বেইজিংয়ে বোল্ট-বিস্ময়ের ‘ডাবল’
উৎপল শুভ্র
২৭ জানুয়ারি ২০২১
চার দিন আগে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে ১০০ মিটারের সোনা জিতেছেন। এবার জিতলেন ২০০ মিটার এবং বিশ্ব রেকর্ড গড়েই! ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেসে কার্ল লুইসের পর অলিম্পিকে এই প্রথম কারও ‘স্প্রিন্ট ডাবল’। বেইজিং অলিম্পিকে উসাইন বোল্টের এই কীর্তির আসল মহিমা লুকিয়ে অবিশ্বাস্য এক বিশ্ব রেকর্ডে। বার্ডস নেস্টে সেই কীর্তি দেখার পর এই লেখা।
প্রথম প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০০৮। প্রথম আলো।
এক দৌড়েই ট্র্যাকের রেকর্ড-বই থেকে মুছে দিলেন এক কিংবদন্তিকে। আরেকজনকে বাধ্য করলেন দুই যুগ একা বসে থাকা আসনের পাশে জায়গা ছেড়ে দিতে। প্রথমজনের নাম মাইকেল জনসন। দ্বিতীয়জন কার্ল লুইস।
কাল রাতে বার্ডস নেস্টে দুজনই সশরীরে উপস্থিত। বিস্ফারিত চোখে অত্যাশ্চর্য এক দৌড় দেখে কুর্নিশ করতে হলো ট্র্যাকের দুই কিংবদন্তিকে। মেনে নিতে হলো, এই মাত্র যাঁকে দেখলেন, স্প্রিন্টের ইতিহাসে এমন বিস্ময় খুব বেশি আসেনি। উচ্চতা ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি, ওজন ৮৬ কেজি, জন্ম জ্যামাইকার ট্রেলনিতে। নাম—উসাইন বোল্ট!
চার দিন আগে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে ১০০ মিটারের সোনা জিতেছেন। কাল জিতলেন ২০০ মিটার এবং বিশ্ব রেকর্ড গড়েই! ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেসে কার্ল লুইসের পর অলিম্পিকে এই প্রথম কারও ‘স্প্রিন্ট ডাবল’। মাঝের ৫টি অলিম্পিকে কেউ পুনরাবৃত্তি করতে পারেনি, সব মিলিয়ে করেছেন মাত্র নয়জন—এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে এর মহিমাটা। তবে তুলনায় এটা কিছুই নয়, বোল্টের কালকের দৌড়ের আসল মহিমা লুকিয়ে ওই বিশ্ব রেকর্ডে।
১৯৯৬ আটলান্টা অলিম্পিকে মাইকেল জনসনের ওই রেকর্ড আদৌ কোনো দিন ভাঙবে কি না, এ নিয়েই যে সংশয় ছিল। জনসনের সেই দৌড় অ্যাথলেটিকস ইতিহাসের এক বিস্ময় হয়েই ছিল এত দিন। এমনই যে, জেনে আশ্চর্য হবেন, জনসনের প্রতিদ্বন্দ্বীদের কারও পরাজয়ের দুঃখ নেই। ইতিহাসের অংশ হতে পারাটাকেই যে বড় প্রাপ্তি মনে হচ্ছে তাঁদের কাছে। তাঁদের একজন, ব্রোঞ্জজয়ী ত্রিনিদাদের অটো বোল্ডন একবার কথায় কথায় বলেছিলেন, ‘আমি মরে যাব, তা-ও এই রেকর্ড ভাঙবে না।‘ বুড়ো বয়সে বললেও কথা ছিল, বোল্ডনের বয়স তখন ২২। ৩৪ বছর বয়সেই বোল্ডন দেখলেন, প্রতিবেশী এক ক্যারিবীয় দ্বীপের উড়ন্ত এক যুবক কীভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখালেন!
মাইকেল জনসন কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন। ১০০ মিটারে বোল্টের ওই দৌড় দেখার পরই এক যুগ ধরে অধিকারে থাকা রেকর্ডটিকে এক রকম বিদায়ই জানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। ওই দৌড়ের পরের দিন মার্কিন এক সাংবাদিক জনসনের সঙ্গে কথা বলে রীতিমতো চমকে যান। সেদিন সকালেই এক অলিম্পিকে আট সোনা জয়ের রেকর্ড গড়েছেন মাইকেল ফেলপস। সেই প্রসঙ্গ তোলায় জনসন বলে দেন, ‘মাইকেল ফেলপস! কে মাইকেল? এই অলিম্পিকের হিরো একজনই—উসাইন বোল্ট!’
সোনার সংখ্যায় মাইকেল ফেলপস এগিয়ে থাকতে পারেন, রেকর্ড বইয়েও থাকবেন আলাদা একটা অধ্যায় হয়ে, তবে কাল রাতের পর জনসনের কথামতো বেইজিং অলিম্পিকের আসল‘হিরো’ মনে হচ্ছে উসাইন বোল্টকেই। ১০০ মিটার স্প্রিন্ট এমনিতেই অলিম্পিকের সবচেয়ে গ্ল্যামারাস ইভেন্ট। তাতে হেলাফেলায় রেকর্ড গড়াটাই বোল্টকে দর্শকপ্রিয় করে তুলতে যথেষ্ট ছিল। দর্শকপ্রিয়তা আরও বাড়িয়েছে জেতার পর তাঁর ক্যারিবীয় উদযাপন। সেই আমুদে ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হলো কাল।
এদিনও তাঁর নাম ঘোষণার পর কাল্পনিক ধনুক থেকে কাল্পনিক তীর ছুড়েছেন, এর আগে কয়েকবার অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে হাত বুলিয়েছেন মাথায়। ১০০ মিটারের মতো এটিতেও পরিষ্কার ব্যবধানে জয়। মুখে যা-ই বলুন, এখানে সোনার সঙ্গে এত আলোচিত বিশ্ব রেকর্ডটিও ভেঙে দেওয়ার লক্ষ্য ছিল বলেই এবার শেষ পর্যন্ত প্রাণপণে দৌড়েছেন। ১০০ মিটারে ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ড প্রথমে ৯.৬৮ দেখিয়ে ৯.৬৯-এ স্থির হয়েছিল। কাল হলো উল্টো, প্রথমে ১৯.৩১ দেখিয়ে তারপর ১৯.৩০! ১৯.৩১ দেখেই ফেটে পড়েছে ৯১ হাজার দর্শকে ঠাসা বার্ডস নেস্ট। তাতেও যে মুছে যায় মাইকেল জনসনের ১৯.৩২ সেকেন্ডের বিশ্ব রেকর্ড!
