বিশ্বমানবের মিলনমেলা

অলিম্পিকের বেইজিং

উৎপল শুভ্র

৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বিশ্বমানবের মিলনমেলা

সপ্তাহ দুয়েক জুড়ে খেলার উৎসবই শুধু নয়, অলিম্পিক আসলে আরও বড় কিছু। বলতে পারেন বিশ্বমানবের মিলনমেলা। কত দেশের কত অ্যাথলেট, কত দেশের কত সাংবাদিক ভাবলেও তো বিস্মিত হতে হয়। বেইজিং অলিম্পিক থেকে সেই বিস্ময়ের গল্প।

প্রথম প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০০৮। প্রথম আলো।

গত দুদিন কী কী খেলা দেখলাম, সেটি আগে বলি। ওয়াটারপোলো, জিমন্যাস্টিকস, সিনক্রোনাইজড সুইমিং, ফুটবল ও অ্যাথলেটিকস। আরও দেখার ইচ্ছে ছিল! সময়ে কুলায় না। এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে দৌড়াদৌড়ি করে খেলা দেখার মাঝখানে যে লিখতেও হয়!

হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত দুটো-তিনটে বাজে। হোটেলে ফেরার বাসে বসে ঝিমুতে ঝিমুতে ভাবি, কাল আর এমন ‘পাগলামি’করব না। কোনো একটা খেলা দেখে এমপিসিতে (এমপিসি মানে যে মেইন প্রেস সেন্টার, অলিম্পিকে সংবাদপত্র-সাংবাদিকদের মূল কর্মক্ষেত্র, এটা তো বোধ হয় বলেছি) ফিরব, এরপর আর নট নড়ন-চড়ন। সেখানে বসে বসেই লিখব।

অলিম্পিকে সাংবাদিকদের তথ্য সরবরাহের এমন দারুণ ব্যবস্থা যে, কোথাও না গিয়েও এমপিসিতে বসেই সব লেখা সম্ভব। যেকোনো খেলা শেষ হওয়া মাত্র বিস্তারিত ফলাফল তো পাওয়া যায়ই; এমপিসির মতো প্রতিটি মিডিয়া সেন্টারেই অলিম্পিকের বিশেষ যে কম্পিউটার আছে, সেটির মাউস টিপলেই পদকজয়ীদের প্রতিক্রিয়া-এর আগের অলিম্পিকে পদকজয়ীদের তালিকা-খেলাটির ইতিহাস-খেলোয়াড়দের সংক্ষিপ্ত জীবনী সবই।

খেলা দেখতে চান? সে সুযোগও আছে। সারি বেঁধে ঝুলছে বড় বড় টেলিভিশন, একেকটাতে চলছে একেক খেলা। কোনো নির্দিষ্ট খেলা দেখতে গেলে যেমন অন্য খেলা দেখার সুযোগ নেই, এমপিসিতে বরং সব খেলাই দেখতে পাওয়া যায়। এমপিসিই তো তা হলে ভালো! রাতে ফেরার সময় তা-ই মনে হয়, পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আর নয়। তখন মনে হয়, টেলিভিশনে খেলা তো দেশে থাকলেও দেখতে পারতাম। তা হলে আর এত কষ্ট করে এত দূর আসা কেন?

আবার এক ভেন্যু থেকে অন্য ভেন্যু। আবার ক্লান্তির সঙ্গে যুদ্ধ। সেই ক্লান্তিকে জয় করতে নিজেকে শুধু মনে করিয়ে দিই, এই তো আর আর মাত্র কটা দিন, দেখে নাও, দুচোখ ভরে দেখে নাও। এর পর তো চাইলেও বিশ্বসেরাদের চর্মচক্ষে দেখার এমন সুযোগ পাবে না। 

অনেক কিছু প্রথম দেখার সুযোগও তো। বাংলাদেশে সিনক্রোনাইজড সুইমিং কোথায় দেখব অথবা ডাইভিং! কাল রাতেই যেমন বিশ্বমানের মেয়েদের ফুটবল এই প্রথম সরাসরি দেখলাম। দেখলাম এবং মুগ্ধ হলাম। মাঠে গিয়ে সচরাচর যে মানের ফুটবল দেখে অভ্যস্ত, তাতে জানা না থাকলে এখানে যে মেয়েরা খেলছে, এটি বুঝতে পারতাম বলে মনে হয় না।

যে খেলাই দেখি, একটা অনুভূতিই ফিরে ফিরে আসে মনে। মানুষের নিজেকে ক্রমাগত ছাড়িয়ে যাওয়ার কী অসীম ক্ষমতা! ১৯৬৮ সালে ১০০ মিটারে প্রথম ১০ সেকেন্ডের ব্যারিয়ার ভেঙেছিলেন জিম হিনেস্। উসাইন বোল্ট এখানে দৌড়ালেন ৯.৬৯ সেকেন্ডে। ৪০ বছরে কমেছে দশমিক ৩১ সেকেন্ড, মানে এক সেকেন্ডের ৩১ শতাংশ! এ আর এমন কী? অনেক কিছু, প্রতিটি শতাংশ কমিয়ে আনার মধ্যেই তো মানুষের জয়ের ঘোষণা।

