বোল্ট আর নেই সেই বোল্ট!
উৎপল শুভ্র
৬ এপ্রিল ২০২১
মাত্রই ১০ সেকেন্ড! দশবার চোখের পাতা ফেলতেই তো এটুকু সময় লাগে। সেটিকে ঘিরে কেন এমন উন্মাদনা, তা ভেবে মাঝেমধ্যে একটু বিস্ময়ই লাগে।\r\n\r\n১০০ মিটার জিতলে একটি সোনা, ম্যারাথন জিতলেও। তারপরও ১০০ মিটারে জয়ীই কেন অলিম্পিক বা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের মুখ হয়ে যান!
প্রথম প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো।
মাত্রই ১০ সেকেন্ড! দশবার চোখের পাতা ফেলতেই তো এটুকু সময় লাগে। সেটিকে ঘিরে কেন এমন উন্মাদনা, তা ভেবে মাঝেমধ্যে একটু বিস্ময়ই লাগে।
১০০ মিটার জিতলে একটি সোনা, ম্যারাথন জিতলেও। তারপরও ১০০ মিটারে জয়ীই কেন অলিম্পিক বা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের মুখ হয়ে যান! কেন অলিম্পিকে ২৩টি সোনা জিতেও মাইকেল ফেলপস বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত অ্যাথলেট নন! সবচেয়ে দ্রুত দৌড়াতে পারার এমন কী মহিমা! সেটি কি বিপদ থেকে বাঁচতে দ্রুতগতিতে দৌড় দেওয়াটা মানুষের আদিমতম প্রবৃত্তি বলে?
গত পরশু রাতে অলিম্পিক স্টেডিয়ামমুখী জনস্রোত দেখতে দেখতে এই ভাবনাটা আবার মনে এল। যদিও তা নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবার মতো অবস্থা নেই। বাসে প্রায় মিনিট পঁয়ত্রিশ দূরত্বের মেইন প্রেস সেন্টার থেকে পিলপিল করে সাংবাদিক বেরোচ্ছেন ১০০ মিটার দেখবেন বলে। যেটি শুরু হতে তখনো সাড়ে তিন ঘণ্টারও বেশি বাকি। অথচ এই প্রথম এমপিসি থেকে কোনো ভেন্যুতে যাওয়ার বাসে উঠতে লাইন। যা দেখে একটু দুশ্চিন্তায়ই পড়ে গেলাম। অলিম্পিক স্টেডিয়ামে গিয়ে পছন্দমতো দূরে থাক, বসার জায়গা পাব তো!
অলিম্পিকে যে ইভেন্টগুলো নিয়ে সাংবাদিকদের বেশি আগ্রহ, ‘হাই ডিমান্ড’ নাম দিয়ে সেগুলোর জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করে আইওসি। এগুলোয় শুধু অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেখিয়েই প্রেস ট্রিবিউনে ঢোকা যায় না, সঙ্গে ওই টিকিটটাও লাগে। উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠান, সাঁতারের সব ফাইনাল, আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিকসে মেয়েদের দলগত ও ব্যক্তিগত অল-অ্যারাউন্ড যেমন এবার ‘হাই ডিমান্ড’-এর মর্যাদা পেয়েছে। মানে আমাদের মতো যেসব দেশের সাংবাদিকদের অলিম্পিকে শুধু অংশ নেওয়ার জন্যই অংশ নেওয়া, তাঁদের জন্য যন্ত্রণা আর কী! দেশওয়ারি টিকিট বরাদ্দ করা হয়, যাতে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের নাম থাকে না। বেঁচে যাওয়া টিকিটের আশায় সেসব দেশের সাংবাদিকদের লাইন দিতে হয় ইভেন্ট শুরুর ঘণ্টা তিনেক আগে।
‘হাই ডিমান্ড’ বললে ১০০ মিটারের ধারেকাছেও অন্য কোনো ইভেন্ট আসে না। তবে একটাই শান্তি, এটার জন্য কখনোই আলাদা কোনো টিকিট লাগে না। অলিম্পিক স্টেডিয়ামে সাংবাদিকদের বসার জায়গাটা অনেক বড়। আগ্রহী সবারই মোটামুটি বসার ব্যবস্থা হয়ে যায়। তবে সেটির ভালো-মন্দ তো আছেই। বেইজিং অলিম্পিকে উসাইন বোল্টের বিখ্যাত ওই উদ্যাপন যেমন খুব কাছে থেকে দেখতে পেরেছিলাম। ওপর থেকে প্রেস ট্রিবিউন নেমে গিয়েছিল একেবারে মাঠের সীমানা পর্যন্ত। আমি এমন জায়গায় বসেছিলাম যে, মনে হচ্ছিল বোল্ট বোধ হয় আমাকে দেখাতেই এত বিচিত্র সব অঙ্গভঙ্গি করছেন!
