লাল দলের রাঙিয়ে দেওয়া প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ ফুটবল

দুলাল মাহমুদ

২৬ জুলাই ২০২১

লাল দলের রাঙিয়ে দেওয়া প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ ফুটবল

ফুটবলে এক সময় নিয়মিতই আন্তর্জাতিক ফুটবলের আসর বসত বাংলাদেশে। এক সময় ছিল আগা খান গোল্ড কাপ। এর পরিবর্তে ১৯৮১ সালে শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ। ১৯৮৯ সালে এই টুর্নামেন্ট জিতেই বাংলাদেশ ফুটবল দল প্রথম শিরোপা জেতে। যদিও শিরোপাজয়ী দলটির নাম ছিল বাংলাদেশ লাল। ধারাবাহিকের এই পর্বে সেই টুর্নামেন্টকে ফিরে দেখা।

সে একটা সময় গেছে। সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের ফুটবল ছিল জমজমাট। ঘরোয়া ফুটবলের খেলা দেখার জন্যও রীতিমতো দর্শকদের স্রোত নামত। কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যেত স্টেডিয়াম। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ত পুরো দেশে। ঢাকার মাঠে বিদেশি দলের খেলা হলে তো কথাই নেই। ফুটবলের সেই সময়টার কথা ভেবে এখন অনেকেরই দীর্ঘশ্বাস পড়ে। অথচ তখন আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের কোনো সাফল্য ছিল না। এখনও যে আন্তর্জাতিক ফুটবলে বড় সাফল্য আছে, তা বলা যাবে না। তারপরও বাংলাদেশ দল বেশ কয়েকবার বিভিন্ন টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতেছে। যার শুরুটা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ দিয়ে।  

আগা খান গোল্ড কাপের পরিবর্তে শুরু হওয়া প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপে সাধারণত কোনো জাতীয় দল অংশ নিত না। বেশির ভাগ সময়ই ক্লাব কিংবা বিদেশের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির জাতীয় দল খেলত। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ জাতীয় দলও টুর্নামেন্টে অংশ নিত না। তবে এই টুর্নামেন্টে খেলার জন্য বাংলাদেশ জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠন করা হতো দুটি দল। দর্শকদের কাছে তা মর্যাদা পেত অনেকটা জাতীয় দলের মতোই। 

১৯৮৯ সালে ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে আছে। এটিতেই প্রথম কোনো শিরোপা জয় করে বাংলাদেশ নামের কোনো দল। ফুটবল তো বটেই, এরআগে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে দলগত কোনো খেলায় বাংলাদেশের শিরোপা জয়ের নজির ছিল না। 

তখন ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে ফুটবলের স্থানান্তর ঘটেছে মিরপুর স্টেডিয়ামে। ১৯৮১ সালে শুরু প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ১৯৮৯ সালে প্রথমবার আয়োজিত হয় ঢাকা স্টেডিয়ামের বাইরে। ২১ মে মিরপুর স্টেডিয়ামে শুরু হয় এই টুর্নামেন্ট। যাতে ছিল অভিজ্ঞদের নিয়ে গড়া বাংলাদেশ লাল দল আর তরুণদের সমন্বয়ে গড়া বাংলাদেশ সবুজ দল। দুই গ্রুপে খেলে ৭টি দল। 

ক’ গ্রুপে খেলেছে বাংলাদেশ সবুজ দল, ভারতীয় জাতীয় দল, চীনের চ্যাম্পিয়ন লিয়াওনিং ক্লাব ও দক্ষিণ কোরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় দল। এই গ্রুপটি ছিল শক্তিশালী। টুর্নামেন্টে প্রথমবার অংশ নেয় কোনো একটি জাতীয় দল। বিস্ময়কর হলেও সত্য, একমাত্র সবুজ দলই পুরো টুর্নামেন্টে দুই ম্যাচে জয়ী হয়। হারিয়ে দেয় ভারতের জাতীয় দলকেও। তুলনামূলকভাবে এই দলটি ভালো খেলেও শিরোপা জিততে পারেনি। তবে জয় করে নেয় দর্শকদের হৃদয়। 

‘খ’ গ্রুপে ছিল বাংলাদেশ লাল, থাইল্যান্ড ও ইরানের দ্বিতীয় সারির জাতীয় দল। যুক্তরাষ্ট্রের সি হর্স টিম একদম শেষ মুহূর্তে নাম প্রত্যাহার করে নেওয়াতে এই গ্রুপটি পরিণত হয় তিন দলের। 

ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ লাল দল

উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ লাল দল ও থাইল্যান্ড। সুয়ান রাখার গোলে এগিয়ে যায় থাই দল। তাঁর গোলে কুশলতার ছাপ ছিল। খেলার শেষ দিকে বদলি খেলোয়াড় মুস্তাকিমকে থাই রক্ষণভাগের খেলোয়াড়রা অবৈধভাবে বাধা দিলে লাল দল ইনডিরেক্ট ফ্রি কিক লাভ করে। সাব্বির বলে আলতো স্পর্শ করতেই আসলাম প্রচণ্ড শটে গোল করে সমতা আনেন। পরের মিনিটে মুস্তাকিমের দূরপাল্লার শট ক্রস পিসে লেগে ফিরে আসে। এ ম্যাচে তেমন একটা ভালো খেলতে পারেনি লাল দল। প্রথমার্ধের ১৫ মিনিটে অধিনায়ক গোলরক্ষক কানন আহত হওয়ার পর গোলপোস্ট আগলানোর দায়িত্ব নেন সেলিম। 

পরের ম্যাচে লাল দল ইরানের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে। ড্র করলেও প্রশংসনীয় খেলা উপহার দেয় লাল দল। পুরো ম্যাচে দাপটের সঙ্গে খেলে। শুরুতে বাংলাদেশকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি ইরানিরা। দলের নির্ভরযোগ্য একাধিক খেলোয়াড়কে ছাড়াই খেলতে নামে। বাংলাদেশের প্রচণ্ড চাপের মুখে অবস্থা বেগতিক দেখে দ্বিতীয়ার্ধে আক্রমণভাগকে শক্তিশালী করে ইরান। ততক্ষণে খেলায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় বাংলাদেশ। তবে একাধিক সুযোগ পেয়েও গোল করতে ব্যর্থ হন স্বাগতিক দলের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়রা। রূপু, মন্টু, আসলাম, জনি গোলের সহজ সুযোগ নষ্ট করেন। রেফারিও বাংলাদেশকে একটি পেনাল্টি থেকে বঞ্চিত করেন। গোল করতে ব্যর্থ হয় ইরানের শক্তিশালী আক্রমণভাগও। 

সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশের দুই দল, লাল আর সবুজ

সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়ে যায় বাংলাদেশের দুই দল। যাতে সবুজ দলকে ১-০ গোলে হারিয়ে লাল দল ফাইনালে উঠে যায়। প্রথমার্ধের শেষদিকে লেফট উইং ব্যাক জনির মাটিঘেঁষা ক্রস গোলমুখে সবুজ দলের গোলরক্ষক আতিক প্রতিহত করতে গেলে তাঁর হাত ফসকে বেরিয়ে যায়। আর এই সুযোগ সদ্ব্যবহার করেন সামনে দাঁড়ানো সুযোগসন্ধানী সাব্বির। কোরিয়া ও ইরানের মধ্যকার অন্য সেমিফাইনালটি নির্ধারিত সময়ে ৩-৩ গোলে অমীমাংসিত থাকার পর  টাইব্রেকারে কোরিয়া জয়ী হয়। 

৫০ হাজারের বেশি দর্শকের উপস্থিতিতে ৩১ মে ফাইনালে বাংলাদেশ লাল দলের সঙ্গে খেলায় দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় দল কৌশলের আশ্রয় নেয়। আহত হওয়ার ভান করে। কয়েকবার খেলা বন্ধ রাখতে হয়। অবশ্য তারাও গতিময় খেলা উপহার দিয়ে লাল দলকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। তবে লাল দল শুরু থেকে আক্রমণাত্মক কৌশল নিয়ে তাক লাগিয়ে দেয়। অনেক সময় কোণঠাসা করে রাখে প্রতিপক্ষকে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে কোরীয় দল যখন সুসংহত, ঠিক তখনই সাব্বিরের নিপুণ কর্নার থেকে দর্শনীয় হেডে গোল করেন আসলাম।

গোল খাওয়ার পর দারুণ চাপ সৃষ্টি করে কোরিয়া। কিন্তু ভাগ্য তাদের পক্ষে ছিল না। কোনো না কোনোভাবে গোল খাওয়া থেকে বেঁচে যায় স্বাগতিক দল। কখনো না ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় গোল পোস্ট। দ্বিতীয়ার্ধের ২৪ মিনিটে একটি ফাউলকে কেন্দ্র করে পেনাল্টির দাবিতে ভারতীয় রেফারি সাগর সেনকে আক্রমণ করেন কোরিয়ান খেলোয়াড়রা। রেফারি কোরিয়ান অধিনায়ক সং জু সুককে লাল কার্ড দেখালে খেলোয়াড়েরা আবারও তাঁকে ধাওয়া করেন। এই ঘটনায় ১১ মিনিট খেলা বন্ধ থাকে। ১০ জন নিয়েও কোরিয়া বাকি সময়টা দারুণভাবে লড়ে যায়। ৩৬ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে কিম বিয়ং সুরের ফ্রি কিকের বল গোলরক্ষক সেলিম ঝাঁপিয়ে ধরার পরও তাঁর হাত থেকে ফসকে যায়। সুযোগসন্ধানী সু জং-ওন চোখের পলকেই গোল করে খেলায় সমতা আনেন। 