জিমন্যাস্টিকস দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, কত চেষ্টা, কত সাধনায় শরীরের ওপর এমন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে মানুষ! ডাইভিং দেখে মনে হলো, ওদের শরীরে বোধ হয় হাড়গোড় কিছু নেই। সিটিয়াস, অল্টিয়াস, ফর্টিয়াস—আরও দ্রুত, আরও উঁচু, আরও শক্তি—এই কথাটা প্রতি মুহূর্তেই মনে করিয়ে দেয় অলিম্পিক।

খেলাটাই মোহাবিষ্ট করে রাখার জন্য যথেষ্ট। তারপরও মাঝে-মধ্যে এটিকেও মনে হয় নিছকই উপলক্ষ। সপ্তাহ দুয়েক ধরে শুধুই খেলার মেলা নয়, অলিম্পিক আসলে আরও বড় কিছু। বলতে পারেন বিশ্বমানবের মিলনমেলা। কত দেশের কত অ্যাথলেট—এটা তো আছেই, কত দেশের কত সাংবাদিক ভেবেই তো আমি রোমাঞ্চিত হই! গত তিন দিন এমপিসি আর বিভিন্ন ভেন্যুর প্রেস সেন্টারে আমিই যেমন নয়-দশটি দেশের সাংবাদিকদের পাশে বসলাম। বাংলাদেশের পাশে যুক্তরাষ্ট্র, চিলি, ব্রাজিল, ফিজি, নরওয়ে, কিউবা, জাপান, কেনিয়া, ইংল্যান্ড...চীনের কথা তো বাদই দিলাম।

এমপিসি তো সত্যিকার অর্থেই মানব জাতির বিভিন্ন প্রকারের ডিসপ্লে সাজিয়ে বসা। বার্ডস নেস্ট থেকে পায়ে হেঁটে মিনিট দশেকের পথ, এমপিসিতে বসে কখনো কখনো মনে হয়, এটিকেও তো ‘বার্ডস নেস্ট’ নামে ডাকা যায়! চার পাশে এত বিচিত্র সব ভাষা উচ্চারিত হয় যে, মনে হয় পাখির কিচিরমিচির!

বিচিত্র সব দেশের মানুষের সঙ্গেও পরিচয় হয়। কদিন আগেই যেমন একজনকে পেলাম ইরিত্রিয়ার। এমপিসির এক তলা নিচে ‘ফুড কোর্টে’ ম্যাকডোনাল্ডসের লাইনে দাঁড়িয়ে পরিচয়। মধ্যবয়সী ভদ্রলোক এমন অমায়িক যে, তাঁকে প্রশ্নটা করতে বিব্রতই বোধ করলাম। ইরিত্রিয়াটা যেন কোথায়?

গত দুদিন কী কী খেলা দেখলাম, সেটি আগে বলি। ওয়াটারপোলো, জিমন্যাস্টিকস, সিনক্রোনাইজড সুইমিং, ফুটবল ও অ্যাথলেটিকস। আরও দেখার ইচ্ছে ছিল! সময়ে কুলায় না। এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে দৌড়াদৌড়ি করে খেলা দেখার মাঝখানে যে লিখতেও হয়!

হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত দুটো-তিনটে বাজে। হোটেলে ফেরার বাসে বসে ঝিমুতে ঝিমুতে ভাবি, কাল আর এমন ‘পাগলামি’করব না। কোনো একটা খেলা দেখে এমপিসিতে (এমপিসি মানে যে মেইন প্রেস সেন্টার, অলিম্পিকে সংবাদপত্র-সাংবাদিকদের মূল কর্মক্ষেত্র, এটা তো বোধ হয় বলেছি) ফিরব, এরপর আর নট নড়ন-চড়ন। সেখানে বসে বসেই লিখব।

অলিম্পিকে সাংবাদিকদের তথ্য সরবরাহের এমন দারুণ ব্যবস্থা যে, কোথাও না গিয়েও এমপিসিতে বসেই সব লেখা সম্ভব। যেকোনো খেলা শেষ হওয়া মাত্র বিস্তারিত ফলাফল তো পাওয়া যায়ই; এমপিসির মতো প্রতিটি মিডিয়া সেন্টারেই অলিম্পিকের বিশেষ যে কম্পিউটার আছে, সেটির মাউস টিপলেই পদকজয়ীদের প্রতিক্রিয়া-এর আগের অলিম্পিকে পদকজয়ীদের তালিকা-খেলাটির ইতিহাস-খেলোয়াড়দের সংক্ষিপ্ত জীবনী সবই।

খেলা দেখতে চান? সে সুযোগও আছে। সারি বেঁধে ঝুলছে বড় বড় টেলিভিশন, একেকটাতে চলছে একেক খেলা। কোনো নির্দিষ্ট খেলা দেখতে গেলে যেমন অন্য খেলা দেখার সুযোগ নেই, এমপিসিতে বরং সব খেলাই দেখতে পাওয়া যায়। এমপিসিই তো তা হলে ভালো! রাতে ফেরার সময় তা-ই মনে হয়, পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আর নয়। তখন মনে হয়, টেলিভিশনে খেলা তো দেশে থাকলেও দেখতে পারতাম। তা হলে আর এত কষ্ট করে এত দূর আসা কেন?

