স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০
শুটিংয়ে আন্তর্জাতিক পদক জয়ের পথিকৃৎ আতিক-সাত্তার
দুলাল মাহমুদ
১ আগস্ট ২০২১
শুটিং বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক পদক পাওয়ার সবচেয়ে বড় বাহন। শুটিংকে এমন পদকপ্রসবা করে তোলার পথিকৃৎ মানতে হবে আতিকুর রহমান ও আবদুস সাত্তার নিনিকে। ১৯৯০ সালে অকল্যান্ড কমনওয়েলথ গেমসে এই জুটির সোনা জয় আলোড়ন তুলেছিল বাংলাদেশের নিস্তরঙ্গ ক্রীড়াঙ্গনে। এই বিশেষ ধারাবাহিকে আজ তাঁদের সেই কীর্তিগাথা।
আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থানটা আজও সুদৃঢ় হতে পারেনি। একটা সময় দক্ষিণ এশিয়া পর্যায়ে পদক পাওয়াটাই ছিল বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের কাছে সাফল্যের মাপকাঠি। অবশ্য এখনও এই গেমসে পদক পাওয়াটাও মোটেও সুলভ হয়ে ওঠেনি। আর এশিয়ান পর্যায়ে পদক পাওয়াটা হয়ে উঠেছে দুর্লভ। সেই কবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বক্সার মোশারফ হোসেনের কৃতিত্বে সবেধন নীলমণি একটি ব্রোঞ্জ পদক জুটেছে। এরপর কাবাডি আর ক্রিকেটে পাওয়া গেলেও এশিয়ান গেমসে এখনও পদক পেতে হলে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকতে হয়। এর বাইরে বড় মাপের আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিযোগিতায় পদক যে পাওয়া যেতে পারে, একটা সময় বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা কল্পনাও করতে পারতেন না। না পারারই কথা। সত্তর ও আশির দশকে স্বপ্নের পরিধিটা খুব বেশি বিস্তৃত ছিল না। তবে স্বপ্ন থাকলে যে সম্ভাবনা থাকে, সেটা প্রমাণ করেছিলেন দুজন শুটার।
স্বপ্নটাকে অনেকটা দূর এগিয়ে নিয়ে যান শুটার আতিকুর রহমান এবং আবদুস সাত্তার নিনি। অলিম্পিকের পরে বড় আসর হিসেবে বিবেচিত কমনওয়েলথ গেমসে পদক জয় করে নিস্তরঙ্গ ক্রীড়াঙ্গনে ঢেউ তুলেছিলেন তাঁরা দুজন। সত্যি বলতে কি তখনকার প্রেক্ষাপটে এই গেমসে পদক জয় কেউ আশাই করেনি। যদিও ১৯৯০ সালে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে কমনওয়েলথ গেমসে অংশ নিতে যাওয়ার আগে এই দুই শুটার পদক জয়ের প্রতিশ্রুতিই দিয়ে গিয়েছিলেন। তবে এটাকে মনে হয় না কেউ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিল। কীভাবে নেবে? প্রথমত, বাংলাদেশ শুটিং দলের গেমসে অংশ নেওয়ার কথাই ছিল না। আর্থিক কারণে তাদের আবেদন পত্রপাঠ নাকচ করে দেয় বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন। শুটারদের উদ্যোগে বিদেশি একটি এয়ারলাইন্স এগিয়ে আসায় শেষ পর্যন্ত তাঁদের পক্ষে অংশ নেওয়া সম্ভব হয়। মুফতে সুযোগ পাওয়া এমন একটা দলকে নিয়ে কতটা আর আশাবাদী হওয়া যায়? দ্বিতীয়ত, বিদেশে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার আগে সবাই সাধারণত পদক জয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যেতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফিরে আসতেন শূন্য হাতে। আর সার্বিক অবস্থায় কমনওয়েলথ গেমসের মতো আসরে পদক জয়ের সম্ভাবনা বলতে গেলে ছিলই না। কিন্তু এই দুই শুটার যে ফাঁকা আওয়াজ করেননি, সেটা তাঁরা পদক জয় করে বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন। আসলে বুকের মধ্যে যদি থাকে দৃঢ়প্রত্যয়, তাহলে জয় একদিন না একদিন হয়ই।
