উইম্বলডনে ফেডেরার আজ ‘সৎ ছেলে’

২০১২ লন্ডন অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

উইম্বলডনে ফেডেরার আজ ‘সৎ ছেলে’

ছবি: এএফপি

তখন ফেডেরারের ১৭টি গ্র্যান্ড স্লাম। অলিম্পিক সোনাও আছে, তবে সেটি দ্বৈতে। অলিম্পিকে একক সোনাটা জিতলে একমাত্র অপূর্ণতাও ঘুচে যায়, এমন একটা সম্ভাবনাকে সঙ্গী করেই গিয়েছিলেন লন্ডন অলিম্পিকে। সোনা জেতার খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন, সেমিফাইনালে দেল পোত্রোকে হারিয়েছিলেন ৪ ঘণ্টা ২৬ মিনিটের এক লড়াইতে। স্বপ্ন পূরণের একদম কাছে গিয়ে কী মনে হচ্ছিল ফেডেরারের?

প্রথম প্রকাশ: ৫ আগস্ট ২০১২। প্রথম আলো।

‘এখন তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। হয়তো কাল সকালে বুঝব’—বলতে বলতে রজার ফেডেরার হাসেন। কোর্টে যেমন স্নিগ্ধতার প্রতিচ্ছবি, সংবাদ সম্মেলনেও তাই। একটু আগে শেষ হওয়া ৪ ঘণ্টা ২৬ মিনিটের মহারণের ক্লান্তি অবশ্য চেহারায় ফুটে উঠেছে।

ম্যাচ শেষে মার্টিন দেল পোত্রোকে আলিঙ্গনে জড়িয়েছেন। যেন ১৫ রাউন্ডের হেভিওয়েট বক্সিং বাউট শেষে বিধ্বস্ত দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। কী বললেন পোত্রোকে? ‘বলেছি, ও যেমন খেলেছে, তাতে ওর গর্বিত হওয়া উচিত। ও কী বলেছে, আমি অবশ্য তা শুনতে পাইনি’—বলে ফেডেরার আবার হাসেন। সংবাদ সম্মেলনে বড় তারকারা হাসলে সাংবাদিকদেরও হাসার নিয়ম। সাংবাদিকেরাও তাই হাসেন।

অলিম্পিকে টেনিস নিয়ে আগে এত মাতামাতি ছিল না। এখন হচ্ছে। সেটির যথার্থতা প্রমাণ করতেই যেন গত পরশু এই মহাকাব্যিক সেমিফাইনাল। টেনিস ইতিহাসে দীর্ঘতম তিন সেটের ম্যাচ। আগের রেকর্ডটি ছিল ২২ মিনিট কম। ২০০৯ মাদ্রিদ মাস্টার্সের সেমিফাইনালের স্কোরলাইন দেখলে অবশ্য আপনি কিছু বুঝতেই পারবেন না। রাফায়েল নাদাল ৩-৬, ৭-৬ (৭/৫), ৭-৬ (১১/৯) গেমে হারিয়েছিলেন নোভাক জোকোভিচকে। এখানে ৩-৬, ৭-৬ (৭/৫), ১৯-১৭ স্কোরলাইনই বলে দিচ্ছে সব। শুধু তৃতীয় সেটটাই হয়েছে ২ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট, বেশির ভাগ ম্যাচই যে সময়ে শেষ হয়ে যায়।

দ্বিতীয় সেমিফাইনালটাই যেমন। জোকোভিচকে ৭-৫, ৭-৫ গেমে হারাতে মাত্র দুই ঘণ্টা সময় নিলেন অ্যান্ডি মারে। ২৮ দিন আগে উইম্বলডনের ফাইনালটিরই যেন রি-ম্যাচ আজ। সেদিন পুরস্কার ছিল গ্র্যান্ড স্লাম। আজ অলিম্পিক সোনা।

ফেডেরারের ১৭টি গ্র্যান্ড স্লাম। অলিম্পিক সোনাও আছে, তবে সেটি দ্বৈতে। বেইজিংয়ে জেতা সেই সোনা লন্ডনে হারিয়েছেন। টেনিসে যা কিছু পাওয়া সম্ভব, বাকি সবার চেয়ে তা বেশিই পেয়েছেন। অলিম্পিকে একক সোনাটা জিতলে একমাত্র অপূর্ণতাও ঘুচে যায়।

