সাকিব শুধু মনেপ্রাণে চাইলেই হয়

উৎপল শুভ্র

৬ আগস্ট ২০২১

সাকিব শুধু মনেপ্রাণে চাইলেই হয়

সাকিব আল হাসানের আন্তর্জাতিক অভিষেকের পনের বছর পূর্তিতে `চেনা সাকিব অচেনা সাকিব` লিখতে গিয়ে মনে হলো, `এগারো` বইয়ে সেটাই লিখেছি। সেটি তুলে দিলেই তো হয়। লেখাটা যেহেতু বড়, ধারাবাহিকভাবেই না হয় প্রকাশিত হবে। পাঁচ পর্বের ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব আজ।

সাকিব আল হাসান একজন অতিমানব। ক্রিকেট মাঠে যা চান, তা-ই করতে পারেন। কখন তা চাইবেন, সেটিই হলো প্রশ্ন। নাটকীয় নয়, মহানাটকীয় শোনাচ্ছে। অতিশয়োক্তির চূড়ান্ত বললেও যেনকম বলা হয়! সাকিব সুপারম্যান নাকি!

বাংলাদেশ দলে তাঁর টিমমেটদের প্রশ্ন করুন, সবাই কিন্তু এমনই বলবেন। এই মতবাদের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা তামিম ইকবাল। সেই অনূর্ধ্ব-১৫ দল থেকে দুজন একসঙ্গে খেলছেন। সাকিবের নাড়িনক্ষত্র তাঁর চেনা। তারপরও সাকিবকে নিয়ে তাঁর বিস্ময় কাটে না। বরং উত্তরোত্তর তা যেন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ দলের ‘পঞ্চপাণ্ডব' নামে পরিচিতি পেয়ে যাওয়া পাঁচজনের বাকি চারজনকে নিয়ে বলতে গিয়ে আবারও যা প্রকাশ পেল। সাকিবকে নিয়েই সবচেয়ে কম বললেন। বলতে বলতে আর নতুন কিছু বলার খুঁজে পাচ্ছেন না বলেই হয়তো। সাকিবকে নিয়ে বলার ভারটা তাই সাকিবের ওপরই দিয়ে দিলেন। প্রশ্নটা আমি করেছি বলে আমাকেই মাধ্যম বানালেন, 'মিস্টার সাকিব আল হাসানের কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে, মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশের হয়ে যা করে, তাতে ও নিজেই বিস্মিত হয় কি না। আপনার মাধ্যমেই প্রশ্নটা ওকে করে রাখলাম।'

পরের দিন সকালেই সাকিবের সঙ্গে দেখা। তামিম যে দায়িত্বটা দিয়েছেন, তা পালন করা উচিত। প্রশ্নটা তাই করলাম। সেটি ২০১৮ সালের ডিসেম্বর। সিলেটে পরদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ওয়ানডে। সাকিব প্র্যাকটিসে যাবেন। ব্রেকফাস্ট রুমে আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। বাস ছাড়তে মাত্র মিনিট তিনেক বাকি। কোনোমতে মুখে কিছু গুঁজে দিয়ে লিফটের দিকে দৌড় দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এর মধ্যেই আমার ওই প্রশ্ন। মন দিয়ে যা শুনে দুষ্টুমি-মাখানো একটা হাসি দিলেন। আর কিছু বললেন না দেখে বুঝে ফেললাম, ওই হাসিতেই উত্তর দেওয়া গেছে। তাঁর ইকোনমিক্যাল বোলিংয়ের মতোই প্রতিক্রিয়াতেও অনেক সময় সাকিব খুব ‘ইকোনমিক্যাল'। মুখে কিছু না বলার আরেকটা কারণ হতে পারে, একটু ঘুরিয়ে এই প্রশ্নের উত্তরটা যে তিনি আমাকে অনেক আগেই দিয়েছেন।

সাকিব চাইলেই সব হয়, এই বিশ্বাসের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা তামিম ইকবাল। ছবি: মো. মানিক

সেটি ২০১২ সালের কথা। চার বছরের মধ্যে তৃতীয়বার সাকিবের হাতে উঠেছে প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারের বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদের ট্রফি। তাঁকে নিয়ে বাড়তি কী করা যায়, ভাবতে ভাবতে মাথায় একটা আইডিয়া এলো। কদিন পরই মাগুরা যাচ্ছেন, তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে মাগুরার সাকিবকে দেখে তা নিয়ে একটা স্টোরি করলে কেমন হয়!

