ভিক্টর ট্রাম্পার একজনই ছিলেন, একজনই থাকবেন
উৎপল শুভ্র
২৪ জুলাই ২০২১
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম দিন লাঞ্চের আগে সেঞ্চুরির প্রথম কীর্তির উদযাপন যদি স্বর্গে হয়? কীর্তিমান ভিক্টর ট্রাম্পারকে ঘিরে থাকেন ক্রিকেটের অমর সব কিংবদন্তিরা...তাঁদের কথায় কথায় উঠে আসে ট্রাম্পারের ক্যারিয়ার-জীবন। যা বুঝিয়ে দেয়, ভিক্টর ট্রাম্পারের মতো আর কেউ হবে না!
১৯০২ অ্যাশেজ সিরিজ একই সঙ্গে রঞ্জির মনে বেদনা ও আনন্দের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। সেই সিরিজেই তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ। শেষটা ভালো হয়নি। তিন টেস্টে ৪ ইনিংস খেলে করেছিলেন মাত্র ১৯ রান। তারপরও সেই অ্যাশেজ সিরিজটা ভুলতে পারেন না শেষ দুটি টেস্টের কারণে। ১৮৯৯ সালে প্রথম সফরেই নিজেকে চিনিয়েছিল ভিক্টর ট্রাম্পার। আর ওই সফরে পুরো রাঙিয়ে দিয়েছিল ইংলিশ দর্শকের মন। মনে পড়ল, ব্র্যাডম্যান যখন ইংল্যান্ডে রানের বন্যা বইয়ে দিচ্ছিলেন, প্রিয় বন্ধু সিবি ফ্রাই তার মনের কথাটাই লিখেছিল। 'ব্র্যাডম্যান যত রানই করুক না কেন, ভিক্টর ট্রাম্পারের নাম বারবার ফিরে ফিরে আসে আর আলোচিত হয় তাঁর অসাধারণ সব কীর্তি। ইংল্যান্ডের মানুষের মনে ও হৃদয়ে তাঁর যে আসন, আর কোনো ব্যাটসম্যান তা কখনোই পাবে না।'
হঠাৎ কী মনে হতেই একটা হিসাব করলেন রঞ্জি। আরে, আজই তো ২৪ জুলাই। ওল্ড ট্রাফোর্ডে প্রথম দিন লাঞ্চের আগেই ভিক্টর ট্রাম্পারের সেঞ্চুরির বার্ষিকী। ডব্লিউ জি গ্রেসকে নিয়ে যেমন হয়েছিল, ট্রাম্পারকে নিয়েও তো এমন একটা আয়োজন করা যায়। পরিকল্পনাটা খুলে বলতেই ডব্লিউ জি সোৎসাহে সমর্থন দিলেন। তবে একটা সমস্যা কিন্তু আছে। ছোড়াটা খুব লাজুক। ওর কোনো কীর্তির কথা বললেই অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়' বলে ডব্লিউ জি নিজেকে নিয়েই রসিকতা করলেন, 'ঠিক আমার মতো!”
রঞ্জিও ট্রাম্পারের এই স্বভাবের কথা জানেন। ট্রাম্পারকে খুব স্নেহ করতেন। ব্যাটিংয়ে পেলবতায় মিলের কারণে ট্রাম্পারকে যে অস্ট্রেলিয়ার রঞ্জি' বলা হতো, এ নিয়ে তাঁর একটা গর্বও আছে। তিনিই একটা বুদ্ধি বের করলেন, 'আমরা তাহলে একটা কাজ করি। শুধুই ভিক্টরের কথা বলার দরকার নেই। আমাদের বিষয় হবে—নাইনটিন হান্ড্রেড টু ইংলিশ সামার। ভিক্টরের কথাই বেশি আসবে। সঙ্গে অন্যদের কথাও না হয় এল। ওই সিরিজে আরও অনেকেই তো অনেক কিছু করেছে। জেসপকেও ডাকব। ওই সিরিজের একটা টেস্টের নামই তো হয়ে গেছে—জেসপের টেস্ট।'
কোনো একটা কিছু করবেন বলে ঠিক করলে ডব্লিউ জি শিশুদের মতো উত্তেজনায় টগবগ করতে থাকেন। 'চলো, চলো, আয়োজন করে ফেলি। কীভাবে করা যায়, বলো তো?'
