লর্ডস ও ২০০০

উৎপল শুভ্র

২৬ জুলাই ২০২১

লর্ডস ও ২০০০

ঐতিহাসিক সেই টেস্টের টসে। ছবি: গেটি ইমেজেস

টেস্ট ক্রিকেট শুরুর প্রায় ১২৪ বছর পর ২০০০তম টেস্ট ম্যাচ। ঘটনাচক্রে সেই টেস্টটা আবার ছিল আবার লর্ডসে। এমন একটা উপলক্ষের জন্য উপযুক্ত মঞ্চই বটে। দশ বছর আগে ২০০০তম টেস্টকে আবাহন করে এই লেখা।

প্রথম প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০১১। প্রথম আলো।

২০০০তম টেস্ট নিয়ে শোরগোল শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রশ্নটা মনে জাগছে। টেস্টটা যে লর্ডসে হচ্ছে, এটা কি ভেবে চিন্তেই ঠিক করা? না, এ নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। আমি বরং খুশি। খুশি এই ভেবে যে, টেস্ট ক্রিকেটের এমন ঐতিহাসিক একটা মাইলফলকে পা রাখার ম্যাচটা উপযুক্ত মঞ্চেই হচ্ছে।

লর্ডসে পা রাখার আগে এই মাঠ নিয়ে কাব্যগাথাকে ইংরেজদের আদিখ্যেতাই ভাবতাম। কিন্তু ১৯৯৯ বিশ্বকাপে প্রথম দর্শনেই লর্ডসের প্রেমে পড়ে যাই। এটা তো আর সেই অর্থে প্রেম নয়, তাই নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ না হলেও এর তীব্রতা একটুও কমেনি। বরং এরপর যতবার লর্ডসে গিয়েছি, প্রতিবারই মনে হয়েছে, এখানে বাড়তি কী যেন একটা সত্যিই আছে! সেটি কি ইতিহাস-ঐতিহ্যের একটা বাতাবরণ? ঠিক জানি না। তবে এটুকু জানি, মুগ্ধতাটা ক্রমশ আরও বেড়েছে।

ক্রিকেটের সবচেয়ে বিখ্যাত মাঠ। অথচ ঐতিহাসিক কোনো লগ্নের সাক্ষী কি হতে পেরেছে লর্ডস? ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচ এখানে হয়নি, এমনকি ইংল্যান্ডের প্রথম টেস্ট ম্যাচও নয়। এ কারণেই ভাবছি, ২০০০তম টেস্ট আর লর্ডস এমন মিলে গেল কীভাবে! হিসাব করে এটি করা হয়েছে বলে কোথাও শুনিনি। তা হলে কি ব্যাপারটা কাকতালীয়?

ক্রিকেটে এমন হঠাৎ হয়ে যাওয়া বা কাকতালীয় ঘটনার অনেক উদাহরণ। ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচটা যে মাঠে, প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচটাও যে সেই মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডেই হলো—এটাই তো সবচেয়ে বড় উদাহরণ। বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া টেস্ট ম্যাচের দর্শকদের পয়সা কিছুটা হলেও উশুল করার চিন্তা থেকে ৪০ ওভারের (আট বলে ওভার) ওই ম্যাচ। এর চেয়েও বড় কথা, সেটির আয়োজন নিছকই একটি প্রদর্শনী ম্যাচ হিসেবে। এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের সূচনাপর্ব বলে স্বীকৃতি পেয়েছে পরে। ১৮৭৭ সালে ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। খেলোয়াড়রা কেউই জানতেন না, প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রবহমান এক ইতিহাসের অংশ হয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।

এমসিজিতেই ঘটনাচক্রে ইতিহাসের প্রথম টেস্ট, প্রথম ওয়ানডেও—এটিকে যদি কাকতাল বলেন, তাহলে এখন যেটি বলব, সেটিকে বলতে হবে কাকতালের বাবা! ইতিহাসের প্রথম টেস্টে ইংল্যান্ডকে ৪৫ রানে হারিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ১৯৭৭ সালে সেই মেলবোর্নেই শতবার্ষিকী টেস্টে আবারও যখন দুই দল মুখোমুখি, এবারও একই ফল—অস্ট্রেলিয়া ৪৫ রানে জয়ী! গণিতবিদরা অঙ্ক কষে এমন হওয়ার প্রবাবিলিটি বের করতে থাকুন, আমার তা জানার আগ্রহ নেই। আমি এটিকে ক্রিকেটের রহস্যপ্রিয়তার একটা উদাহরণ হিসেবেই ধরতে চাই।