সাকিব বলতেই রাজি ৷ যদিও ‘মাগুরায় গিয়ে কী হবে! বাড়িতে গিয়ে আমি তো শুধু ঘুমাব' কথাটাকে ছুটির মধ্যে উটকো ঝামেলা এড়ানোর চেষ্টা বলে ক্ষীণ সন্দেহ হয়েছিল। মাগুরায় যাওয়ার পর যেটি দূর হতে সময় লাগেনি । ঢাকা থেকে একই ফ্লাইটে যশোর, সেখান থেকে সাকিবের গাড়িতেই মাগুরা যাওয়ার পথেই আসলে সেটির অবসান। ঘুমের সঙ্গে আপস করে অনেক সময় দিলেন। ঘুরিয়ে দেখালেন তাঁর শৈশব-কৈশোরের লীলাভূমি। বাড়ির পেছনে খেলার সেই আঙিনা, স্কুল, মাগুরা স্টেডিয়াম, নানিবাড়ি, আলোকদিয়ার সেই মাঠ, যেখানে টেনিস বলের এক ম্যাচ খেলতে গিয়ে তাঁর জীবন বদলে যাওয়ার শুরু।

'বেশি চাপ থাকলে আরও বেশি মজা লাগে। আর মাঠে নামলেই কীভাবে যেন আমার মাথা খুলে যায়। কীভাবে যেন সব ঠিকঠাক করে ফেলি।'

এখন যা সবারই জানা, সেই গল্পটাও ওই মাঠে দাড়িয়েই শোনা। সাকিবের খেলা দেখে সেই ম্যাচের এক আম্পায়ার সাদ্দাম হোসেন গোর্কির নিজের ক্লাবে খেলার আমন্ত্রণ জানানো, সে সময় পেস বোলার সাকিবকে প্র্যাকটিসের দ্বিতীয় দিনই শখের স্পিন করতে দেখে বলা ‘তুই স্পিন বোলিংই কর', কদিন পরই স্থানীয় লিগে ম্যাচ খেলতে নেমে প্রথম বলেই উইকেট। সাকিব এর আগে ক্রিকেট যা খেলেছেন, সবই টেপ টেনিসে, যার মানে ওই উইকেটটা ক্রিকেট বলে করা প্রথম বলেই। এমন গল্প হয়তো আরও অনেকেরই আছে। সাকিব সাকিব হয়েছেন বলেই এটি পেয়ে যাচ্ছে আলাদা তাৎপর্য। প্রমাণিত হয়ে উঠেছে 'প্রভাত দিনের সঠিক পূর্বাভাস দেয়' প্রবাদেরও।

মাগুরার সাকিবকে নিয়ে বাড়তি লেখাটার মালমসলা জোগাড় করা শেষ। পরদিন ঢাকায় ফিরে আসব । বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদের রুটিন বড় সাক্ষাৎকারটা নিতে হবে। রাতে যেটি নিলাম মাগুরায় আমার দুই দিনের ঠিকানা সার্কিট হাউসে বসে। সেই সাক্ষাৎকারেই প্রচণ্ড চাপেও মাঠে অমন নির্ভার থাকার ক্ষমতাটা নিয়ে সাকিব বলেছিলেন, 'বেশি চাপ থাকলে আরও বেশি মজা লাগে। আর মাঠে নামলেই কীভাবে যেন আমার মাথা খুলে যায়। কীভাবে যেন সব ঠিকঠাক করে ফেলি।'

 মাগুরায় সাকিবের সঙ্গে। আমি অবশ্য ছবির ফ্রেমের বাইরেই ছিলাম। ছবি: শামসুল হক

সব সময় তো আর পারেন না। তখন সবাই ধরে নেয়, সাকিব মনেপ্রাণে বোধ হয় করতে চাননি। সাকিবকে নিয়ে এমনই একটা অবিশ্বাস্য 'মিথ' দাঁড়িয়ে গেছে। তাঁর কাছে ইচ্ছাদেবীর টেলিফোন নম্বর আছে। তাঁকে ফোন করে নিজের চাওয়াটা জানালেই শুধু হয়। এরপর সেটি হবেই হবে। তামিমের দুঃখ, সাকিব 'ফোন'টা কেন সব সময় করেন না!

২০১৭ সালের আগস্টে বলতে গেলে একাই হারিয়ে দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়াকে। প্রথম ইনিংসে ৮৪ রানের পর দুই ইনিংসেই পাঁচ-পাঁচ দশ উইকেটের ছটায় প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে তামিমের দুটি দুর্দান্ত ইনিংস। কোথায় তামিমের দুঃখ হবে, উল্টো ওই টেস্টের পর প্রশংসায় ভাসিয়ে দিলেন সাকিবকে। দুঃখ মনে বাসা বাধার সুযোগ পেলে তো, তিনি যে তখন সাকিবে আরও বিস্ময়াভূত, 'সাকিব যেদিন চায়, সেদিন ও অদম্য। ও যদি নিয়মিত এমন চায়, তাহলে এমন সব পারফরম্যান্স করতে পারবে, যা বিশ্বে কেউ দেখেনি।'

আমার চোখেমুখে প্রশ্ন ফুটে উঠতে দেখে যোগ করলেন, 'জানি, আমি অনেক বড় কথা বলছি। কিন্তু আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, ও মন থেকে চাইলে নিজেকে আরও ওপরে নিয়ে যেতে পারে। সঙ্গে বাংলাদেশকেও নিয়ে যেতে পারে সেখানে। এমন প্লেয়ার আমি আর দেখিনি।' সাকিবকে আবারও ধরলাম। তামিম যে বললেন, আপনি চাইলেই আরও অনেক কিছু করতে পারেন, করেন না কেন? সাকিব আবারও সেই হাসিটা দিলেন, 'প্রতিদিন অমন খেলা যায় নাকি! ভেতর থেকে কি প্রতিদিন আসে!'

