ভয়ের রিও
রিও ২০১৬ অলিম্পিকের দিন–রাত
উৎপল শুভ্র
২০ জুলাই ২০২১
ঢাকার যানজট নিয়ে আমরা এমন তিতিবিরক্ত, তবে বিশ্বের সবচেয়ে যানজটপ্রবণ শহরের শীর্ষ তালিকায় কিন্তু ঢাকার নাম নেই। এখানে আসার আগে রিও ডি জেনিরো নিয়ে একটু পড়াশোনা করতে গিয়ে যা জানলাম। ফোর্বস-এর একটা জরিপেই বোধ হয় দেখেছিলাম, যানজটের দিক থেকে রিও
প্রথম প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো
ঢাকার যানজট নিয়ে আমরা এমন তিতিবিরক্ত, তবে বিশ্বের সবচেয়ে যানজটপ্রবণ শহরের শীর্ষ তালিকায় কিন্তু ঢাকার নাম নেই। এখানে আসার আগে রিও ডি জেনিরো নিয়ে একটু পড়াশোনা করতে গিয়ে যা জানলাম। ফোর্বস-এর একটা জরিপেই বোধ হয় দেখেছিলাম, যানজটের দিক থেকে রিও চার নম্বরে বসে আছে! ওপরে আছে শুধু ইস্তাম্বুল, ব্যাংকক ও মেক্সিকো সিটি।
এখানে আসার পর সেটির প্রমাণ অবশ্য সেভাবে পাইনি। যানজটে আটকে থাকার অভিজ্ঞতা হয়নি বললেই চলে। এর কারণ হয়তো অলিম্পিকের জন্য রাস্তায় আলাদা লেন করে দেওয়া। গণপরিবহনে উঠলে নিশ্চয়ই ওই জরিপের মাহাত্ম্য বুঝতে পারতাম। অলিম্পিক লেন দিয়ে নির্বিঘ্নে যাওয়ার সময় পাশের রাস্তাতেই তো দেখেছি, বাস-ট্যাক্সি লাইন ধরে দাঁড়িয়ে।
যানজট সমস্যা নয়, তবে সম্প্রতি নতুন একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। রাতে চলাফেরা করতে একটু ভয়ই লাগছে। যেটির কারণ সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা। রিওর অপরাধপ্রবণতা নিয়ে কুখ্যাতি আছে, তবে বিশ্বের অনেক শহরই এখানে রিওর চেয়ে এগিয়ে। এমনকি ব্রাজিলের সবচেয়ে বিপজ্জনক শহরও এটি নয়। এসব তো আর সব নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানার উপায় নেই। এখানেও আরেকটি জরিপই ভরসা। যেটিতে বিশ্বের সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ ৫০টি শহরের তালিকা করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্রাজিলের শহরই ১৫টি। কী আশ্চর্য, এর মধ্যে রিও নেই!
তালিকাটা দেখে বড় শান্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু রায়ান লোকটির ঘটনার পর যা কর্পূরের মতো উবে গেছে। দিন কয়েক আগে অস্ট্রেলিয়ান সাঁতারু তাঁর আরও তিন সতীর্থসহ পার্টি করে ভোররাতে ট্যাক্সিতে ফিরছিলেন। পুলিশ বেশে ছিনতাইকারীর দল সেই ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে বন্দুকের মুখে তাঁদের কাছ থেকে মানিব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে গেছে। ঘটনাটা সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রথম ফাঁস করেছিলেন লোকটির মা। অলিম্পিক কমিটি শুরুতে যা মানতেই চায়নি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জানা গেছে, ঘটনা সত্যি। লোকটির ভাষ্যও পাওয়া গেছে।