আবার এক ভেন্যু থেকে অন্য ভেন্যু। আবার ক্লান্তির সঙ্গে যুদ্ধ। সেই ক্লান্তিকে জয় করতে নিজেকে শুধু মনে করিয়ে দিই, এই তো আর আর মাত্র কটা দিন, দেখে নাও, দুচোখ ভরে দেখে নাও। এর পর তো চাইলেও বিশ্বসেরাদের চর্মচক্ষে দেখার এমন সুযোগ পাবে না। 

অনেক কিছু প্রথম দেখার সুযোগও তো। বাংলাদেশে সিনক্রোনাইজড সুইমিং কোথায় দেখব অথবা ডাইভিং! কাল রাতেই যেমন বিশ্বমানের মেয়েদের ফুটবল এই প্রথম সরাসরি দেখলাম। দেখলাম এবং মুগ্ধ হলাম। মাঠে গিয়ে সচরাচর যে মানের ফুটবল দেখে অভ্যস্ত, তাতে জানা না থাকলে এখানে যে মেয়েরা খেলছে, এটি বুঝতে পারতাম বলে মনে হয় না।

যে খেলাই দেখি, একটা অনুভূতিই ফিরে ফিরে আসে মনে। মানুষের নিজেকে ক্রমাগত ছাড়িয়ে যাওয়ার কী অসীম ক্ষমতা! ১৯৬৮ সালে ১০০ মিটারে প্রথম ১০ সেকেন্ডের ব্যারিয়ার ভেঙেছিলেন জিম হিনেস্। উসাইন বোল্ট এখানে দৌড়ালেন ৯.৬৯ সেকেন্ডে। ৪০ বছরে কমেছে দশমিক ৩১ সেকেন্ড, মানে এক সেকেন্ডের ৩১ শতাংশ! এ আর এমন কী? অনেক কিছু, প্রতিটি শতাংশ কমিয়ে আনার মধ্যেই তো মানুষের জয়ের ঘোষণা।

জিমন্যাস্টিকস দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, কত চেষ্টা, কত সাধনায় শরীরের ওপর এমন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে মানুষ! ডাইভিং দেখে মনে হলো, ওদের শরীরে বোধ হয় হাড়গোড় কিছু নেই। সিটিয়াস, অল্টিয়াস, ফর্টিয়াস—আরও দ্রুত, আরও উঁচু, আরও শক্তি—এই কথাটা প্রতি মুহূর্তেই মনে করিয়ে দেয় অলিম্পিক।

খেলাটাই মোহাবিষ্ট করে রাখার জন্য যথেষ্ট। তারপরও মাঝে-মধ্যে এটিকেও মনে হয় নিছকই উপলক্ষ। সপ্তাহ দুয়েক ধরে শুধুই খেলার মেলা নয়, অলিম্পিক আসলে আরও বড় কিছু। বলতে পারেন বিশ্বমানবের মিলনমেলা। কত দেশের কত অ্যাথলেট—এটা তো আছেই, কত দেশের কত সাংবাদিক ভেবেই তো আমি রোমাঞ্চিত হই! গত তিন দিন এমপিসি আর বিভিন্ন ভেন্যুর প্রেস সেন্টারে আমিই যেমন নয়-দশটি দেশের সাংবাদিকদের পাশে বসলাম। বাংলাদেশের পাশে যুক্তরাষ্ট্র, চিলি, ব্রাজিল, ফিজি, নরওয়ে, কিউবা, জাপান, কেনিয়া, ইংল্যান্ড...চীনের কথা তো বাদই দিলাম।

এমপিসি তো সত্যিকার অর্থেই মানব জাতির বিভিন্ন প্রকারের ডিসপ্লে সাজিয়ে বসা। বার্ডস নেস্ট থেকে পায়ে হেঁটে মিনিট দশেকের পথ, এমপিসিতে বসে কখনো কখনো মনে হয়, এটিকেও তো ‘বার্ডস নেস্ট’ নামে ডাকা যায়! চার পাশে এত বিচিত্র সব ভাষা উচ্চারিত হয় যে, মনে হয় পাখির কিচিরমিচির!

বিচিত্র সব দেশের মানুষের সঙ্গেও পরিচয় হয়। কদিন আগেই যেমন একজনকে পেলাম ইরিত্রিয়ার। এমপিসির এক তলা নিচে ‘ফুড কোর্টে’ ম্যাকডোনাল্ডসের লাইনে দাঁড়িয়ে পরিচয়। মধ্যবয়সী ভদ্রলোক এমন অমায়িক যে, তাঁকে প্রশ্নটা করতে বিব্রতই বোধ করলাম। ইরিত্রিয়াটা যেন কোথায়?

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×