মেসি-রোনালদোর পর কে?
কাশীনাথ ভট্টাচার্য
২৭ জুলাই ২০২১
মেসি এখন ৩৪, রোনালদো আরও দু`বছর বেশি। ২০২২ বিশ্বকাপ তাঁরা দুজনই খেলবেন, এরপরই হয়তো ক্যারিয়ারের ইতি টানবেন! এরপর তাঁদের মতো কে রাজত্ব করবেন বিশ্ব ফুটবলে? নেইমার-এমবাপ্পে-ডি ব্রুইনা-পেদ্রি...কাদের জন্য ঘুম-ঘুম চোখে টিভি-পর্দায় চোখ রাখব আমরা? কলকাতার নামী ফুটবল লেখক কাশীনাথ ভট্টাচার্য সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করলেন।
সব ভালোই কোথাও না কোথাও শেষ হয়। তাই ভাবলে খারাপই লাগে, লিওনেল মেসি এবং ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোও অবসর নেবেন। সেই দিনও হয়তো, সত্যই, খুব বেশি দূর নয়। তখন কী করব আমরা? কার বা কাদের খেলা দেখার জন্য দিনের বা রাতের স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক সময়গুলোয় দুনিয়ার বাকি সব কাজগুলোকে স্রেফ বাজে কাজের ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে টেলিভিশন স্ক্রিনের সামনে নিজেদের বসিয়ে রাখব, সরিয়ে রাখব অন্য সব ভাবনাগুলো, ভেসে যেতে চাইব পরম আনন্দে?
গত প্রায় পনের বছর ধরে আমরা তো এমনই করেছি, করে চলেছি! আর করতে করতেই বেড়ে গিয়েছে লোভ। অনাস্বাদিত সেই আনন্দ রোজ রোজ পেতে পেতে। একটা ড্রিবল, একটা ফ্রি-কিক, আরও একটা গোল, একটা মুহূর্ত। বলা হয়, সমকাল নাকি ঠিকঠাক বিচার করতে পারে না। তার বিচারের জন্যও সময় জরুরি। যখন তাঁরা থাকবেন না, আসল বিচার নাকি তখনই করা সম্ভব। হয়তো তাই-ই। অবসরের বছরের পর বছর যখন কেটে যায়, স্মৃতিই নাকি আসল বিচারের ন্যায়দণ্ড ওপরে তুলে ধরে। আমরা, নশ্বর মানুষ, খুঁজে পাই অবিনশ্বরদের। তাঁদের পায়ের কাছে মাথা নীচু করে বসে থাকি চুপচাপ। সামনের চলমান দৃশ্যগুলো দেখি, আসলে দেখি না। ওই চলমানতা দেখতে দেখতেই মানসপটে ভেসে ওঠেন কেউ কেউ। মন ভারাক্রান্ত হয় আবারও।
নতুনের সন্ধানই জীবনদর্শন। মানুষ তাই খ্যাপার মতো খুঁজে ফেরে পরশপাথর, যা ছুঁইয়ে তার থোড়বড়িখাড়া, আলুনি জীবনে নিয়ে আসতে পারে বেঁচে থাকার মানে। আমাদের জীবনে এই দুই পরশপাথর লিওনেল মেসি আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। তাঁরা ছিলেন বলে আমাদের দিনগুলো, আমাদের রাতগুলো, পেয়েছিল অন্য মাত্রা। নিজেদের হেরে-যাওয়া, হারতে হারতে হয়রান হয়ে যাওয়া, জীবনে আমরা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছি, হৃদয় ভরে উঠেছে পরম প্রাপ্তিতে।
অবশ্যই এ প্রাপ্তিযোগ এক দিনে হয়নি। একদা তাঁরাও ছিলেন নবীন। এই নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে। তখন আমাদের চোখে মায়াকাজল অন্য কারও। জিনেদিন জিদান আছেন, আছেন রোনালদো লুইস নাজারিও দে লিমা। রাখাল বালকের খুশি নিয়ে ফুটবল মাঠে পদচারণা করছেন রোনালদিনহো। তখনও আমরা একই রকম ভাবতাম, এই খুশির ঠিকানাগুলো আর পাব কোথায়? সন্দিগ্ধ মন তখন ওই উঠতি পর্তুগিজ আর আর্জেন্টাইনকে পরখ করছে, ভালো লাগার আবেশেই। পারবেন কি তাঁরা?
