অহমে লাগা মানেই `সাকিব ভয়ঙ্কর`

উৎপল শুভ্র

৭ আগস্ট ২০২১

অহমে লাগা মানেই `সাকিব ভয়ঙ্কর`

কার্ডিফ রূপকথার দ্বিতীয় অধ্যায়টা মনে আছে তো? ওই যে ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে মাহমুদউল্লাহ আর সাকিবের সেঞ্চুরিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য সেই জয়। অথচ সেই ম্যাচের আগে সাকিবকে বাদ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন বোর্ড সভাপতি। কোচ হাথুরুসিংহে ও অধিনায়ক মাশরাফি এক জোট হয়ে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় সাকিব বেঁচে যান। এরপর যা করেন, তা তো ইতিহাস! সাকিবকে নিয়ে উৎপল শুভ্রর ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্ব।

মনেপ্রাণে কিছু চাইলে বা অহমে লাগলে সাকিব কী করতে পারেন, সেটির আরেকটি উদাহরণ দিতে ওই ২০১৭ সালেরই কয়েক মাস পিছিয়ে যাই। ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে প্রথম দুই ম্যাচে সাকিব একেবারেই বিবর্ণ। ইংল্যান্ডের সঙ্গে ১০ রান করার পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২৯। প্রথম ম্যাচে এমন বোলিং (৮ ওভারে ৬২) করেছেন যে বৃষ্টিতে পণ্ড হয়ে যাওয়ার আগে অস্ট্রেলিয়ার ১৬ ওভারের ইনিংসে তাঁকে বলই দেওয়া হয়নি। ইংল্যান্ডে উপস্থিত বোর্ড কর্মকর্তাদের মধ্যে চাপা ফিসফিসানি। বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান সেই ফিসফিসানিকে সিদ্ধান্তে রূপ দিয়ে কার্ডিফ রওনা হওয়ার আগে ঢাকা থেকেই জানিয়ে দিলেন, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সাকিবকে বাদ দিতে হবে। ফিট সাকিবকে ছাড়া বাংলাদেশের ওয়ানডে দল! এমন কিছু এর আগে কখনো হয়নি। কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের তিন বছরের শাসনামলে' তাঁর সঙ্গে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার অনেক মতই মেলেনি। গুরুত্বপূর্ণ যে কবার মিলেছে, এটি তার একটি।

ঢাকা থেকে মেসেজ পাওয়ার পর হাথুরুসিংহে নিজেই মাশরাফির রুমে গিয়ে বললেন, 'ম্যাশ, বোর্ড প্রেসিডেন্ট এটা কী বলছেন! সাকিবকে কীভাবে বাদ দেওয়া সম্ভব!’

মাশরাফি বললেন, 'আমিও শুনেছি। শোনার পরই তোমার সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছিলাম। এটা কোনো কথা হলো!'

হাথুরুসিংহে একটু আশ্বস্ত হলেন, ‘বোর্ড প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমি কথা বলব। আমার কথা না মানলে আমি রিজাইন করব। তুমি আমাকে সাপোর্ট করবে তো?'

মাশরাফি বললেন, 'করব না মানে? সাকিবকে বাদ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।' কোচ-অধিনায়ক একজোট হওয়ায় সাকিব দলে টিকে গেলেন। এরপর যা করলেন, সেটি তো ইতিহাসের পাতাতেই লেখা। ২০০৫ সালে মোহাম্মদ আশরাফুলের ব্যাটে অস্ট্রেলিয়া-বধ যদি কার্ডিফ-রূপকথার প্রথম অধ্যায় হয়, দ্বিতীয় অধ্যায়টা লেখা হলো সাকিব আর মাহমুদউল্লাহর ব্যাটে। ৩৩ রানে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ২২৪ রানের জুটিতে যে জয়টি এল, সেটি বাংলাদেশের স্মরণীয় জয়ের তালিকায় একেবারে ওপরের দিকে থাকবে। সেঞ্চুরির পর মাহমুদউল্লাহর উদযাপনটাও তাঁর ব্যাটিংয়ের মতোই দর্শনীয় হলো। অথচ অ্যাডাম মিলনেকে ছক্কা মেরে সেঞ্চুরি করার পরও সাকিব একেবারেই নিরুত্তাপ। ম্যাচের আগের ওই নাটক তো আর তাঁর অজানা ছিল না। দলের জয় নিশ্চিত হয়ে গেছে বলেই রাগটা আরও ভালোভাবে ঝাড়তে পারলেন। পরের ওভারের প্রথম দুই বলেই চার। তৃতীয় বলেও মারতে গিয়ে বোল্টের বলে বোল্ড। আউট হওয়ার আগে ১১৪ বলে ১১৪। আউট হওয়ার পর ১১৫ বলে ১১৪ হয়ে যাওয়ায় ‘ক্ষতি' বলতে স্ট্রাইক রেটটা ঠিক ১০০ থাকার বদলে দশমিক ৮৭ কমে গেল, এই যা!