ফাইনালে কোরিয়ার গোলমুখে বাংলাদেশ লালের আক্রমণ

নির্ধারিত সময় ১-১ এবং অতিরিক্ত ৩০ মিনিট সময়ও একই ফল থাকে। অতিরিক্ত সময়ে প্রতিপক্ষকে চাপের মুখে রাখলেও গোল করতে ব্যর্থ হন আসলাম, রুমি, সাব্বির, রুপু। সহজ সুযোগ নষ্ট করেন আসলাম। খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। টাইব্রেকারের নায়ক ছিলেন গোলরক্ষক সেলিম। তিনি দুটি শট আটকে দেন। লাল দলের কায়সার হামিদ, আসলাম, রুমি, সাব্বির টাইব্রেকারে গোল করেন। কোরিয়ার প্রথম তিন জন গোল করলেও পরের দুটি শট রুখে দেন সেলিম। লাল দল টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে জয়ী হয়।

টুর্নামেন্টc দারুণ খেলেন সেলিম, ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক কায়সার হামিদ, মোনেম মুন্না, মন্টু, রেহান, জনি, এফ আই কামাল, রূপু, রুমি, সাব্বির, আসলাম। এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দল শিরোপা জয়ের ব্যাপারে মোটেও আত্মবিশ্বাসী ছিল না। প্রতিযোগিতা শুরুর আগে লাল দলের কোচ ও ম্যানেজার সেমিফাইনালে খেলার প্রত্যাশা করেছিলেন। দলের প্রস্তুতিও আশানুরূপ ছিল না। তারপরও ফুটবল অনুরাগীদের দীর্ঘ দিনের মনোবাসনা পূরণ করে লাল দল নামে পরিচিত মূলত বাংলাদেশ জাতীয় দল। 

ফাইনালের টাইব্রেকারে কোরীয় খেলোয়াড়ের পেনাল্টি রুখে দিচ্ছেন বাংলাদেশ লাল দলের গোলরক্ষক সেলিম

তখন তো ফুটবলের আবেগে টগবগ করত পুরো দেশ। যে কোনো পর্যায়ের খেলা হলেই হলো, দর্শকরা তা নিয়ে মেতে উঠতেন।অথচ যে ফুটবল খেলাকে উপলক্ষ করে টইটম্বুর উত্তেজনার জোয়ার বয়ে যেত, তখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ফুটবলে শিরোপা দেখা পাওয়া হয়নি বাংলাদেশের। যে কারণে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় দল না হলেও প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপে বাংলাদেশ লাল দলের শিরোপা জয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেন ফুটবল অনুরাগীরা। আগের ১৮ বছরে ফুটবলের শিরোপা জিততে না পারার বন্ধ্যাত্ব ঘুচে যাওয়াটা উদযাপন করা হয়।    

এক নজরে টুর্নামেন্ট 

বাংলাদেশ লাল ১ (আসলাম) : থাইল্যান্ড ১ (সুয়ান রাখা)

ভারত ১ (পাপ্পাচান) : চীন ১ (মুনউই)

বাংলাদেশ সবুজ ১ (আয়াজ) : দক্ষিণ কোরিয়া ১ (সংজাও সুবা)

ইরান ১ (মাসউদ) :  থাইল্যান্ড ০

দক্ষিণ কোরিয়া ৩ (কিম সাংমুন, কিম সাং হুন-২) : চীন ১ (হুয়াং চো)

বাংলাদেশ সবুজ ১ (ইকবাল) : ভারত ০

বাংলাদেশ লাল ০ : ইরান ০

ভারত ০ : দক্ষিণ কোরিয়া ০

বাংলাদেশ সবুজ ১ (লিকোয়াং-আত্মঘাতী) : চীন ০

সেমিফাইনাল 

বাংলাদেশ লাল ১ (সাব্বির) : বাংলাদেশ সবুজ ০

দক্ষিণ কোরিয়া ৩ (সুজুংউন, সংজুসুধা-২) : ইরান ৩ (মজিদ, মালেহ, মাদেখি)। টাইব্রেকারে দক্ষিণ কোরিয়া ৪-৩ গোলে জয়ী। 

ফাইনাল

বাংলাদেশ লাল ১ (আসলাম) : দক্ষিণ কোরিয়া ১ (সু জুং ওন)
টাইব্রেকারে বাংলাদেশ ৪-৩ গোলে চ্যাম্পিয়ন। টাইব্রেকারে বাংলাদেশের পক্ষে গোল করেন কায়সার হামিদ, আসলাম, রুমি, সাব্বির। 

বাংলাদেশ লাল দল : কানন, সেলিম, লিটন, কায়সার হামিদ, মোনেম মুন্না, রেহান, মন্টু, জনি, রাজ্জাক, ফরহাদ, রুপু, ফখরুল কামাল, মোস্তফা কামাল, রুমি, আসলাম, সাব্বির, জিয়া বাবু, মুস্তাকিম, তুহিন, ওয়াসিম, মাসুদ, ইলিয়াস। প্রথম ম্যাচে আহত হয়ে অধিনায়ক কানন আর খেলতে না পারায় অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন কায়সার হামিদ। কোচ : আবদুস সাদেক। ম্যানেজার : আবদুল মজিদ সানু ।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×