নতুন নায়ক পেয়ে গেছে ব্রাজিল

২০১৬ রিও অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২০ জুলাই ২০২১

নতুন নায়ক পেয়ে গেছে ব্রাজিল

থিয়াগো ব্রাজ ডা সিলভা। ছবি: গেটি ইমেজেস

অলিম্পিক যদি হয় স্বপ্নকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মঞ্চ, তবে থিয়াগো ব্রাজ ডা সিলভা এর সবচেয়ে বড় উদাহরণই হবেন। রিও অলিম্পিকের আগের বছরের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে হয়েছিলেন ১৯তম, অলিম্পিক শুরুর পাঁচ মাস আগের বিশ্ব ইনডোর চ্যাম্পিয়নশিপে ১২তম। সেই তিনিই রিওতে অলিম্পিক রেকর্ড গড়ে জিতেছিলেন সোনা, ছাড়িয়েছিলেন ৬ মিটারের ব্যারিয়ার।

প্রথম প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো

এমন কিছুরই অপেক্ষায় ছিল রিও অলিম্পিক। জাদুকরি এমন কোনো মুহূর্তের, যা জাগিয়ে তুলবে এই গেমসকে। পরশু রাতে সেই কাজটিই করলেন থিয়াগো ব্রাজ ডা সিলভা। যদিও অলিম্পিক স্টেডিয়ামের ওই রাতই আবার জন্ম দিল নতুন বিতর্কের।

ব্রাজিলিয়ান তরুণ বিশ্ব জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন একবার। তাই বলে তাঁর কাছে ব্রাজিল সোনা চাইছিল বললে খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। বড়দের আসরে কখনো কিছু তো জেতেনইনি, জেতার সম্ভাবনাও জাগাতে পারেননি কখনো। গত বছর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে হয়েছেন ১৯তম। মাত্র মাস পাঁচেক আগে বিশ্ব ইনডোরে মাত্র ৫.৫৫ মিটার লাফিয়ে ছিলেন ১২ নম্বরে। সেই থিয়াগো ব্রাজ ডা সিলভা অলিম্পিকে এসে সোনা জিতে ফেলবেন, সেটিও অলিম্পিক রেকর্ড গড়ে—ডা সিলভা এটা নিজেও কি ভেবেছিলেন!

ডা সিলভা জিতেছেন অলিম্পিক রেকর্ড গড়ে। ছবি: গেটি ইমেজেস

পোল ভল্টে ৬ মিটার একটা ম্যাজিক নাম্বার। সেরাদের দলে নাম লেখানোর ছাড়পত্র। সের্গেই বুবকা এটাকে ছেলেখেলা বানিয়ে দিয়েছিলেন ঠিকই, তবে অনেক পোল ভল্টারের কাছেই এটা স্বপ্ন। স্বপ্ন ছিল ডা সিলভার কাছেও। উত্তাল অলিম্পিক স্টেডিয়ামে ল্যাপ অব অনার দেওয়ার পর উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে যেতে বলেছেন, ‘আমার প্রথম ৬ মিটার! অবিশ্বাস্য!’

যে নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে তা হলো, সেটিও অবিশ্বাস্য। ফেবারিট ছিলেন ফ্রান্সের রেনো লাভিলেনি। লন্ডনে সোনা জিতেছেন, বিশ্ব ইনডোর জিতেছেন দুবার। ৫.৯৮ মিটার লাফানোর পর এবারও সোনা জিতে গেছেন বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু ডা সিলভা কোনো দিন যা করতে পারেননি, তা-ই করে ফেললেন এখানে। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় পেরিয়ে গেলেন ৬.০৩ মিটার, লাভিলেনি যা পেরোতে পারলেন না। তবে সোনা ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টায় বার রাখতে বললেন ৬.০৮ মিটার উচ্চতায়। পারলেন না। কারও ব্যর্থতায় স্টেডিয়ামে এমন গর্জন উঠতে পারে, অলিম্পিক তা প্রথম জানল। যদিও সেই স্টেডিয়াম অর্ধেকও ভরা নয়।

এমনিতেই দর্শকপ্রিয় কোনো ইভেন্ট ছিল না। তার ওপর বৃষ্টি। তুমুল বৃষ্টির কারণে এদিন এলোমেলো হয়ে গেছে অ্যাথলেটিকসের সূচি। ট্র্যাক ইভেন্টই পিছিয়ে দিতে হয়েছে, পোল ভল্ট তো পেছাতে হবেই। শুরু হওয়ার পরও একবার তা স্থগিত করতে হয়েছে, কারণ বার তুলে দেওয়ার প্রযুক্তি বিগড়ে বসেছিল। শেষ পর্যন্ত প্রায় মধ্যরাতে শেষ হলো পোল ভল্ট। ততক্ষণে ব্রাজিল পেয়ে গেছে নতুন এক নায়ককে। নিজের আগের সেরার চেয়ে ১১ সেন্টিমিটার বেশি লাফিয়েছেন, ২০০৮ সালের পর যা সেরা। রূপকথার যে গল্প লিখেছেন ডা সিলভা, তাতে শুধু ব্রাজিল কেন, তিনি তো এই অলিম্পিকেরই নায়ক।