সেটা ছিল বলেই অভাবিত, অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয় ঘটনার জন্ম দেন এই দুই শুটার। আর এর সূত্রপাত ঘটান ব্রোঞ্জ পদক জয় করে। ২৫ জানুয়ারি ফ্রি পিস্তল পেয়ার্সে সাত্তার ৫৪২ ও আতিক ৫৩৬ স্কোর করলে মোট সংগ্রহ দাঁড়ায় ১০৭৮। এই স্কোরেই কমনওয়েলথ গেমসে দেশের পক্ষে প্রথম পদক নিশ্চিত হয়। অথচ এটা তাঁদের ইভেন্ট ছিল না। তাই পদক পাওয়ার কোনো আশাই ছিল না। এই পদক পেয়ে দুই শুটারের মনোবল অনেকখানি বেড়ে যায়। তাই বলে পরের দিনই স্বর্ণপদক জয়! বলতে পারেন অসম্ভবকেই সম্ভব করেছিলেন তাঁরা।
২৬ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মতো দেশকে টপকে ১০ মিটার এয়ার পিস্তল পেয়ার্সে স্বর্ণপদক জয়ের অনন্য গৌরব অর্জন করেন আতিক-সাত্তার। সে জন্য হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করতে হয় তাঁদের। বাংলাদেশের দুই শুটারের মতো অস্ট্রেলিয়ার দুই শুটারও ১১৩৮ স্কোর করেছিলেন। আতিকের স্কোর ছিল ৫৭৩ আর সাত্তারের ৫৬৫। কিন্তু শেষ দশটি শুটে এগিয়ে থাকায় বাজিমাত করে বাংলাদেশ। এটি ছিল তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। আতিক-সাত্তারের দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে পরবর্তীকালে শুটিংয়ে আরও সাফল্য এসেছে। তবে পথিকৃৎ হিসেবে চির স্মরণীয়ই হয়ে থাকবেন এই দুজন।
মজার ব্যাপার, এই দুই শুটারের পদক বিতরণের আয়োজন করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে যান আয়োজকরা। স্বর্ণপদক তো দূরে থাক, বাংলাদেশ যে পদক পেতে পারে, এটা তাঁরা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি। যে কারণে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ম্যানেজ করতে গিয়ে তাঁরা রীতিমতো হিমসিম খেয়ে যান। বাংলাদেশের মানুষই যেখানে বিশ্বাস করতে পারেননি, সেখানে আয়োজকদের প্রস্তুতি না থাকলে তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না।
এর আগে এই দুই শুটার দেশের মানুষের কাছে খুব বেশি পরিচিত ছিলেন না। জাতীয় পর্যায়ে কৃতিত্ব দেখালেও কজনই বা তার খবর রাখত! সেই অর্থে শুটিং এ দেশে খুব বেশি পরিচিত খেলাও ছিল না। নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে ব্যয়বহুল খেলাটি নিয়ে ক্রীড়ানুরাগীদের খুব একটা আগ্রহ দেখা যায়নি। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, শুটিংকে সাধারণ্যে পরিচিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন আতিক-সাত্তার। কমনওয়েলথ গেমসে স্বর্ণপদক পাওয়ায় শুটিং নিয়ে ব্যাপক কৌতূহলের সঞ্চার হয়। তারপর থেকে শুটিংয়ের চর্চা বেড়ে যায়। পর্যায়ক্রমে আসতে থাকে সাফল্য। সাফল্যের জন্য হাতেগোনা যে কয়েকটি খেলার দিকে এখন মুখিয়ে থাকতে হয়, শুটিং তার অন্যতম।
কমনওয়েলথ গেমস দিয়ে দেশবাসীর কাছে অবিভাজ্য হয়ে ওঠেন আতিক-সাত্তার। তখন শুটিং বললেই এই দুটি নাম পাশাপাশি চলে আসত। এস এ গেমসেও সাফল্য পান এই যুগল। অবশ্য এ ক্ষেত্রে সাত্তারকে ছাড়িয়ে যান আতিক। ১৯৯১ সালে কলম্বোয় এয়ার পিস্তল ৬০ শটস একক এবং দলগত ইভেন্টে স্বর্ণপদক জয় করেন আতিক। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আসিফ হোসেন ও হায়দার আলী। আতিক ১৯৯৩ সালে ঢাকায় এয়ার পিস্তল ৬০ শটস একক এবং দলগত ইভেন্টে স্বর্ণপদক জয় করেন। দলগত ইভেন্টে সঙ্গে ছিলেন আসিফ হোসেন ও আবদুস সাত্তার নিনি। আতিক ব্রোঞ্জ পান ফ্রি পিস্তল ৬০ শটসে। র্যাপিড ফায়ার পিস্তলের ৬০ শটস দলগত ইভেন্টে রৌপ্যপদক পান সাত্তার। তাঁর সঙ্গে ছিলেন নজরুল ইসলাম রুবেল ও আসিফ হোসেন। ১৯৯৫ সালে ভারতের মাদ্রাজে ফ্রি পিস্তল টিম ইভেন্টে পান ব্রোঞ্জপদক আতিক। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তৌফিকুর রহমান ও নজরুল ইসলাম। আতিক ও সাত্তার ১৯৯০ সালে চীনের বেইজিংয়ের এশিয়ান গেমসে অংশ নেন। ১৯৯৪ সালে জাপানের হিরোশিমা এশিয়ান গেমসে অংশ নেন আতিক।
আশির দশকের শুরুতে প্রায় কাছাকাছি সময় জাতীয় পর্যায়ে উঠে আসেন এই দুই শুটার। ১৯৮২ সালে তৃতীয় জাতীয় শুটিং প্রতিযোগিতায় কুমিল্লা রাইফেল ক্লাবের হয়ে বালক বিভাগে ওপেন সাইট এয়ার রাইফেল ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক দিয়ে শুরু হয় আতিকের যাত্রা। ধীরে ধীরে নিজেকে গড়ে তোলেন তিনি। ১৯৮৬ সালে জাতীয় শুটিং প্রতিযোগিতায় .২২ স্ট্যান্ডার্ড রাইফেল ৩ পজিশন, ১৯৮৭ সালে .১৭৭ ম্যাচ এয়ার রাইফেলে স্বর্ণপদক এবং .১৭৭ ম্যাচ এয়ার পিস্তল ও স্টান্ডার্ড রাইফেল ৩ পজিশনে রৌপ্যপদক পান। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ গেমসে এয়ার পিস্তল ইভেন্টে পেয়েছেন রৌপ্যপদক। ১৯৮৯ সালে পেয়েছেন ৫০ মিটার ফ্রি পিস্তলে স্বর্ণ ও ১৭৭ ম্যাচ এয়ার পিস্তলে ব্রোঞ্জ পদক। ১৯৯২, ১৯৯৩, ১৯৯৪, ২০০৭, ২০০৮ সালে এয়ার পিস্তল, ফ্রি পিস্তল, স্ট্যান্ডার্ড রাইফেল থ্রি পজিশনে একক ও যৌথভাবে স্বর্ণ ও রৌপ্যপদক জয় করেন।
আর ১৯৮৫ সালে জাতীয় শুটিং প্রতিযোগিতায় গুলশান শুটিং ক্লাবের হয়ে .১৭৭ ম্যাচ এয়ার রাইফেলে স্বর্ণ ও র্যাপিড ফায়ার পিস্তলে ব্রোঞ্জ পদক জয় করে নিজের দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন সাত্তার। ১৯৮৬ সালে র্যাপিড ফায়ার পিস্তলে স্বর্ণপদক .২২ ম্যাচ এয়ার পিস্তলে রৌপ্যপদক পান। ১৯৮৭ সালে .১৭৭ ম্যাচ এয়ার পিস্তলে স্বর্ণ ও র্যাপিড ফায়ার পিস্তলে ব্রোঞ্জ পদক জিতেছেন। ১৯৮৯ সালে র্যাপিড এয়ার পিস্তল ও ১৭৭ ম্যাচ এয়ার পিস্তলে স্বর্ণপদক জয় করেন।
দুজনই ১৯৯০ সালে পেয়েছেন বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরষ্কার। আতিকুর রহমান ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ, ১৯৯৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার ও ২০১০ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরষ্কার এবং আবদুস সাত্তার নিনি ২০০০ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরষ্কার পেয়েছেন।
জাতীয় পর্যায়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার পরও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আতিক-সাত্তারের অংশ নেওয়ার পথটা সুগম ছিল না। তবে ছিল প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাসের কারণে এই জুটি দেশকে গৌরবান্বিত করার পাশাপাশি শুটিংকে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত করাতেও বড় ভূমিকা রাখেন। তাঁদের কারণেই আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পদক জয়ের অন্যতম সোপান হয়ে উঠেছে শুটিং। কমনওয়েলথ গেমস তো বটেই এমনকি অলিম্পিক গেমসে শুটাররা যে পদক জয়ের স্বপ্ন দেখেন, তার পথটা চিনিয়ে দেন এই দুই শুটার। ক্রীড়াবিদদের জীবনে এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে?