রোমান সানা পারেননি, রোমান সানা পেরেছেন
উৎপল শুভ্র
২৭ জুলাই ২০২১
রোমান সানা পারেননি, আবার রোমান সানা পেরেছেনও। পরস্পরবিরোধী মনে হচ্ছে? রোমান সানা যে টোকিও অলিম্পিকে পদকের ধারেকাছেও যেতে পারেননি, তা তো সবারই জানা। তারপরও একটা কাজ তো করতে পেরেছেন। অলিম্পিকে পদক পাওয়ার স্বপ্নের কথা ছড়িয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে।
‘তীর গো ফর গোল্ড’ স্লোগান নিয়ে আর্চারির পাশে দাঁড়িয়েছিল সিটি গ্রুপ। ‘গোল্ড’ আর্চারি অনেকগুলোই দিয়েছে, এর মধ্যে সর্বশেষ এস এ গেমসে ১০টি ইভেন্টের ১০টিতেই। কিন্তু সিটি গ্রুপের স্বপ্নটা ছিল অনেক বড়। ইতিহাসের কথা মনে রাখলে সাহসীও।সুনির্দিষ্টভাবে টোকিও অলিম্পিকের কথা উল্লেখ করেই ঘোষণা করা হয়েছিল সোনা জয়ের লক্ষ্যের কথা। সেই স্বপ্নের ধারক হয়ে উঠেছিলেন রোমান সানা।
এবার অলিম্পিক শুরুর আগে সিটি গ্রুপের কাছ থেকে দুই আর্চার রোমান সানা ও দিয়া সিদ্দিকীকে শুভকামনা জানিয়ে একটা ভিডিও বার্তার অনুরোধ এলো আমার কাছে। তাতে কী বলা যেতে পারে, এর একটা খসড়াও। স্লোগান যেহেতু ‘গো ফর গোল্ড’, রোমান সানা আর দিয়া সিদ্দিকীর কাছে সেটিই চাইতে বলা হয়েছিল তাতে।
কিন্তু আমি তা কীভাবে বলি! অলিম্পিক কত বড় মঞ্চ, আগে থেকেই জানতাম। আরও বেশি জেনেছি, ২০০৪ এথেন্স থেকে ২০১৬ রিও পর্যন্ত টানা চারটি অলিম্পিক কাভার করে। সর্বশেষ দুটিতে অন্য দেশের সাংবাদিককে ইন্টারভিউও দিতে হয়েছে। বিষয়টা মোটেই প্রীতিকর কিছু না। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ, যারা কখনো অলিম্পিকে কোনো পদক জেতেনি...এই রেকর্ডের কথা জানার পর বাংলাদেশের সাংবাদিকের কাছ থেকে সেটির কারণ খোঁজার চেষ্টা আর কি! আমি খুব সংক্ষেপেই তা সেরে ফেলেছিলাম। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সার্বিক অবস্থা একটু বলে সেই অলিম্পিকে বাংলাদেশের অ্যাথলেটদের প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতির কথা জানাতেই ইন্টারভিউ নিতে আসা সাংবাদিকের কৌতূহল শেষ। একটা কমন প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘তাহলে আর তোমরা পদক জিতবে কিভাবে!’
অলিম্পিকগামী বাংলাদেশের দুই আর্চারকে আমি তাই শুভকামনা জানালাম ঠিকই, তবে সোনার দাবি একদমই নয়। বরং অগৌরবের ওই রেকর্ড মনে করিয়ে দিয়ে বললাম, ‘যে দেশ কখনো অলিম্পিকে কোনো পদকই পায়নি, সেখানে তোমাদের কাছে সোনার প্রত্যাশা করাটা অন্যায়ই হয়ে যায়।’ তবে একটা কথা ভেবে আমার খুব ভালো লাগছিল। সেই ১৯৮৪ লস অ্যালেঞ্জেস থেকে বাংলাদেশ যেখানে শুধুই অংশ নেওয়ার জন্যই অংশ নেয়, সেখানে এই প্রথম পদক বিষয়ক আলোচনা শুনছি। যেকোনো স্বপ্ন পূরণ হওয়ার জন্য আগে তো স্বপ্নটা দেখতে হবে। আর্চারি আর সিটি গ্রুপ তো অন্তত সেই স্বপ্নের কথা সাহস করে বলতে পেরেছে।
অলিম্পিক সোনার আশাটা তো বাড়াবাড়িই, আপাতত যেকোনো রংয়ের একটা পদকের আশারও সমাধি হয়েছে। মিশ্র দ্বৈতের চূড়ান্ত পর্বে কোয়ালিফাই করে সেখানে প্রথম রাউন্ডেই হেরে গেছে বাংলাদেশের জুটি। যা ছিল পূর্ব অনুমিতই। প্রতিপক্ষ আর্চারির সুপার পাওয়ার দক্ষিণ কোরিয়া, শেষ পর্যন্ত সোনাও জিতেছে রোমান-দিয়াকে হারানো সেই দুই দক্ষিণ কোরিয়ানই।
রোমান সানার টোকিও অলিম্পিকও শেষ হয়ে গেল আজ। প্রথম রাউন্ডে জিতেছিলেন, দ্বিতীয় রাউন্ডে হেরে গেছেন। অলিম্পিকের বিশাল ক্যানভাসে রোমান সানা তাই ছোট্ট একটা বিন্দুও হয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু একটু অন্যভাবে ভেবে দেখুন তো! মিশ্র দ্বৈত নিয়ে ওই যে কোয়ালিফাই করা, প্রথম রাউন্ডে রোমান সানার জয়...এসবই যে বাংলাদেশের অলিম্পিক ইতিহাসে প্রথম। পৃথিবীর দীর্ঘতম যাত্রাটাও শুরু হয় ছোট একটা পদক্ষেপ দিয়ে। অলিম্পিক পদকের পথে সেই যাত্রার শুরু হিসেবেই এটিকে ধরুন না!
ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে রোমান সানা এখন ২৫ নম্বরে, তার মানে তো কাগজে-কলমে রিকার্ভে তাঁর চেয়ে ভালো আরও ২৪ জন আর্চার আছে পৃথিবীতে। তাঁদের সবাই এই অলিম্পিকে আছে বলেই ধরে নিচ্ছি। কোনো প্রতিযোগিতাই র্যাঙ্কিং মেনে হয় না। হলে তো র্যাঙ্কিংয়ে এক-দুই-তিনকেই সোনা-রুপা-ব্রোঞ্জ দিয়ে দেওয়া হতো। তবে এটাও তো সত্যি, রোমান সানা অলিম্পিকে পদক জিতে গেলে একটা-দুটি নয়, বেশ কয়েকটা অঘটন ঘটাতে হতো।
খেলায় অঘটন কখনো কখনো হয় না, তা নয়। ওয়ার্ল্ড আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে রোমান সানার ব্রোঞ্জ জেতাও তো অঘটনই ছিল। যা জয়ের পথে র্যাঙ্কিংয়ে তাঁর ওপরে থাকা একাধিক প্রতিযোগীকে হারিয়েছিলেন তিনি। তবে শুধু অঘটনের ওপর ভরসা করে অলিম্পিকে পদক জেতার স্বপ্ন দেখা আর কাল সকালেই পৃথিবী থেকে করোনা অদৃশ্য হয়ে যাবে ভাবা একই কথা।
অলিম্পিকে পদক জিততে হলে কী করতে হয়, সেই উদাহরণ তো বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে বলে পাশের দেশের দিকে তাকানোই ভালো। ভারতও একটা দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের মতোই অলিম্পিকে শুধুই অংশ নেওয়ার জন্যই অংশ নিত। হকির কল্যাণে এক সময় অলিম্পিকে সোনার পদক বাঁধাই ছিল, সেই রাজত্ব শেষ হওয়ার পর শূন্য হাতে ফেরাটাই ছিল নিয়তি। ব্যক্তিগত পদকের স্মৃতি মনে করতে ভারতীয়দের ফিরে যেতে হতো সেই ১৯৫৬ সালে। ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে রাজ্যবর্ধন রাঠোর শ্যুটিংয়ে রুপা জিতে সেই বন্ধ্যাত্ব ঘোচানোর পর থেকে ভারত পদকের আশা নিয়েই অলিম্পিকে যায় এবং তা জেতেও।
বাংলাদেশে কোনো খেলাকে ঘিরেই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেই, অ্যাথলেটদের আর্থিক নিশ্চয়তা নেই, নেই বছরব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি...এসব যত দিন না হবে, ততদিন ওই অগৌরবের রেকর্ড বাংলাদেশেরই থেকে যাবে।
আশা নিয়ে গেলেই তো আর তা পূরণ হয়ে যায় না। সেই আশা পূরণের জন্য অনেক কিছু করতে হয়। ভারত কী করে, তা জানলেই আপনি আর অলিম্পিকে বাংলাদেশের অ্যাথলেটদের নিয়ে হাসাহাসি করবেন না। বরং আপনার মায়াই লাগবে ওদের জন্য। সিটি গ্রুপ যেমন আর্চারির জন্য এগিয়ে এসেছে, ভারতে এমন অসংখ্য কর্পোরেট হাউস যুক্ত হয়েছে অলিম্পিক স্পোর্টগুলোতে। একটা অলিম্পিক শেষ হয়ে যেতে না যেতেই শুরু হয়ে যাচ্ছে পরের অলিম্পিকের জন্য প্রস্তুতি। বাংলাদেশে যা এখনো শুধু কল্পনাই।
টোকিও অলিম্পিকে শুধু আর্চারিই নয়; অ্যাথলেটিকস, সাঁতার, শ্যুটিংয়ের মতো আরও কিছু খেলাতেও অংশ নিচ্ছে বা নিয়েছে বাংলাদেশ। আর্চারি আর রোমান সানার কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করলাম, একমাত্র রোমান সানাই নিজের যোগ্যতায় অলিম্পিকে যাওয়ার সুযোগটা আদায় করে নিয়েছেন বলে। সিটি গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতার কল্যাণে প্রশিক্ষণ বা প্রস্তুতির দিক থেকেও হয়তো আর্চাররাই এগিয়ে। কিন্তু তারপরও যাঁরা পদক জিতেছেন, তাঁদের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, তা কতটা অপর্যাপ্ত।
