয়। বেশি সাফল্য পেয়েছেন স্ট্যান্ডার্ড রাইফেল থ্রি এবং .২২ রাইফেল থ্রি পজিশনে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শুটিংয়ে শাহানা ১৯৭৯ সাল থেকে নিয়মিত অংশ নেন। সেবার দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে প্রথম বিশ্ব এয়ার রাইফেল শুটিং প্রতিযোগিতায় তাঁর অভিষেক হয়। ১৯৮৬ সালে সিউলে দশম এশিয়ান গেমসে এবং একই বছর শ্রীলঙ্কার কলম্বোয় বন্ধুত্বপূর্ণ শুটিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। কলম্বোয় মহিলা বিভাগে তিনি চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৯০ সালে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে কমনওয়েলথ গেমস এবং চীনের বেইজিংয়ে এশিয়ান গেমসে অংশ নিয়ে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন, তা কাজে লাগিয়ে ১৯৯১ সালে কলম্বো সাফ গেমসে উজ্জ্বল করেন দেশের মুখ। 

গেমসে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম স্বর্ণপদক জয় করেন তিনি, স্ট্যান্ডার্ড রাইফেল ২০ শটসে। এটি সাফ গেমসে তো বটেই, আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের কোনো নারীর প্রথম স্বর্ণপদক জয়। মেয়েরা স্বর্ণপদক জিততে পারে না বলে যে বক্রোক্তি করা হতো, তিনি ঘুচিয়ে দেন সেই দুর্নাম। তখন তিনি কন্যা সন্তানের জননী। একই গেমসে খালেদা মনসুর ও কাজী ফেরদৌসী পারভীন পলিকে নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড রাইফেল ৩ গুণন ২০ শটসের দলগত ইভেন্টে রৌপ্য এবং এয়ার রাইফেল ৪০ শটসের দলগত ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন।

এই সাফল্য পেয়ে থেমে থাকেননি শাহানা। অলিম্পিক গেমসে তিনি নিজের যোগ্যতা দিয়ে প্রথম অংশ নেওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৯০ সালে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ওয়ার্ল্ড কাপে ন্যূনতম স্কোর গড়েই অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। ওয়াইল্ড কার্ড নিয়ে তিনি ১৯৯২ বার্সেলোনা অলিম্পিকে অংশ নেন। অলিম্পিক গেমসে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের প্রথম নারীও তিনি। 

১৯৯৩ সালে ঢাকা সাফ গেমসেও স্বর্ণপদক পান শাহানা। এবার ফারজানা হোসেন সোমা ও সাবরিনা সুলতানাকে সঙ্গে নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড রাইফেল প্রোন ৬০ শটস টিম ইভেন্টে। এছাড়া এয়ার রাইফেল ৪০ শটস দলগত ইভেন্টে ফারজানা হোসেন সোমা ও ফওজিয়া আজমকে সঙ্গী করে রৌপ্যপদক এবং ফারজানা হোসেন সোমা ও রাজিয়া নওশেদকে নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড রাইফেল ৩ গুণন ২০ শটসের টিম ইভেন্টে আর স্ট্যান্ডার্ড রাইফেল প্রোন ৬০ শটস ইভেন্টে ব্যক্তিগতভাবে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন।

১৯৯৪ সালে জাপানের হিরোশিমা এশিয়ান গেমস এবং মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর কমনওয়েলথ গেমসেও তিনি অংশ নেন। ১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ সাফ গেমসে ফারজানা হোসেন সোমা ও লাভলী চৌধুরী আঁখিকে সঙ্গী করে ৫০ মিটার স্মল বোর স্ট্যান্ডার্ড রাইফেল প্রোনের দলগত ইভেন্ট এবং ফারজানা হোসেন সোমা ও সাবরিনা সুলতানাকে নিয়ে ৫০ মিটার স্মল বোর স্ট্যান্ডার্ড রাইফেল থ্রি পজিশনের দলগত ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন।

শাহানা ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডুতে সাফ গেমসে তৃতীয় স্বর্ণপদক জয় করেন। সাবরিনা সুলতানা ও লাভলী চৌধুরী আঁখিকে নিয়ে ৫০ মিটার স্মল বোর স্পোর্টস রাইফেল প্রোনের দলগত ইভেন্টে এই কৃতিত্ব দেখান। তাছাড়া সাবরিনা সুলতানা ও লাভলী চৌধুরী আঁখিকে নিয়ে ৫০ মিটার স্মল বোর স্পোর্টস রাইফেল প্রোনের দলগত ইভেন্টে এবং ১০ মিটার এয়ার রাইফেল দলগত ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। এখন পর্যন্ত এস এ গেমসে নারীদের মধ্যে সর্বাধিক স্বর্ণপদক তাঁর। 

১৯৯১ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সেরা শুটার এবং ১৯৯৯ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরষ্কার পেয়েছেন। শুটিংয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের নারীদের স্বর্ণপদক জয়ের যে পথ দেখিয়ে দেন শাহানা, তা অনুসরণ করে বাংলাদেশের মেয়েরা শুটিংয়ের পাশাপাশি সাফল্য পাচ্ছেন বিভিন্ন ক্রীড়ায়। 

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×