রঞ্জি এর মধ্যেই ভেবে ফেলেছেন। ক্লেম হিলকে বললেই হবে, ও-ই ভিক্টর ট্রাম্পারকে নিয়ে আসবে। দুজনের খুব দোস্তি। একে অন্যের অনেক কীর্তি ২২ গজে দাঁড়িয়েই দেখেছেন। তিন বছর আগে-পরে টেস্ট অভিষেক। তবে শেষ একই সঙ্গে। জো ডার্লিংকেও বলতে হবে। ওই ট্যুরে ও-ই ছিল অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক। আর গিলবার্ট জেসপ তো তাঁর পাশের ঘরেই থাকে। বাকি যাদের চাই, তারা তো বৈকালিক আড্ডায় নিয়মিতই।
ডব্লিউ জি ঠিক করে ফেললেন, ওই দিন জ্যাক হবস তাঁকে চমকে দেওয়ার জন্য যা করেছিল, তেমন একটা কিছু করতে হবে। ট্রাম্পারকে নিয়েও নিশ্চয়ই কবিতা-টবিতা লেখা হয়েছে। ক্লেম হিলকে জিজ্ঞেস করলেই হবে। ওর জানার কথা।
অনেক স্মৃতি ভিড় করতে লাগল ডব্লিউ জির মনে। ট্রাম্পারের ব্যাটিং দেখে মুগ্ধতা তো পৃথিবীতে থাকতেই। স্বর্গে আসার পর ছেলেটাকে যত দেখেছেন, ততই সেই মুগ্ধতা বেড়েছে। কে যেন বলেছিল, ব্যাটিং দেখেই ব্যাটসম্যানের ব্যক্তিত্ব বোঝা যায়। ট্রাম্পারকে দেখে এই কথার সত্যতা সবচেয়ে ভালো বুঝতে পেরেছেন। ওর ব্যাটিংয়ে যেমন নরম, পেলব একটা জ্যোতি ফুটে বেরোত, কথাবার্তা-আচার-আচরণেও সেটির ছায়া।
পৃথিবীর রূপ-রস-সুধা বেশি দিন ভোগও করতে পারেনি ছেলেটা। ত্রিশ বছর পরে জন্ম নিয়েও এই স্বর্গধামে তাঁর মাস চারেকের সিনিয়র। কিডনির অসুখে ট্রাম্পারের মৃত্যুর সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে টালমাটাল পৃথিবী। ডব্লিউ জি খবরটা পেয়ে বড় দুঃখ পেয়েছিলেন। ডাক্তার বলে নিজের শরীরের অবস্থাও ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন। অস্ফুটে বলেছিলেন, 'বিদায় ভিক্টর! আমারও আর বেশি দিন নেই। খুব তাড়াতাড়িই দেখা হবে।' স্বর্গ-প্রবেশের দিনটিতে তাঁকে ঘিরে আলফ্রেড শ-জর্জ লোম্যান-জেমস সাদারটনের হইচইয়ের মধ্যে এক কোণে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল ট্রাম্পার।
*****
স্বর্গে কোনো কিছুর জোগাড়যন্ত্র করা কোনো সমস্যাই নয়। কোনো কিছু চাইলেই তা হাজির হয়ে যায়। ডব্লিউ জি গ্রেস এক সেট ড্রামের ব্যবস্থা করে ফেললেন। সঙ্গে বিশাল একটা পুষ্পস্তবক। পরদিন বিকেলবেলায় রঞ্জিকে নিয়ে একটু আগেভাগেই চলে গেলেন ওই লেকের ধারে। শ্বেতপাথরের টেবিলে পুষ্পস্তবকটা রেখে অপেক্ষা করতে লাগলেন বাকি সবার।
একে একে সবাই চলে এলেন। কিন্তু যার জন্য এই আয়োজন, সেই ভিক্টর ট্রাম্পারের দেখা নেই।
ডব্লিউ জি অল্পতেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, কী কাণ্ড দেখো তো! ক্লেম, তোমাকে না কতবার বললাম, ভিক্টরকে সঙ্গে নিয়ে আসতে।'
'তা-ই তো চেয়েছিলাম। ও বলল, তুমি যাও। আমি আসছি।' ক্লেম হিলের কথা শেষ হতে না হতেই দেখা গেল, ভিক্টর ট্রাম্পার আসছেন।
ট্রাম্পার অনুমান করেছিলেন, আজ বিশেষ কিছু একটা আছে। নইলে ক্লেম হিল এত পীড়াপীড়ি করত না। স্বর্গে কারও বিশেষ অর্জনের বার্ষিকী উদযাপনের একটা রেওয়াজ আছে। আজ কি তেমন কোনো দিন? অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না।
আনমনে ভাবতে ভাবতে যে-ই কাছাকাছি এসেছেন, চারপাশ সচকিত হয়ে উঠল ড্রামের শব্দে। ডব্লিউ জি দুমদাম ড্রামে বাড়ি মারছেন আর বলছেন, 'হে হো, হে-হো, হে-হো!' কী অর্থ, শুধু ডক্টরই জানেন!