গেমসের চতুর্থ দিনে রাফায়েলা সিলভা জুডোতে সোনা জিতেছিলেন। সেটিই সবেধন নীলমণি হয়ে ছিল স্বাগতিকদের জন্য। দ্বিতীয় সোনার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষাও ঘুচল আরেক সিলভায়। দুটিতে বড় পার্থক্য আছে। রাফায়েলার কাছে সোনা প্রত্যাশাই করেছিল ব্রাজিল। নিজের ইভেন্টে তিনি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। থিয়াগোর কাছে সর্বোচ্চ চাওয়া ছিল ভালো একটা পারফরম্যান্স। সেই ভালোটা পদক জয়ের মতো ভালো হয়ে যাচ্ছে দেখে দর্শকদের আবেগ আর বাঁধ মানল না। ঘরের ছেলেকে উৎসাহ দেওয়াতেও যা সীমাবদ্ধ থাকল না। প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য সব পোল ভল্টারের জন্য থাকল দুয়োধ্বনি। লাভিলেনির ৬.০৮ মিটার উচ্চতা পেরোনোর চেষ্টার সময় যা সীমা ছাড়িয়ে গেল।

ছবি: গেটি ইমেজেস

নিচের দিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তখনই সেটির নিন্দা করে এসেছেন লাভিলেনি। পরে তিনি আরও সরব। ব্রাজিলিয়ান দর্শকদের অলিম্পিক-চেতনা নিয়েই প্রশ্ন তুলে তাদের তো ধুয়ে দিলেনই, টেনে আনলেন জেসি ওয়েন্সকেও, ‘১৯৩৬ সালে দর্শকেরা জেসি ওয়েন্সের বিপক্ষে ছিল। এরপর আমরা আর এমন কিছু দেখিনি। কোনো সম্মানবোধ নেই, কোনো ফেয়ার প্লে নেই। অলিম্পিকেও যদি তা না থাকে, তাহলে কোথায় থাকবে? ব্রাজিলিয়ান দর্শকেরা যা করেছে, তাতে আমি খুবই মর্মাহত। এখানে এসে শিস দেওয়ার চাইতে ঘরে বসে টেলিভিশনে দেখলেই তো হয়, তাতে অন্তত খেলা দেখতে চায় এমন দর্শকদের পাওয়া যাবে স্টেডিয়ামে। ফুটবলে এমন হয়, কিন্তু ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে এমন কিছু এই প্রথম দেখলাম।’

ব্রাজিলিয়ান দর্শকদের অলিম্পিক-চেতনা নিয়ে অবশ্য আগে থেকেই প্রশ্ন উঠছিল। ফুটবল-সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত দর্শক অলিম্পিকেও গ্যালারিতে আসছে ‘ফ্ল্যামেঙ্গো বনাম ফ্লুমিনেন্স’ যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে। নিজেদের অ্যাথলেট বা দলকে তো উৎসাহ দিচ্ছেই, প্রতিপক্ষের জন্য কাজটা যত কঠিন করে তোলা যায়, সেই চেষ্টাতেও তারা সমান সক্রিয়। লাভিলেনি জেসি ওয়েন্সকে টেনে এনে অবশ্য বিতর্কটাকে নিয়ে গেছেন খুব স্পর্শকাতর পর্যায়ে। ১৯৩৬ সালে বার্লিন অলিম্পিককে এডলফ হিটলার নিয়েছিলেন জার্মানদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের মঞ্চ হিসেবে। যে চেষ্টার মুখে চপেটাঘাত ছিল অ্যাথলেটিকসে জেসি ওয়েন্সের চারটি সোনা জয়। হিটলারের অনেক ‘গুণের’ মধ্যে বর্ণবাদও ছিল। কৃষ্ণাঙ্গ ওয়েন্সের এই সাফল্য এমনই অসহ্য লেগেছিল যে, তাঁর সঙ্গে হাত মেলাতে হবে বলে স্টেডিয়াম থেকে নাকি বেরিয়েও গিয়েছিলেন।

জেসি ওয়েন্স ও ১৯৩৬ অলিম্পিকের সঙ্গে মিশে আছে নাৎসিবাদ। তুলনাটা করার কিছুক্ষণ পরই তাই ভুলটা বুঝতে পেরেছেন লাভিলেনি। তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় একটু বেশিই বলে ফেলেছেন স্বীকার করে ক্ষমাও চেয়েছেন।

তাতে কাজ হবে বলে মনে হয় না। ব্রাজিলে এখন খলনায়ক বলতে এক নম্বরে এই রেনো লাভিলেনিই। আর নায়ক?

তা একজনই। থিয়াগো ব্রাজ ডা সিলভা!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×