বাংলাদেশে কোনো খেলাকে ঘিরেই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেই, অ্যাথলেটদের আর্থিক নিশ্চয়তা নেই, নেই বছরব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি...এসব যত দিন না হবে, ততদিন ওই অগৌরবের রেকর্ড বাংলাদেশেরই থেকে যাবে। চারটি অলিম্পিকে বাংলাদেশের প্রতিযোগীদের মুখে একটা মুখস্থ বুলিই শুনে এসেছি, 'নিজের সেরা পারফরম্যান্স করতে চাই।' অনেকে তা করেছেনও। করার পর যথারীতি আক্ষেপ শুনেছি। অলিম্পিকে গিয়ে অন্য দেশের অ্যাথলেটদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়, তাদের প্রস্তুতির কথা শোনেন আর বাংলাদেশের অলিম্পিয়ানদের দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
আসিফ আহমেদ খানের গল্পটাই শুধু ্আজ বলি। আসিফ শ্যুটিংয়ের সহজাত প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন। নইলে ১৫ বছর বয়সে কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জেতেন কীভাবে! কিন্তু কমনওয়েলথ গেমস যদি নদী হয়, অলিম্পিক হলো সাগর। যে স্কোর (৫৮৭) করে কমনওয়েলথে সোনা জিতেছিলেন, ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে একই স্কোর করে আসিফকে তাই ৪৭ জনের মধ্যে ৩৫তম হতে হয়েছিল। যাঁকে হারিয়ে কমনওয়েলথে সোনা জিতেছিলেন, সেই অভিনব বিন্দ্রা ফাইনালে উঠে সপ্তম হয়েছিলেন। চার বছর পরের বেইজিং অলিম্পিকে তো সোনাই জিতে ফেলেন।
আসিফের সঙ্গে বিন্দ্রার খুব বন্ধুত্ব ছিল। জার্মানির শ্যুটিং স্কুলে সহপাঠী হওয়ার কারণে যে বন্ধুত্ব আরও জমাট হয়। এবার শুনুন আসল কথাটা। আসিফকে ওই শ্যুটিং স্কুলে পাঠানো হয়েছিল ৫০ দিনের জন্য, যেখানে বিন্দ্রা ছিলেন টানা সাত বছর! আসিফের সঙ্গে কোনো মনোবিদ থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না, ব্যক্তিগত কোনো কোচও ছিল না। যেখানে বিন্দ্রার দেশি-বিদেশি মিলিয়ে চারজনের একটা কোচিং সেল। যাঁরা নিজেরা আলাপ-আলোচনা করে তারপর চূড়ান্ত পরামর্শটা বিন্দ্রার কাছে তুলে ধরতেন।
এথেন্সের হতাশার পরও বেইজিং অলিম্পিক নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন আসিফ। ওটা তো স্বপ্ন দেখারই বয়স। অথচ দুই বছর পর শ্যুটিং কমপ্লেক্সে পুলিশের বেধড়ক পিটুনি খাওয়ার পর তাঁর জীবনটাই এলোমেলো হয়ে যায়। তা না হলেও বেইজিংয়ে তাঁর স্বপ্ন পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কমই ছিল। আর্থিক নিরাপত্তা, নিরবিচ্ছিন্ন প্রশিক্ষণ, নিয়মিত বড় টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া...অলিম্পিক-সাফল্যের আবশ্যিক যেসব শর্তের কথা বললাম, তা কি পূরণ করা হয়েছিল নাকি!
বাংলাদেশের অলিম্পিক নিয়ে কথা বলার সময় তাই কানে বাজে মোহন খানের কথাটা। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে দৌড়ানোর পর বাংলাদেশের দ্রুততম মানব তাঁর সবচেয়ে বড় তৃপ্তির কথা কী বলেছিলেন, জানেন? ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডে নিজের টাইমিংটা জানতে পারা!
এসব ইতিহাস জানা আছে বলেই রোমান সানা পদক থেকে অনেক দূরে থেমে যাওয়ার পরও আমি এই অলিম্পিক থেকে ইতিবাচক কিছু খুঁজে পাই। অন্তত পদক পাওয়ার স্বপ্নের কথাটা তো সাহস করে বলতে পেরেছে আর্চারি। এটাই তো আমরা আগে কখনো শুনিনি।