ট্রাম্পারকে হাত ধরে পাশে বসালেন চার্লস ব্যানারম্যান। ট্রাম্পারের ওপর অধিকারটা তাঁর একটু বেশিই। খেলা ছাড়ার পর আম্পায়ারিংয়ের সঙ্গে কোচিংও করাতেন। তাঁর কোচিং জীবনের সবচেয়ে বড় গর্ব এই ট্রাম্পার। প্রতিভা কখনো চাপা দিয়ে রাখা যায় না। কোনো না কোনোভাবে ঠিকই তা ফুটে বেরোয়। তবে ট্রাম্পারকে আবিষ্কারের কৃতিত্ব যখন তাঁকে দেওয়া হয়, ব্যানারম্যান প্রতিবাদ করেন না; বরং উপভোগই করেন স্বীকৃতিটা। কথাটা তো একেবারে মিথ্যা নয়।
কী একটা ম্যাচে কিশোর ট্রাম্পারের ব্যাটিং প্রথম দেখে কেমন চমকে গিয়েছিলেন, সেই স্মৃতি মনে পড়ল ব্যানারম্যানের। এরপর থেকে ট্রাম্পারকে গড়েপিটে তৈরি করার চেষ্টায় নেমেছেন। তবে সেটা খুব বেশি একটা করতে হয়েছে, তা নয়। জিনিয়াসরা যে নিজেরাই নিজেদের নিয়ম তৈরি করে নেয়। ট্রাম্পার ম্যাচ খেলতেন, আর মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে উৎসাহ দিতেন ব্যানারম্যান।
অফ স্টাম্পের একটু বেশি বাইরে বল হলেই চিৎকার করতেন, 'ছেড়ে দাও, ভিক! এটা মারার বল না।'
সেই বলকেই বাউন্ডারিতে ছুটে যেতে দেখে ব্যানারম্যান খুব দ্রুতই বুঝে ফেলেন, ব্যাটিংয়ের সাধারণ নিয়মকানুন এর জন্য প্রযোজ্য নয়। ট্রাম্পারকে ট্রাম্পারের মতো থাকতে দেওয়াই ভালো।
ডব্লিউ জির ড্রামের শব্দ থামল। উঠে দাঁড়ালেন ক্লেম হিল। হাতে একটা কাগজ। যা দেখে আবৃত্তি করতে শুরু করলেন—
Ho Statesmen, Patriots, Bards make way!
Your fame has sunk to zero:
For Victor Trumper is to-day
Our one Australian Hero.
ট্রাম্পার একটু হকচকিয়েই গেলেন। ব্যাপার কী, হঠাৎ এই কবিতা কেন! কবিতাটা তাঁর পরিচিত। দ্য বুলেটিনে ছাপা হয়েছিল। আরেক 'ভিক্টর' লিখেছিলেন বলে কবির নামটাও মনে আছে—ভিক্টর ড্যালি। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছেন।
রঞ্জি বললেন, 'শুধু এই চার লাইনই? আর নেই?'
ক্লেম হিল বললেন, 'আরও আছে। পুরোটাই পড়ব?’
সবাই সমস্বরে বললেন, 'অবশ্যই।'
“ঠিক আছে। অনেক বড় কবিতা। আমি আরও কয়েকটা লাইন বলি ।
ক্লেম হিল আবার আবৃত্তি করতে শুরু করলেন—
High purpose glitters in his eye,
He scorns the filthy dollar;
His splendid neck, says Mrs. Fry,
Is innocent of collar.
He stands upon the short green grass,
Superb, and seems to be now
A nobler young Leonidas
At our Thermopylae now.