বছর পনের পর এখন সেই সময়টাই মনে হয় সুদূর অতীত। এমনভাবেও কেউ কেউ পারেন নাকি, এত বছর ধরে নিজেদের এভাবে ধরে রাখতে? এভারেস্টে উঠলে তো নেমে আসাই নিয়ম। দেখা গেল, ওঁরা দুজন থেকেই গেলেন এভারেস্টে, ঘরবাড়ি বানিয়ে!
ফুটবল ইতিহাস দেখেনি এমন দুজনকে। এভাবে শাসন করেননি চিরশ্রেষ্ঠ আরও দুজন কখনও। আলফ্রেডো ডি স্টেফানো আর ফেরেঙ্ক পুসকাস একসঙ্গে খেলেছিলেন কয়েক বছর রিয়াল মাদ্রিদে, ঠিক। কিন্তু শুধুই কিছু বছর। তা-ও, একই ক্লাবে খেলার কারণে পরস্পরের পরিপূরক, নিজেদের জীবনের শেষ বছরগুলোয়। পাঁচের দশকের শেষ থেকে ছয়ের দশকের শুরুর কয়েক বছর। ধরুন মেসি আর ক্রিস্টিয়ানো একসঙ্গে সাত-আট বছর খেললেন রিয়াল মাদ্রিদ বা বার্সেলোনায়। বিরোধিতার এই স্বতঃস্ফূর্ত-আবহ কি তৈরি হত তখন? নিজেদের ছাপিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা কি এতটাই পেতেন দুজনে? মনে হয় না।
পেলে-গারিঞ্চার ক্ষেত্রে এই বিরোধিতা সেই সুযোগই পায়নি মাথা চাড়া দেওয়ার, গারিঞ্চা ফুটবলের বাইরের মাঠেও একই রকম আকর্ষক জীবনযাপনের সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাননি বলে। ইয়োহান ক্রুইফের সময় তাঁর মানের কেউ ছিলেন না। মিশেল প্লাতিনি আর জিকো সমসাময়িক হলেও তাঁদের সময়েও আগের সবার মতো ফুটবল এভাবে আমাদের সাজঘরের রোজ দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠেনি। তখনও চার বছর অন্তরই জেগে উঠত আমাদের ফুটবল-প্রেম, বাকি সময়টুকুতে ছিল আমাদের স্থানীয় ক্লাবপ্রেম, মাতামাতি। আমাদের তখন ‘লোকাল হিরো’-রা ছিলেন। সবেতেই আন্তর্জাতিক তারকা খোঁজার সময়-সুযোগ কিছুই ছিল না। টিভি খুললেই রোজ সন্ধ্যেবেলায় এভাবে ক্লাব-ফুটবলের দরজা হাট করে খুলে যেত না বছরে মাস আট-নয়। এমনকি, দিয়েগো ম্যারাডোনাকেও আমরা বিশ্বকাপেই চিনেছি, পরে খুঁজতে বসেছি তাঁর নাপোলির সাফল্য।
লোথার ম্যাথাউস সেই ছিয়াশির বিশ্বকাপ ফাইনালে ম্যারাডোনাকে খেলতে না দিলেও এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবলার হলেও, ম্যারাডোনার সঙ্গে তাঁর বিরোধিতা ছিল না বিশেষ। রোমারিও-রোনালদো লড়াইও ইউরোপে জমেনি বিশেষ। বিশ্বকাপ বাদ দিলে জিদান এবং রোনালদোও পরস্পরের বিরুদ্ধে আর ক’টা ম্যাচই বা খেলেছেন! পরে তো সেই একসঙ্গে রিয়াল মাদ্রিদে।