১০০ মিটার শেষ করার পর থেমেছিলেন আরও ১৫০ মিটার দৌড়ে। কাল আর তা করলেন না। দৌড়ের রেশটা শেষ হতেই চিত হয়ে শুয়ে পড়লেন ট্র্যাকে। একটু পর উঠে গ্যালারি থেকে জ্যামাইকার একটা পতাকা চেয়ে নিলেন, সেটি গায়ে জড়িয়ে ল্যাপ অব অনার। মাঝেমধ্যেই তা থামিয়ে অদ্ভুত এক নাচ। সোনা দিয়ে মুড়িয়ে রাখার মতো পা দুটিতে সোনালি জুতোই পরেন, নাচতে সুবিধা বলে তা খুলে নিলেন। ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’—বিশ্বজনীন এই গানের সুরের সঙ্গে মিলিয়ে স্টেডিয়ামের লাউড স্পিকারে তখন বাজছে ‘হ্যাপি বার্ডস নেস্ট টু ইউ! কোনোদিন কোনো মানব ১০০ ও ২০০ মিটার দূরত্ব যার চেয়ে দ্রুত পেরোতে পারেনি, সেই তরুণ জায়গায় দাঁড়িয়ে দুই পা কাঁপিয়ে অদ্ভুতভাবে নেচে চলেছেন!
জনসনের দৌড়ে যা হয়েছিল, বোল্টের দৌড়েও প্রতিদ্বন্দ্বীদের একই রকম মোহমুগ্ধ অবস্থা। বোল্টের চেয়ে দশমিক ৫২ সেকেন্ড পর শেষ করে রুপাজয়ী ডাচ অ্যান্টিলিসের চুরান্ডি মার্টিনা (পরে ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে রুপা হারিয়েছেন) তো দৌড়ে গিয়ে বোল্টকে কোলেই তুলে নিলেন। একটু পর এথেন্সে সোনাজয়ী শন ক্রফোর্ডের সঙ্গে মিলে বোল্টকে চ্যাংদোলা করে বয়েও নিয়ে এলেন অনেকটা।
পরের ইভেন্ট মেয়েদের ৪০০ মিটার হার্ডলসের প্রতিযোগীরা ততক্ষণে জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছেন। কে তা খেয়াল করে! দর্শকের চোখ অনুসরণ করে যাচ্ছে কিছু না-কিছু করে যাওয়া বোল্টকেই। এই গ্যালারি মাতিয়ে রাখা লোকদেখানো কি না, সেমিফাইনালের পর এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন,‘একটুও না। এটাই আমি। আমি নাচতে ভালোবাসি, উপভোগ করতে ভালোবাসি। সব সময় এত সিরিয়াস থাকার কী আছে!’ এমন চ্যাম্পিয়ন এর আগে কমই দেখেছে বিশ্ব।
ওহো, একটা কথা বলাই হয়নি। ২০০ মিটারের সোনাটা জিতেছেন ঠিকই, কিন্তু কাল তা উসাইন বোল্টের গলায় ওঠেনি। রুপা আর ব্রোঞ্জ নিয়ে বিতর্কের নিষ্পত্তি হতে হতে যে স্টেডিয়াম খালি! তৃতীয় হয়েছিলেন ওয়ালেস স্পিয়ারমন, কিন্তু নিজের লেন থেকে বেরিয়ে গেছেন বলে তিনি ডিসকোয়ালিফায়েড। যুক্তরাষ্ট্র এ সিদ্ধান্তের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করলেও ভিডিও দেখার পর খারিজ হয়ে গেছে তাদের দাবি। এই ভিডিও দেখতে গিয়েই মার্কিন কর্মকর্তাদের চোখে পড়ে, চুরান্ডি মার্টিনাও একই কাজ করেছেন। সেটি তাঁরা বিচারকদের চোখেও পড়ান। রুপা জয়ের পর যিনি বলেছিলেন, তাঁর দেশ ডাচ অ্যান্টিলিসে আগামী চার বছর উত্সব হবে, সেই মার্টিনাও তাই ডিসকোয়ালিফায়েড। চতুর্থ হয়েই রুপা পেয়ে যাচ্ছেন শন ক্রফোর্ড, পঞ্চম হয়েও ডিক্স ওয়াল্টার ব্রোঞ্জ! এসবের নিষ্পত্তি করতেই ২০০ মিটারের পুরস্কার বিতরণীটা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে এক দিন।
এক দিক থেকে ভালোই হয়েছে। বোল্ট যখন সোনার পদক গলায় পরবেন, বাজানো যাবে ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’--এর আসল সংস্করণটাই। আজ যে উসাইন বোল্টের জন্মদিন!