ট্রাম্পার লাজুক হাসি দিয়ে জানতে চাইলেন, 'কী ব্যাপার, আজ সবাই আমাকে নিয়ে পড়লেন কেন? আমার অপরাধ কী?' ডব্লিউ জি হাসতে হাসতে বললেন, 'অপরাধ তো আছেই। আজকের এই দিনে তুমি প্রথম টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম সেশনে সেঞ্চুরি করেছিলে। তোমার কি আসলেই মনে ছিল না?'
'সেঞ্চুরির কথা তো মনে আছেই। কিন্তু সেটি যে আজকের এই দিনেই, তা মনে ছিল না।'
ডব্লিউ জি টেবিল থেকে পুষ্পস্তবকটা তুলে নিয়ে বললেন, 'এটা ডনই ভিক্টরের হাতে দিক। আমরা অন্য কেউ দিলে মানাবে না। এখানে যারা আছি, তাদের মধ্যে ভিক্টর ছাড়া টেস্টের প্রথম সেশনে সেঞ্চুরি তো শুধু ডনই করেছে। ব্র্যাডম্যান পুষ্পস্তবকটা ট্রাম্পারের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, 'আমার একটা প্রশ্ন আছে। একটু আগে যে কবিতাটা শুনলাম, তাতে মিসেস ফ্রাইয়ের কথা আছে। ঘটনাটা কী?' উত্তরটা সিবি ফ্রাইকেই দিতে হলো, 'আমার বউ ভিক্টরের ব্যাটিংয়ের খুব ভক্ত ছিল। কী একটা সাময়িকীতে ভিক্টরকে নিয়ে লিখেছিল। বড় ভালো ছিল লেখাটা। ওটিতেই ছিল ওই লাইনটা। নীল আকাশের নিচে সবুজ ঘাসের মাঠে ভিক্টর ব্যাটিংয়ে দাঁড়িয়েছে, বাতাস এসে লাগছে তাঁর সুন্দর খোলা ঘাড়ে। লেখাটার থিমটা ছিল এ রকম—ভিক্টর শিল্পী, একদিন কেউ একজন ওর পোর্ট্রেট আঁকবে। সেটি ঝুলবে কোনো এক ন্যাশনাল পোর্ট্রেট গ্যালারিতে। ভিক্টরের সেই পোর্ট্রেটের বর্ণনা দিয়েছিল ও।'
ট্রাম্পারের ভালো লাগছিল। আবার খুব লজ্জাও পাচ্ছিলেন।
কিন্তু সিবি ফ্রাই বলেই চলেছেন, 'ওই লেখাটার আরেকটা অংশ আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিল। সেটিও কি বলব?'
ট্রাম্পার ছাড়া বাকি সবাই হইহই করে শুনতে চাইলেন। 'সে হলো ক্রিকেটের কবি। কবির বাড়তি চেতনা, স্পর্শ আর অনুভূতি আছে তাঁর। ট্রাম্পার তাঁর ব্যাট দিয়ে বল এমনভাবেই খেলতে পারেন, ঠিক প্যাগানানি যেমন তার বেহালা বাজান।'
জ্যাক হবস কপট রাগ দেখিয়ে সিবি ফ্রাইকে বললেন, 'ও, তোমার বউ লিখেছে বলে এত কথা! আমি যে ভিক্টর সম্পর্কে বলেছিলাম “শ্যাম্পেন অব ক্রিকেট", সেটা কারও মনেই নেই।”
ফ্রাই হাসতে লাগলেন। জবাবটা দিলেন ব্র্যাডম্যান, 'খুব মনে আছে। আপনি চাইলে ভিক্টর সম্পর্কে কী লিখেছিলেন, তাও বলতে পারি।'
'তার আর দরকার নেই, আমিই বলি। স্মৃতি থেকে বলছি, একটু এদিক ওদিক হতে পারে'—ট্রাম্পার সম্পর্কে নিজের পুরোনো লেখার একটা অংশ বলতে শুরু করলেন হবস, 'স্কোরিং মেথডের দিক থেকে সে আদর্শ এক ব্যাটসম্যান। প্রথাগত সব শট যেভাবে খেলা উচিত, সে ঠিক সেভাবেই খেলে। এর সঙ্গে একেবারেই তাঁর নিজস্ব এমন আরও অনেক শট আছে, অন্য ব্যাটসম্যানদের যা খেলার চেষ্টা করা বৃথা।'
ট্রাম্পার এবার সত্যিই খুব বিব্রত বোধ করতে লাগলেন। তাঁর মুখ দেখে তা বুঝতে পেরে ডব্লিউ জি বললেন, 'ভিক্টরের ওই সেঞ্চুরি নিয়েই শুধু আমাদের আজকের আড্ডা নয়, নাইনটিন হান্ড্রেড টুর ওই ইংলিশ সামার নিয়েও কথা বলব। গিলবার্ট জেসপকে এত বলে-কয়ে নিয়ে এলাম তো সেই কারণেই। ওই ট্যুরে ট্রাম্পারের অধিনায়ক জো ডার্লিংও এসেছে। কী জো, তুমি তো দেখি কথাই বলছ না!'