তাই ফুটবলের গত ৭০ বছরের ইতিহাস এমন দুই ফুটবলারের সেয়ানে সেয়ানে লড়াই দেখেনি যেমন, উপভোগ করার হাতিয়ারও আমাদের উপমহাদেশের ফুটবল-দর্শকের হাতে ছিল না। এই দুই তারকা এই সর্বগ্রাসী সময়ে আবার যোগ করেছেন সর্বোচ্চ পারফরম্যান্সের দৈনন্দিন ধারাবাহিকতা। ক্লাবের হয়ে ক্রিস্টিয়ানোর ৬৭৪ গোল হলে মেসির ৬৭২, দেশের হয়ে যথাক্রমে ১০৯ ও ৭৬। অর্থাৎ, ক্রিস্টিয়ানোর ৭৮৩ গোলের পাশাপাশি মেসির ৭৪৮! দুজনের ম্যাচসংখ্যা, ক্লাব ও দেশ মিলিয়ে, ১০৭৫ ও ৯২৯! মেসি ছ’বার বর্ষসেরা হলে ক্রিস্তিয়ানো পাঁচবার। দুজনে মিলে গত পনের বছরে ১১ বার বর্ষসেরার খেতাব নিয়ে গিয়েছেন নিজেদের ঘরে। এমন অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতাও দেখেনি ফুটবল ইতিহাস।
তাই এমন দুজন যেদিন বিদায় জানাবেন, কাকে দেখার জন্য দর্শক মাঠমুখী (এবং অতি অবশ্যই টেলিভিশনমুখী!) হবেন, সঙ্গত প্রশ্ন।
এই মুহূর্তে যে দুজনের নাম উঠে আসছে – নেইমার, কিলিয়ান এমবাপ্পে। কিন্তু, নেইমারের নাম উঠলেও আগামী ফেব্রুয়ারিতেই তিনি ত্রিশ! তারপর আরও বছর দুই-তিন হয়তো থাকতে পারবেন, তা-ও তাঁর পারফরম্যান্স-লেখচিত্র যেমন, গোটা মৌসুম তিনিই টেনে যাবেন দলকে, এমন দেখা যায়নি এখনও। ক্লাবে তাঁর সেরা পারফরম্যান্স বেরিয়ে এসেছিল পাশে যখন মেসি ছিলেন, বার্সেলোনায়। এবং অতি অবশ্যই লুইস সুয়ারেজও। ব্রাজিলে যখন তিনিই সেরা তারকা, দেশ এখনও বলার মতো সাফল্য পায়নি। ক্লাব ফুটবলে খেলেনও পিএসজি-তে, ফরাসি লিগ ওয়ান-এর সেই জনপ্রিয়তা নেই যেমন, ক্লাব ঘিরে সমর্থনের উন্মাদনাও নেই। সবচেয়ে বড়, বছরের বেশির ভাগ সময় যাঁদের বিপক্ষে খেলবেন, তাঁদের নিয়েও রূপকথা তৈরির সম্ভাবনা কম।
ঠিক একই সমস্যায় ভুগতে হবে এমবাপ্পেকেও, অন্তত যত দিন তিনি পিএসজি-তেই থাকবেন বা থাকছেন। বয়স এমবাপের দিকে। সবে বাইশ এখন, ডিসেম্বরে তেইশ হবে। মাত্র উনিশে বিশ্বকাপ কাঁপিয়েছিলেন রাশিয়ায়। প্রতিযোগিতায় চার গোল, মেসির আর্জেন্টিনাকে একার পায়েই হারিয়ে দিয়েছিলেন প্রায়, ২-২ থেকে ৪-২ ব্যবধানে ফ্রান্সকে এগিয়ে দিয়ে। পরে ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধেও পেয়েছিলেন গোল। বিশ্বকাপ ফাইনালে সতেরর পেলের পর এত কম বয়সে আর কেউ গোল করেননি। সুতরাং, স্বপ্ন দেখাই যায় এমবাপ্পেকে নিয়ে।
কেভিন ডি ব্রুইনার বয়স এখনই ত্রিশ। মেসি-রোনালদোরা আরও এক বছর তো খেলবেনই, ২০২২ বিশ্বকাপ যেহেতু নভেম্বর-ডিসেম্বরে, দু-বছর বলাটাই ঠিক। ডি ব্রুইনারও বয়স আরও বছর দেড়েক বাড়বে বাইশের বিশ্বকাপের সময়। ইংল্যান্ডের ক্লাব ফুটবলে তাঁর স্কিল হয়ত সবার ওপরে, বহির্বিশ্বে ততটা সাড়া জেগেছে কি?
কম বয়সী ফুটবলারদের মধ্যে আর্লিং হালান্ড এবং সদ্যসমাপ্ত ইউরোর পর পেদ্রিকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। নরওয়ের হালান্ডের বয়স ২১, স্পেনের পেদ্রির ১৮। হালান্ড আবার প্রচুর গোল করেন। বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের হয়ে ৫৯ ম্যাচে ৫৭ এবং দেশ নরওয়ের হয়ে ১২ ম্যাচে সাত গোল। হালান্ডের গতিও ভয় পাওয়ানোর মতোই। আশা করা যায়, আরও বড় ক্লাবে খেলবেন অদূর ভবিষ্যতেই। না, বরুসিয়া ডর্টমুন্ডকে ‘ছোট’ বলছি না, কিন্তু বায়ার্ন মিউনিখ বা রিয়াল-বার্সেলোনা অথবা জুভেন্টাস ও দুই মিলান কিংবা ইংল্যান্ডের সেরা তিন-চার ক্লাবে যেখানে নামের ওজনটাও একই সঙ্গে পিঠে বইতে হয়, তেমন ক্লাবে খেললে আরও উন্নতি অবশ্যই সম্ভব।
পেদ্রি যেহেতু মাঝমাঠের ফুটবলার, তিনি আমাদের আলোচ্য দুজনের মতো গোল পাবেন না কখনও। তাই আমজনতার কাছে তিনি সবচেয়ে উঁচুতে পৌঁছতে পারেন আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার কাছাকাছি যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করলেই। যদি সেটাও পারেন, কোনও অংশে কম হবে না তাঁর কৃতিত্বও। কিন্তু একটা মৌসুম দেখেই যদি কারও সঙ্গে ইনিয়েস্তার তুলনা শুরু করা হয়, ইনিয়েস্তার অবমাননা তো বটেই, পেদ্রিকে অযথা চাপে ফেলার পাশাপাশি যিনি এমন লিখবেন তাঁর মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক তখন। ভিনিসিয়াস জুনিয়র? তেমন মনে হওয়ার কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এখনই। তবে, বয়স তাঁরও দিকে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করতেই পারেন।
মেসি-রোনালদো পরবর্তী ফুটবলে তাই এই মুহূর্তে এমবাপ্পে-হালান্ড ছাড়া আর কারও মুখ ভেসে উঠছে না।
জীবনের মতো ফুটবলও অপ্রত্যাশিত চমক দেয়। তাই, আগামী বছর দুয়েকেই আরও কেউ মাঠে তাঁদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে আমাদের অপ্রত্যাশিত আনন্দে ভরিয়ে দেবেন না, এমনই বা ভাবব কেন?
আপাতত অবশ্য আরও বছর দেড়-দুই আমরা না হয় মজেই থাকি রোনালদো আর মেসিতেই!