রিওর অলিম্পিক স্টেডিয়ামে সেই সুযোগ নেই। প্রেস ট্রিবিউন প্রায় মহাকাশের কাছাকাছি। ওখান থেকে নামতে নামতে যেখানে শেষ হয়েছে, সেটিও প্রায় তিনতলা উচ্চতায়। সামনে টেবিল আছে, এমন আসনগুলো সবার ওপরে। সেগুলোয় বসার স্বাচ্ছন্দ্য বাদ দিয়ে তাই শুধু চেয়ারে বসলাম। ঠিক ফিনিশিং লাইনের আড়াআড়ি। জেতার পর বোল্ট কী করেন, ভালোভাবে তা দেখতে হবে না!
এর চেয়েও বেশি আগ্রহ ছিল সংবাদ সম্মেলনে বোল্ট কী করেন, তা নিয়ে। ইভেন্ট শেষে যেখান দিয়ে বেরোতে বেরোতে অ্যাথলেটরা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন, সেটিকে বলে মিক্সড জোন। কোমর সমান উচ্চতার বেষ্টনীর ওপার দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে অ্যাথলেটরা বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়ান এবং সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন। পদকজয়ীদের জন্য আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন তো আছেই এর পর। গত পরশু রাতে মিক্সড জোনেও গিজগিজে ভিড়। বোল্টের জন্য সাংবাদিকেরা ঠায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু তাঁর দর্শক মনোরঞ্জনই তো শেষ হয় না! বোল্ট এলেন ১০০ মিটার শেষ হওয়ার প্রায় দুই ঘণ্টা পর।
মনোরঞ্জনের কাজটা তিনি সংবাদ সম্মেলনেও করেন। যদিও গত পরশুর সংবাদ সম্মেলনের পর বলতে হচ্ছে ‘করতেন!’ বেইজিং আর লন্ডন অলিম্পিকের আমুদে, কখনো বা খ্যাপাটে রূপের বোল্টকে যে খুঁজেই পেলাম না।
বেইজিংয়ে ১০০ মিটার জয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে সবচেয়ে মজার অংশটা ছিল তাঁর প্রস্তুতি-সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর। সকালে উঠে নাগেটস খেয়েছেন, তারপর কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে ওঠার পর আবারও নাগেটস, স্টেডিয়ামে আসার পরও নাগেটস—বোল্ট বলেন আর হাসির রোল ওঠে। এদিন একই রকম একটা প্রশ্নের জবাবে বললেন, তাঁর খাদ্যতালিকায় এখন শুধু নুডলস আর চিকেন।
যেটিকে প্রতীকী বলে মনে হলো। অস্বাস্থ্যকর নাগেটস আর স্বাস্থ্যসম্মত নুডলস ও চিকেনের মধ্যে যে পার্থক্য, আগের দুটি অলিম্পিকে বোল্টের সংবাদ সম্মেলনগুলোর সঙ্গেও এই রাতের সংবাদ সম্মেলনের একই রকম পার্থক্য। মজা যে একদমই করলেন না, তা নয়। তিনি ঢুকতেই হালকা একটা করতালির শব্দ উঠল। সেদিকে তর্জনী তুলে সমর্থনের একটা হাসি দিলেন। একপাশে গ্যাটলিন, অন্যপাশে ব্রোঞ্জজয়ী আন্দ্রে গ্রাস। বেইজিংয়ে বোল্টের দুনিয়া কাঁপানো আবির্ভাবের সময় যিনি ১৩ বছরের বালক। গ্রাসের সঙ্গে খুনসুটি করলেন মাঝেমধ্যেই। ফিসফিস করে কী যেন বলেন আর গ্রাসের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তবে লন্ডনে ইয়োহান ব্লেকের সঙ্গে যা করেছিলেন, তার তুলনায় এটি কিছুই না।
বাংলাদেশের সাংবাদিকদের যাঁরা বোল্টকে প্রথম দেখছেন, তাঁরা অবশ্য এতেই মুগ্ধ। তবে আমি একটু হতাশই হলাম। লন্ডনে বোল্টের তিনটি সংবাদ সম্মেলনই রূপ নিয়েছিল আনন্দমেলায়। প্রায় প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরেই মিশে ছিল কৌতুক। এবার বোল্ট আচরণে যেমন, কথাবার্তায়ও অনেক সিরিয়াস। যা দেখে এই প্রথম মনে হলো, বোল্টেরও বয়স হয়েছে!