এতক্ষণে একটু স্বস্তি পেলেন ট্রাম্পার, 'জেসপকে দেখেই আমার ওভালের ওই টেস্টের কথা মনে পড়ে গেছে। ও তো বলতে গেলে একাই হারিয়ে দিয়েছিল আমাদের।'
উইলফ্রেড রোডস আজ একটা বল নিয়ে এসেছেন। আপন মনে সেটিতে বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে মোচড় দিয়ে যাচ্ছিলেন। বলটাকে একবার শূন্যে ছুড়ে তা ধরে বললেন, 'ওটা তো সিরিজের শেষ টেস্ট। এর আগের টেস্টেই ভিক্টরের ওই সেঞ্চুরি। ভিক্টর চাক বা না চাক, আমি ওটা নিয়েই আগে কিছু বলতে চাই।' রোডস কী বলতে যাচ্ছেন, তা অনুমান করতে পেরে রঞ্জির মুখে এক চিলতে হাসি ফুটল। অনুমানটা মিলেও গেল।
রোডস বলছেন, ওল্ড ট্রাফোর্ডে ফিল্ডিং করতে নামার আগে অধিনায়ক আর্চি ম্যাকলারেন কী বলেছিলেন সেই কথা। 'স্কিপার আমাদের মানে বোলারদের ডেকে বলল, “উইকেট কিন্তু ভেজা। ডার্লিং কী বুঝে ব্যাটিং নিল, জানি না। তোমাদের শুধু একটাই কাজ-ট্রাম্পারকে লাঞ্চ পর্যন্ত শান্ত রাখো। তাহলেই এই ম্যাচ আমাদের।” স্ট্রোক খেলার জন্য খুব কঠিন উইকেট। তারপরও এমন ফিল্ডিং সাজানো হলো যে, যাতে চার না হয়। দ্বিতীয় ওভারেই ট্রাম্পার করল কি, জ্যাকসনকে সাইটবোর্ডের ওপর দিয়ে উড়িয়ে প্র্যাকটিস গ্রাউন্ডে ফেলল।
গল্পটা শেষ করলেন রঞ্জি, 'ম্যাকলারেন হতাশায় মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ওখানে ফিল্ডার রাখা তো কঠিন, তাই না?'
আরও অনেকবারের মতো ট্রাম্পারের সঙ্গে সেদিনও জুটি হয়েছিল ক্লেম হিলের। সেই অভিজ্ঞতার কথা বলার সুযোগটা ছাড়লেন না, 'ভিক্টরের সঙ্গে আমার অনেক জুটি হয়েছে। কোনো বোলারকে খেলতে সমস্যা হলেই ওর শরণাপন্ন হতাম। ও করত কি, ওই বোলারকে মেরে আক্রমণ থেকেই সরিয়ে দিত...।
হিলের কথা শেষ হওয়ার আগেই ট্রাম্পার বললেন, 'তুমিও দেখি শুরু করলে! ওই টেস্টে কি আমার সেঞ্চুরিই একমাত্র ঘটনা নাকি!' রঞ্জি রসিকতা করলেন, ‘ঠিকই তো! ওই টেস্টটির তো বিখ্যাত হয়ে থাকা উচিত আমার শেষ টেস্ট বলে।'
ট্রাম্পার বললেন, 'অবশ্যই। সেটা তো একটা বড় ঘটনাই।'
ঘটনা ওই টেস্টে অনেকই ঘটেছে। যেটির শেষ স্নায়ুক্ষয়ী এক সমাপ্তিতে। ওই টেস্টে যারা খেলেছেন, সবার মনে পড়ে গেল ফ্রেড টেটের কথা। বেচারা ওই একটাই টেস্ট খেলেছে আর সেটি কী দুঃস্বপ্নটাই না উপহার দিয়েছে তাঁকে!