যেদিন মনেপ্রাণে চান, সেদিন কী করতে পারেন, সেই উদাহরণ দিতে গেলে এই লেখায় কুলোবে না। কয়েকটা অন্তত বলি। মিরপুরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওই টেস্টটাতে এমনিতেই একটু বাড়তি প্রেরণা ছিল। সাত মাস আগে-পরে টেস্ট অভিষেক হওয়ার পরও কীভাবে যেন মিলে গেছে দুই বন্ধু সাকিব-তামিমের ৫০তম টেস্ট। শততম টেস্ট নিয়ে তা-ও একটু কথাবার্তা হয়, ৫০তম টেস্ট কোন দিক দিয়ে এসে কোন দিক দিয়ে চলে যায়, অনেক সময় ক্রিকেটারের নিজেরও সেভাবে খেয়াল থাকে না। কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে সাকিব-তামিমের ৫০তম টেস্ট নিয়ে মহা হইচই । সেই টেস্টের তিন দিনের খেলা হয়ে যাওয়ার পর দুই দলই প্রায় সমানে সমান। পরের দিনই খেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে নিশ্চিত, জিততে হলে অস্ট্রেলিয়ার চাই ১৫৬ রান, বাংলাদেশের ৮ উইকেট। দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যানের নাম ডেভিড ওয়ার্নার ও স্টিভ স্মিথ বলে অস্ট্রেলিয়াই বোধ হয় একটু এগিয়ে।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সাকিব যেদিন চেয়েছিলেন। ছবি: গেটি ইমেজেস

সেই রাতে সাকিবের স্ত্রী শিশির কী ভেবে যে তাঁকে কালকের ম্যাচটা জিতিয়ে দাও না' বলেছিলেন, কে জানে! সাকিব বউকে খুব ভালোবাসেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কথা রাখবেন বলে 'সিদ্ধান্ত' নিলেন। শিশিরের কথাটা পরে প্রকাশিত হয়েছে। তবে পরদিন তাঁকে মাঠে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, এটা সেই দিন, যেদিন সাকিব যা চাইবেন, তাই-ই হবে। এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরিয়ে দিলেন পথের দুই কাঁটা ওয়ার্নার ও স্মিথকে। লাঞ্চের পর প্রথম বলেই ইনিংসে ৫ উইকেট হয়ে গেল। সাকিবের বোলিং ফিগার তখন ২১-৫-৬৮-৫। শুধু সেই সকালের হিসাবটা আলাদা করে করলে টানা ১৩ ওভারে ৪০ রানে ৪ উইকেট। তিন ওভার পর কামিন্সের ক্যাচটা না পড়লে সাকিবের ৬ উইকেট হয়ে যায়। বাংলাদেশের জয়টাও ২০ রানের চেয়ে অনেক বড় হয়।

তারপরও যা হয়েছিল, সেটিই সাকিবকে বসিয়ে দেয় স্যার রিচার্ড হ্যাডলির পাশে। দ্বিতীয়বারের মতো সাকিবের একই টেস্টে পঞ্চাশোর্ধ্ব রান আর দুই ইনিংসেই ৫ উইকেট। এর আগে শুধু হ্যাডলিই যা করতে পেরেছেন। একই টেস্টে ফিফটি আর ১০ উইকেটের কীর্তিতেও শুধু হ্যাডলিই এগিয়ে (হ্যাডলি ৩ বার, সাকিব ২ বার)। পরের বছর আরেকটি অলরাউন্ড কীর্তিতে টেনে আনলেন ইয়ান বোথামকে। তিন হাজার রান আর ২০০ উইকেটের দ্রুততম 'ডাবল'-এর নতুন রেকর্ড গড়লেন বোথামকে পেছনে ফেলেই। এই হ্যাডলি বোথাম নামগুলো আপনার জানা না থাকার কোনো কারণ নেই। তারপরও বিশেষভাবে মনে রাখতে বলি। কারণ, সাকিবগাথায় তাঁরা আবার আসবেন। ও হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওই ম্যাচে রেকর্ড আরেকটাও হয়েছিল। সব টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে ৫ উইকেট। এর আগে যা ছিল শুধু তিনজনের। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট খেলতে দশ বছর অপেক্ষা করতে না হলে তাঁদের আগেই হয়তো সাকিবের তা হয়ে যেত। কারণ, যা করতে মুত্তিয়া মুরালিধরনের ৬৬ টেস্ট লেগেছে, ডেল স্টেইন ও রঙ্গনা হেরাথের ৭৫ টেস্ট; সাকিব তা করে ফেললেন ৫০ টেস্টেই।

চলবে...

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×