২০০০তম টেস্টটা লর্ডসে পড়ে যাওয়াটা হয়তো ঘটনাচক্রেই। ঘটনাচক্রেই এমন একটা উপলক্ষের উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দলও। এক দিকে টেস্ট ক্রিকেটের এক নম্বর, অন্যদিকে অস্ট্রেলীয় সাম্রাজ্যের অবসান ঘটানো ক্রিকেট-জনক—মাঠের খেলাও উপলক্ষের উপযুক্ত হয়ে ওঠার আশা করাটায় তাই একটুও বাড়াবাড়ি নেই। 

লর্ডসে শচীন টেন্ডুলকারের শেষ টেস্ট—এ বাড়তি মাত্রাটাও আছে এই টেস্টে। সেঞ্চুরিটিকে হাতের মোয়া বানিয়ে ফেলা ব্যাটসম্যানের লর্ডসে কোনো সেঞ্চুরি নেই—এটাও কি এই টেস্টকে ঘিরে বাড়তি একটা আগ্রহের কারণ নয়?

লর্ডসের ওই টেস্টটা শচীন নন, রাঙিয়েছিলেন পিটারসেন। করেছিলেন ২০২। ছবি: গেটি ইমেজেস

পাঠক, বিরক্ত হতে পারেন, তার পরও ‘কাকতালীয়’ শব্দটা আবারও আসছে। শচীন টেন্ডুলকারকে প্রায়শ যে নামে ডাকা হয়, সেই ‘লিটল মাস্টার’ নামের প্রথম ভারতীয় স্বত্বাধিকারীর সঙ্গে তাঁর কাকতালীয় একটা মিল লর্ডসে টেস্ট সেঞ্চুরিহীন থাকা। লর্ডস মাঠটা সুনীল গাভাস্কার কখনোই পছন্দ করেননি। মাঠটা এক দিক থেকে আরেক দিকে ঢালু, লোকজন খুব উন্নাসিক—এসব অভিযোগ অনেকবারই করেছেন। সে সবের সারবত্তাও আছে। দ্বাররক্ষী তাঁকে গেটে আটকে দেওয়ায় এমসিসির সদস্যপদও ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। লর্ডসে সেঞ্চুরি না পাওয়াটাকে গাভাস্কার কখনোই তাই বড় করে দেখাতে চাননি। তবে মনে কোনো অপ্রকাশিত আক্ষেপ থেকে থাকলে সেটি ঘুচে গিয়েছিল লর্ডসে খেলা শেষ ম্যাচে। এমসিসির দ্বিশতবার্ষিকীতে আয়োজিত ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচে খেলেছিলেন ১৮৮ রানের এক ইনিংস। অবসরের ঘোষণাটাও দিয়েছিলেন ওই ম্যাচ শেষেই। 

লর্ডসে শেষ ম্যাচে গাভাস্কারের সেঞ্চুরি, টেন্ডুলকারও যদি সেঞ্চুরি করে ২০০০তম টেস্টটাকে স্মরণীয় করে রাখেন, ওই শব্দটা কিন্তু আবার এসে যাবে! তার ওপর সেই সেঞ্চুরি যখন হবে শচীন টেন্ডুলকারের পরম কাঙ্খিত শততম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি।

দেখুন তো কাণ্ড, ২০০০তম টেস্ট আর লর্ডস নিয়ে কথা শুরু করে কোথায় কোথায় চলে গেলাম! এবার তাহলে শেষ করি, নাকি!

সংযোজন: না, লর্ডসে সুনীল গাভাস্কারের শেষ টেস্টের সঙ্গে মেলেনি শচীন টেন্ডুলকারের শেষ টেস্ট। লর্ডসে আর সেঞ্চুরি পাওয়া হয়নি তাঁর। দুই ইনিংসে করেছিলেন ৩৪ ও ‌১২। 

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×