ট্রাম্পারের ওই সেঞ্চুরির পরও প্রথম ইনিংসে মাত্র ৩৭ রানের লিড নিতে পেরেছিল অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয় ইনিংসে করল ৮৬। সেটিও হতো না, যদি ফ্রেড টেট ডার্লিংয়ের ক্যাচটা ফেলে না দিতেন। ইংল্যান্ডের সামনে ১২৪ রানের টার্গেট। ৩ উইকেটে ৯২ করে ফেলার পর ফ্রেড টেটের ওই ক্যাচ ফেলার এমন তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বলতে গেলে শেষ।
কিন্তু ক্রিকেট-বিধাতা যে তাঁর জন্য শুধু দুঃখই লিখে রেখেছিলেন। ২৪ রানের মধ্যে ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর শেষ ব্যাটসম্যান ফ্রেড টেটকে নামতেই হলো। ৮ রান লাগে জিততে। ফ্রেড টেটের ব্যাটের কানায় লেগে প্রথম বলেই চার হয়ে গেল। এমন আরেকটা হলেই তো হয়ে যায়! তা আর হলো না, চতুর্থ বলে বোল্ড হয়ে গেলেন ফ্রেড টেট!
পরে ড্রেসিংরুমে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'বাড়িতে আমার সাত বছরের একটা ছেলে আছে। আমি ইংল্যান্ডকে যেভাবে হারালাম, ও বড় হয়ে তা পুষিয়ে দেবে।'
অবিশ্বাস্যই বলতে হবে, বাইশ বছর পর 'সাত বছরের ওই ছেলে' ঠিকই ইংল্যান্ডের পক্ষে টেস্ট খেলতে নামে। ৩৯ টেস্টে ১৫৫ উইকেট নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা ফাস্ট মিডিয়াম বোলার হিসেবে।
****
শুধু লাঞ্চের আগে সেঞ্চুরির কারণেই তো আর ১৯০২ সালটাকে ভিক্টর ট্রাম্পারস্ গোল্ডেন সামার' বলা হয় না। ট্যুর জুড়েই তাঁর ব্যাটে ছিল রানের ফল্গুধারা। 'পরিসংখ্যান একটা গাধা' কথাটা আর কোনো ব্যাটসম্যানের জন্য এতটা প্রাসঙ্গিক হয় না। সেই ট্যুরটি ব্যতিক্রম। সংখ্যাও এখানে ট্রাম্পারের হয়ে গলা ফাটায়। ৪৮.৪৯ গড়ে ২,৫৭০ রান। ১১টি সেঞ্চুরি। ওই ইংলিশ সামারে গড়ের দিক থেকে তাঁর ওপরে ছিলেন শুধু আর্থার শ্রুসবেরি। তবে রান করেছিলেন অর্ধেক। গড়টা ফুলেফেঁপে ওঠার কারণ ছিল ট্রাম্পারের চেয়ে সাতবার বেশি নট আউট থাকা। রানসংখ্যায় (২২৯৯) সবচেয়ে কাছাকাছি ববি অ্যাবেল খেলেছিলেন ১১টি ইনিংস বেশি।
ক্লেম হিল সবাইকে এসব জানিয়ে বললেন, 'ট্রাম্পারের অ্যাভারেজ কম হওয়ার আরেকটি কারণ কি সবার জানা আছে? একটু গুরুত্বহীন ম্যাচে সেঞ্চুরি করলে অন্যদের সুযোগ দিতে ও ইচ্ছা করে আউট হয়ে যেত। ওই ট্যুরে ওর ১১ সেঞ্চুরির মধ্যে সর্বোচ্চটি মাত্র ১২৮। চাইলেই এর বেশ কটিকে ও ডাবল বানাতে পারত। কিন্তু ভিক্টর তো ভিক্টর! বেশির ভাগ সময় যে বোলারটা ভালো বোলিং করেছে, তাকে উইকেট দিয়ে আসত।
ডব্লিউ জি নির্বিকার মুখে বললেন. 'ঠিক আমার মতো।'
* লেখকের 'কল্পলোকে ক্রিকেটের গল্প' বই থেকে সামান্য পরিবর্তিত।