অ্যান্ডি মারের অলিম্পিক সোনা নেই, গ্র্যান্ড স্লামও নেই। দুটির মধ্যে একটা বেছে নিতে বললে কোনটি নেবেন? মারে উত্তর দেন, ‘অলিম্পিকের আগে জিজ্ঞেস করলে বলতাম, অবশ্যই গ্র্যান্ড স্লাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সোনার পদকটা খেলার চূড়ান্ত সম্মান। সবাই এর মাহাত্ম্য বোঝে।’ ফেডেরারের সঙ্গে রেকর্ড ৮-৮। তবে এই প্রথম ফেডেরারের সঙ্গে এমন একটা কিছু পাওয়ার লড়াইয়ে নামছেন, যা তাঁর যেমন নেই, ফেডেরারেরও নেই। উইম্বলডন ফাইনালে চার সেটে হারা মারে তা থেকেই যেন সাহস খুঁজে নিতে চাইছেন, ‘রজারও কখনো অলিম্পিক একক সোনার জন্য খেলেনি। এর আগে যেখানেই ওর মুখোমুখি হয়েছি, অভিজ্ঞতায় ও অনেক এগিয়ে ছিল। উইম্বলডন ফাইনালটা বোধহয় এখানে ওর অষ্টম ফাইনাল ছিল, আর আমার ছিল প্রথম। এই প্রথম একটা জায়গায় আমরা সমান-সমান।’

এক জায়গায় এগিয়েও। উইম্বলডনেও দর্শক-সমর্থন পান, তবে অলিম্পিকে তাঁকে ঘিরে যে উন্মাদনা, সেটি মারের জন্যও নতুন অভিজ্ঞতা। সেমিফাইনাল জেতার পর প্রেস সেন্টারের দোতলায় মিক্সড জোনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন, নিচে এতক্ষণ কোর্টে দেখেও আশ না-মেটা হাজারো দর্শকদের ভিড়। তাঁদের ‘অ্যান্ডি’ ‘অ্যান্ডি’ চিৎকারে একসময় মারেকে নিচেও নেমে আসতে হলো। টিকিটে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি, তা পাওয়ার পর উচ্ছ্বাসটা অলিম্পিক সোনা জয়ের চেয়ে একটুও কম হলো না। মারে রীতিমতো অভিভূত, ‘এর আগে এমন কখনো দেখিনি। আজ যে অভিজ্ঞতা হলো, টেনিস থেকে আমি যা পেয়েছি, সব ছাড়িয়ে গেছে।’

সেমিতে হেরে কান্নাতেই ভেঙে পড়লেন দেল পোত্রো। ছবি: এএফপি

রজার ফেডেরারও জানেন, উইম্বলডনের বরপুত্রকে আজকের ফাইনালে ‘সেছলে’ হয়েই থাকতে হবে। উইম্বলডন বরাবরই কাউকে না-কাউকে ঘরের ছেলে বানিয়ে ফেলে। একসময় ছিলেন বিওন বোর্গ, এরপর বরিস বেকার, পিট সাম্প্রাস। অনেক দিন ধরেই তা রজার ফেডেরার। গত উইম্বলডন ফাইনালেই সেন্টার কোর্টের দর্শকদের বিপক্ষে চলে যেতে দেখেছেন। আজ তো আরও যাবে। অলিম্পিকে খেলাটা তো যতটা ফেডেরার বনাম মারে, তার চেয়ে বেশি সুইজারল্যান্ড-গ্রেট ব্রিটেন। টেলিভিশনে স্কোরলাইনে দেখেন না, খেলোয়াড়ের বদলে দেশের নাম দেখায়।
সেমিফাইনালে ফেডেরারের ওই ম্যারাথন জেতায় অভিজ্ঞতার ভূমিকা তো অবশ্যই ছিল, সঙ্গে দেশের জন্য কিছু করার তাড়নাও। ‘এমন পরিস্থিতিতে তো আমি অনেক পড়েছি। এতবার বড় কিছুর জন্য খেলেছি...কখনো শিরোপা, কখনো রেকর্ড, কখনো ইতিহাস বইয়ে স্থান পেতে...এটা আমাকে অবশ্যই সাহায্য করেছে। সঙ্গে মনে হয়েছে, সুইজারল্যান্ড এখনো কোনো পদক পায়নি, জিতলে একটা পদক নিশ্চিত হবে। এটাই আমাকে পার করেছে।’

ফেডেরারের এটি চতুর্থ অলিম্পিক। প্রতিবারই অলিম্পিকে এসে ব্যক্তিগত-নিঃসঙ্গ খেলা টেনিসে এই ভিন্ন স্বাদটা উপহার পেয়েছেন। তবে এবারের অভিজ্ঞতাটা একেবারেই আলাদা। চিরচেনা উইম্বলডনও যে এবার নতুন লাগছে। উইম্বলডনের নিয়মিত টুর্নামেন্টের দর্শকেরা অনেক ‘শান্তশিষ্ট’, আর অলিম্পিক দর্শকদের মধ্যে যেন চিৎকারের প্রতিযোগিতা। উইম্বলডনে বাচ্চাদের প্রবেশাধিকার নেই, এখানে কোলের বাচ্চা নিয়েও আসছেন অনেকে। ফেডেরারের ভালোই লাগছে, ‘এবার খেলার সময় প্রায়ই বাচ্চাকাচ্চার চিৎকার শুনছি। মনে হয়, আমি নিজের বাড়িতেই আছি।’

ফেডেরারের তিন বছর বয়সী যমজ দুই মেয়ে ও মেয়েদের মা লন্ডন অলিম্পিকে ফেডেরারের সঙ্গেই আছেন।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×