ফ্লো-জোর পর প্রথম ‘স্প্রিন্ট ডাবল’
২০১৬ রিও অলিম্পিক
উৎপল শুভ্র
২০ জুলাই ২০২১
এলেইন থম্পসন অলিম্পিকে এসেছিলেন মসৃণভাবে দৌড় শেষ করতে চাওয়ার স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্ন তো পূরণ হয়েছিলই, অলিম্পিক ফ্লোরেন্স গ্রিফিথ জয়নারের পর কোনো মেয়ের প্রথম স্প্রিন্ট ডাবল-ও দেখেছিল থম্পসনের পায়ে।
প্রথম প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো।
সমাপ্তিরেখা পেরোনোর সময়ই মুখ হাঁ হয়ে গেল বিস্ময়ে। সেই বিস্ময় যেন আর কাটছিলই না এলেইন থম্পসনের। ট্র্যাকে শুয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। এরপর আলোকচিত্রীরা যেখানে বসেন, তার সামনে গিয়ে বজ্রাহতের মতো হাতে মাথা রেখে বসে রইলেন বেশ খানিকটা সময়। তারপর শুয়ে পড়লেন আবারও। রুপাজয়ী ড্যাফনে শিপার্স যখন অভিনন্দন জানাতে এলেন, তখনো তিনি শুয়ে।
চার দিন আগে ১০০ মিটারের সোনা জিতেছেন। রিওর বুধবার রাতে ২০০ মিটারও জিতে এই গ্রহের দ্রুততম মানবী কে, ঝেঁটিয়ে দূর করে দিলেন এ নিয়ে সব সংশয়। রিলের সোনাটাও থম্পসনের জ্যামাইকাই পাবে বলে ধরে রেখেছেন সবাই। তা হলে জীবনের প্রথম অলিম্পিক থেকেই ৩টি সোনা নিয়ে দেশে ফিরবেন। অথচ রিওতে নাকি একটি সোনার আশা নিয়েও আসেননি থম্পসন! জ্যামাইকার অলিম্পিক ট্রায়ালে হ্যামস্ট্রিংয়ে পাওয়া চোট বড় স্বপ্ন দেখতে দেয়নি। অলিম্পিকে তাঁর চাওয়া বলতে ছিল ‘যতটা সম্ভব মসৃণভাবে দৌড়ানো।’
তা করতে গিয়েই ফ্লোরেন্স গ্রিফিথ জয়নারের পর কোনো মেয়ের প্রথম ‘স্প্রিন্ট ডাবল’। ১৯৮৮ সিউল অলিম্পিকে ফ্লো-জোর ওই কীর্তির চার বছর পর জন্ম থম্পসনের। ইউটিউবে তাঁর দৌড় দেখেছেন। তবে ফ্লো-জো তাঁর প্রেরণার নাম নয়। নিজের দেশেই যে অনেক ‘রোল মডেল’। ভেরোনিকা ক্যাম্পবেল-ব্রাউন ও শেলি-অ্যান ফ্রেজার-প্রাইসদের কীর্তি দেখতে দেখতে বড় হয়েছেন। থম্পসনের প্রেরণার উৎস হয়ে ছিলেন এই দুজনই। শেলি-অ্যানের কাছ থেকে ১০০ মিটারের মুকুট কেড়ে নিয়েছেন। ‘ডাবল’ জিতে এখন সত্যিকার অর্থেই ট্র্যাকের রানি ২৪ বছর বয়সী এই জ্যামাইকান।
যে স্কুলে পড়েছেন, শিক্ষার্থীদের উদ্দীপ্ত করতে সেটির মন্ত্র, ‘লেট দ্য লাইট শাইনস্।’ তা জানিয়ে থম্পসন ঘোষণা করে দেন, ‘আজ আমি আমার আলোও জ্বলজ্বল করিয়েছি ট্র্যাকে।’ জ্যামাইকার অলিম্পিক ট্রায়ালেই হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়েছিলেন উসাইন বোল্টও। তা নিয়ে পুরো বিশ্বেই কী আলোড়ন! থম্পসনের চোটের খবর বাইরের কেউ রাখেনি। নিজেকে ফিট করে তুলতে সেই সংগ্রামের সময়টা মনে করে থম্পসন তাই যৌক্তিক দাবি করেন, ‘আমি একজন যোদ্ধা। আমার ভেতরটা খুব শক্ত।’