দলে থাকবেন না সাকিব থেকে রূপকথা! ছবি: এএফপি

সর্বশেষ উদাহরণটি বেশি দিন আগের নয়। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সিলেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টিটিতে জঘন্য ব্যাটিং করে হেরেছে বাংলাদেশ। অধিনায়ক হিসেবে সাকিবের ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। পুরস্কার বিতরণীতে ব্যাটিং নিয়ে প্রশ্নে ব্যাটসম্যানদের একটু হলেও সমালোচনা করতেই হতো। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে সেটি এমন রংচং চড়িয়ে পরিবেশিত হলো। যে সাকিব মহা খেপে গেলেন। সর্বনাশটা হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের। মিরপুরে মোটামুটি হাই স্কোরিং দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে এমন বোলিং করলেন যে সাকিবের আর্মারগুলো শক্তিশেল হয়ে বিধল ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যানদের বুকে। টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো ৫ উইকেট। সেটিও মাত্র ২০ রানে। এর আগে ব্যাটিংয়ে ২৬ বলে অপরাজিত ৪৬। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো পুড়ল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়, রাগ-ক্ষোভের আসল লক্ষ্যবস্তু সামনে পেলেন সংবাদ সম্মেলনে। যথারীতি সব উগরে দিলেন।

শেষ অংশটাকে সাকিবের দোষ বলতে পারেন, আবার গুণও। সাকিবের জায়গায় মাশরাফি হলে অবশ্যই সংবাদ সম্মেলনে পাল্টা আক্রমণ করে মিডিয়াকে 'শত্রু' বানানোর ঝুঁকি নিতেন না। সাকিব অবশ্যই তা নেবেন, এ কারণেই তিনি সাকিব। ভালো না মন্দ—এই বিচার আপনি করুন, কিন্তু সাকিব মনের কথা বলে দেওয়ায় বিশ্বাসী। তাঁকে দিয়ে আর যা-ই হোক, কূটনীতিকের চাকরি হবে বলে মনে হয় না। অতীতে সাকিবকে নিয়ে এত বিতর্কের মূল কারণও ছিল এটিই। মাশরাফির বিদায়ের পর টেস্ট ও টি-টোয়েন্টির সঙ্গে ওয়ানডেরও অধিনায়কত্ব পাওয়াটা প্রায় নিশ্চিতই বলা যায়। ধারণা করি, তখন সাংবাদিকদের অন্তত লেখার বিষয়ের অভাব হবে না। সাকিব নিয়মিতই তা সরবরাহ করবেন।

এসব নিয়ে পরে কখনো অনুতাপ করেছেন বলে শোনা যায়নি। ২০১৪ সালে তাঁর ওপর নেমে আসা ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞার সময়টাতে শুধু ওই একবারই একটু ভেঙে পড়তে দেখেছি। যেটিকে এখন 'শাপে বর' বলে স্বীকার করেন। কিন্তু এটা করলে বা ওটা না করলেই তা এড়ানো যেত ভেবে অনুতাপ হয় কি না প্রশ্নের জবাবে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে দেন, ‘নো রিগ্রেটস্। জীবনে কোনো কিছু নিয়েই আমি রিগ্রেট করি না।'

দ্বিতীয় দফায় ক্যাপ্টেনসি পেয়েই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেই সিরিজ। ছবি: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

আসলেই যে করেন না, সেটির প্রমাণও অনেকবারই পেয়েছি। ২০১১ সালে জিম্বাবুয়ে সফরের পর শুধু বিতর্কিতই নয়, খুবই অন্যায়ভাবে তাঁর অধিনায়কত্ব কেড়ে নেওয়া হলো। এর আগে যে দুবার অধিনায়কত্ব করেছেন, দুবারই ঘটনাচক্রে এবং দুবারই যা পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বর্ণালি অধ্যায়ে। প্রথমবার, ২০০৯ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সাকিব ২২ বছরের বাচ্চা একটা ছেলে। খেলতে নেমেছেন মাত্র ১৪তম টেস্ট। মাশরাফি চোট পেয়ে ছিটকে পড়ার পর সেই সাকিবের কাঁধেই নেতৃত্বের ভার। প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের জোড়াতালি দিয়ে গড়া এক দল। চাপটা যা আরও বাড়িয়ে দিল। পূর্ণ শক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তখন হারাটাই হতো স্বাভাবিক ফল। কিন্তু ওই গোলেমালে সিরিজটা হয়ে গেল ফুটবলে পেনাল্টি মারার মতো। গোল করলে কেউ মনেও রাখবে না, না করতে পারলেই ভিলেন। ব্যাটে-বলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েই জয় করলেন সেই চাপ। গ্রেনাডায় ছক্কা মেরে সাকিব দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট সিরিজ জেতানোর পর লিখেছিলাম, অমন তালেগোলে অধিনায়কত্ব পাওয়া নায়ক ছক্কা মেরে টেস্ট সিরিজ জেতাচ্ছেন—কোনো ঔপন্যাসিক এমন লিখলে পাঠক তাঁকে বড্ড বেশি কল্পনাপ্রবণতার দায়ে অভিযুক্ত করবে। টেস্টের পর ওয়ানডেতেও দুর্বার সাকিব সেই সিরিজের স্পনসর টেলিযোগাযোগ সংস্থা ডিজিসেলের সৌজন্যে ম্যান অব দ্য ম্যাচ, ম্যান অব দ্য সিরিজ—সবকিছুর পুরস্কারই ব্ল্যাকবেরি মোবাইল সেট। সাকিব সেটি একের পর এক এমন জিততে শুরু করলেন যে চাইলে দেশে ফিরে ব্ল্যাকবেরির একটা দোকান দিয়ে দিতে পারতেন!

দ্বিতীয় দফায় ক্যাপ্টেনসিও 'বাই ডিফল্ট'। ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক 'বাংলাওয়াশ'-এর সিরিজ। আবারও সিরিজের প্রথম ম্যাচেই মাশরাফির চোট, আবারও ম্যাচের মাঝখানে সাকিব হঠাৎই অধিনায়ক । সেই সিরিজে এমনই খেলেছিলেন যে ফলাফল হিসেবে অনায়াসে লেখা যেত: সাকিব আল হাসান ৪: নিউজিল্যান্ড ০!

চলবে...

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×