এই অলিম্পিকে মন্ত্রীদের দিকে অপরাধীদের বিশেষ নজর আছে বলে মনে হচ্ছে। কদিন আগে পর্তুগালের শিক্ষামন্ত্রী এদের কবলে পড়েছিলেন। এবার জানা গেল, বুলগেরিয়ার ক্রীড়ামন্ত্রীও অলিম্পিক স্টেডিয়ামে ঢোকার সময় ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। সব বড় শহরেই এসব হয়। তবে ‘অলিম্পিক নগর’ বলে রিওর এসব ঘটনা বেশি প্রচার পাচ্ছে। রিওবাসী অবশ্য এসবে অভ্যস্তই। রাস্তায় চুরি-ছিনতাই এখানে নাকি নিত্যদিনের ঘটনা। অপরাধপ্রবণ শহরের যে তালিকার কথা বললাম, সেটি বোধ হয় খুনের হিসাব নিয়ে করা। ছিঁচকে অপরাধ সেখানে ধরা হয়নি। নইলে রিওর এত পরে থাকার কথা নয়।
খুনাখুনিটা রিওতেও নাকি একসময় ভালোই হতো। ফাভেলাগুলো ছিল অপরাধীদের আখড়া। পুলিশি অভিযান ও ফাভেলাবাসীকে সভ্যভব্য করার চেষ্টায় সেসব আর আগের মতো ভয়ংকর নেই। রোমাঞ্চপ্রিয় পর্যটকদের অনেকে এখন সেখানে ‘ব্রেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট’ থাকেনও। তারপরও কিছু ফাভেলা নাকি এখনো আগের মতোই অনিরাপদ। গত রোববার রাতেই অলিম্পিক স্টেডিয়াম থেকে কোপাকাবানার অ্যাপার্টমেন্টে ফেরার সময় ট্যাক্সি একটা রাস্তায় পড়তেই চালক জানালেন, এই রাস্তাটা একটুও নিরাপদ নয়। পাশেই কী একটা ফাভেলা। এখানে ট্যাক্সি থামলেই বিপদ। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারেন। তবে তা এমন নয় যে, ‘জানা থাকার পরও বিপজ্জনক এই রাস্তায় কেন এলি’—মনে গুঞ্জরিত এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। প্রশ্নটা তাই আর করলামই না। দুরু দুরু বুকে রাস্তাটা পার হওয়ার পর হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
‘ফাভেলা’র কাছাকাছি বাংলা হয় বস্তি। যদিও বস্তি বলতে আমরা যা বুঝি, ফাভেলা তেমন নয়। পাহাড়ের গায়ে গায়ে উঠে যাওয়া ছোট ছোট ঘর, যার সবই পাকা দালান। পাহাড়ের যত ওপরে ঘর, ততই সস্তা। রিও নিয়ে একটা কৌতুকও আছে। এখানে যারা সবচেয়ে গরিব, তারা থাকে সবচেয়ে ওপরে। যার যত টাকা, সে থাকে তত নিচে। নিচে মানে সমুদ্রসৈকতের কাছাকাছি আর কি! কোপাকাবানা ও ইপানেমা আগে থেকেই বিখ্যাত। গত কিছুদিন লেবনন সৈকতও খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই তিন সৈকতের কোনোটির পাশে একটা অ্যাপার্টমেন্ট না থাকলে রিওর অভিজাত সমাজে মুখ দেখানো যায় না।
রিওতে এসে কোপাকাবানা ও ইপানেমায় একবার ঘুরে না গেলে রিও-দর্শনও যেন সম্পন্ন হয় না। সাগরে স্নানার্থীরা তো দিনের বেলায়ই ভিড় করে। তবে ঘুরে বেড়ানোর জন্য সবচেয়ে ভালো রাত। অথচ লোকটি-দুর্ঘটনার পর অস্ট্রেলিয়ার অলিম্পিক দলের জন্য রাতের বেলাই কিনা ‘কারভিউ’ জারি হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত অস্ট্রেলীয় অ্যাথলেটদের জন্য কোপাকাবানা ও ইপানেমা নিষিদ্ধ।
এই কোপাকাবানাতেই রাত একটা-দেড়টার সময় নামি। মিডিয়া বাসে এলে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে একটু দূরেই। হেঁটে আসতে অবশ্য মাত্র কয়েক মিনিটই লাগে। রাস্তায় তখনো লোকজন ভালোই থাকে। এত দিন একদমই ভয়টয় লাগেনি। লোকটির ঘটনার পর একটু একটু লাগে।