২০০ মিটার এবার নতুন এক চ্যাম্পিয়ন পাবে, এটা জানাই ছিল। লন্ডন অলিম্পিকে জয়ী অ্যালিসন ফেলিক্স যুক্তরাষ্ট্রের ট্রায়ালে বাদ পড়েছেন। এর আগের দুই অলিম্পিকের চ্যাম্পিয়ন ভেরোনিকা ক্যাম্পবেল-ব্রাউন বাদ পড়েছেন হিটেই। তবে থম্পসন নন, ফেবারিট ছিলেন শিপার্সই। গত বছর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে থম্পসনকে হারিয়েই সোনা জিতেছেন মেয়েদের ইতিহাস-সেরা ২০০ মিটারে। যাতে ইতিহাসের চতুর্থ সেরা টাইমিং (২১.৬৩) শিপার্সের। ষষ্ঠ সেরা সময় (২১.৬৬) করে রুপা জিতেছিলেন থম্পসন। ব্রোঞ্জজয়ী ক্যাম্পবেল-ব্রাউন শেষ করেছিলেন ২১.৯৭ সেকেন্ডে। মেয়েদের ২০০ মিটারে তিনজনের ২২ সেকেন্ডের কমে দৌড়ানোর একমাত্র ঘটনা এটি।
এখানেও থম্পসনের লড়াইটা হলো শিপার্সের সঙ্গেই। যে শিপার্স ফিরিয়ে এনেছিলেন ফ্যানি ব্ল্যাংকার্স-কোয়েনের স্মৃতি। ২০০ মিটারে ডাচ কোনো মেয়ের সোনা জয়ের সর্বশেষ কীর্তি এই ব্ল্যাংকার্স-কোয়েনের। ১৯৪৮ লন্ডন অলিম্পিকে যাঁর সোনা জয়ের বাড়তি মাহাত্ম্য আছে। ঘরকন্নার জন্য ট্র্যাক ছেড়েছিলেন। ওই অলিম্পিকে যখন ফিরলেন, তত দিনে দুই সন্তানের মা, বয়স হয়ে গেছে ৩০। দৌড়ানোর বদলে ঘরকন্না করাই ভালো—এই টিপ্পনীর জবাব দিয়ে সোনা জিতলেন ব্ল্যাংকার্স-কোয়েন। তাঁর নাম হয়ে গেল ‘ফ্লাইং ডাচ উইম্যান।’
১০০ মিটারের দুই দিন আগে পায়ে চোট পেয়েছিলেন শিপার্স। ২০০ মিটার দৌড়ানো নিয়েই তাই ছিল সংশয়। দৌড়ালেন দুই পায়ে টেপ জড়িয়ে। থম্পসনকে পেরোনোর মরিয়া চেষ্টায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সমাপ্তিরেখায়। গলায় রুপার পদকটা মেনে নিতে কষ্টই হচ্ছে তাঁর, ‘আমি এখানে সোনা জিততে এসেছিলাম। রুপা জিতে একটুও খুশি নই।’ চার বছর পরের অলিম্পিকের জন্য আগাম যুদ্ধের ঘোষণাও দিয়ে রাখলেন।
চার বছর পর কী হবে, কে জানে। তবে আপাতত সত্যি এটাই যে, জ্যামাইকার অন্তহীন স্প্রিন্টারের মিছিলে যোগ হয়েছে এলেইন থম্পসন নামের নতুন এক তারকা। গত দুটি অলিম্পিকে দুটি রিলেসহ ১২টি স্প্রিন্ট ইভেন্টের ৯টিতেই সোনা জিতেছিল জ্যামাইকা। রিওতে জিতল প্রথম তিনটির তিনটিই। এবার না স্প্রিন্টের ৬টি সোনাই নিয়ে যায় জ্যামাইকা!