বিদায় বেইজিং, স্বাগত লন্ডন
বেইজিং অলিম্পিক
উৎপল শুভ্র
২১ জুলাই ২০২১
বেইজিং অলিম্পিক অভিনব ছিল অনেক দিক থেকেই। সমাপনী আয়োজনই বা বাদ থাকে কেন অভিনবত্বের প্রদর্শনী থেকে! প্রায় দুই ঘণ্টার উদ্বোধনী আয়োজনের পুরোটা জুড়েই বেজে গিয়েছিল 'এক বিশ্ব এক স্বপ্ন' স্লোগান।
প্রথম প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০০৮। প্রথম আলো
সমাপনী অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরও অনেকক্ষণ নেচে-গেয়ে বেড়াল কুশীলবেরা। ১৭ দিনের মিলনমেলা শেষ হয়ে গেছে একটু আগে, নিভে গেছে ৮ আগস্ট দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা অলিম্পিক মশাল। কী যে শূন্য দেখাচ্ছে সেটিকে!
অলিম্পিক স্টেডিয়াম যেন ভাঙা মেলা। তার পরও মাঠে নাচগান শেষে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে তরুণ-তরুণীরা, গ্যালারিতে ঠায় বসে রয়েছেন অনেকে। অলিম্পিক শেষ, কিন্তু শেষ গানেরই রেশ যে তখনো বেজে চলেছে সবার প্রাণে। বার্ডস নেস্ট ছেড়ে যেতে তাই মন চাইছে না!
বড় পর্দায় একের পর এক ভেসে উঠছে গত ১৬ দিনের সব মানবীয় নাটকের খণ্ডচিত্র। অ্যাথলেটদের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, ভেঙেচুরে দেওয়া হতাশা-ভাসিয়ে নেওয়া উচ্ছ্বাস...। কয়েক মিনিটের টুকরো টুকরো ছবি দিয়ে যেন গাঁথা ২৯তম অলিম্পিকের পুরো নাটক। আর অদৃশ্য কোথাও থেকে ভেসে আসছে মন কেমন করা গান। ভাষা চীনা, কিন্তু সুরটা বিশ্বজনীন। বিদায়ের সুর, হারানোর সুর, যেন কান্নারও! বিদায় বেইজিং ২০০৮!
চীনাদের স্বেচ্ছা-অবরুদ্ধ কাল শেষ হয়েছে আগেই, এই অলিম্পিক ছিল বাকি বিশ্বের সঙ্গে মিলেমিশে যাওয়ার চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিকতা। অলিম্পিককে বাহন করে পুরো বিশ্বের কাছে নিজেদের মেলে ধরতে চেয়েছিল চীন। চেয়েছিল নিজেদের নতুন করে চেনাতে।
তা চেনালও! আয়োজনে চেনাল, খেলার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেনাল, চেনাল আতিথেয়তায়। উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠান নামের মহাযজ্ঞ দিয়েও। চীনের সংস্কৃতি, চীনের ঐতিহ্য তুলে ধরাই তো আসল উদ্দেশ্য হবে স্বাভাবিক। তবে সে সবের মধ্যেও বেজে গেল বিশ্বজনীনতার সুর। বেইজিং অলিম্পিকের স্লোগানই যে ছিল ‘এক বিশ্ব এক স্বপ্ন!’
সেই স্বপ্নের কথা বারবারই অনুচ্চারে শুনিয়ে গেল প্রায় দুই ঘণ্টার সমাপনী অনুষ্ঠান। সমাপনীতে এমনিতেই সৌহার্দ্যের সুরটা একটু বেশি বাজে। জয়-পরাজয়ের পালা শেষ, এবার সবার এক হয়ে যাওয়ার সময়। এ কারণেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রতিটি দেশ যেমন আলাদা আলাদা হয়ে মাঠে ঢোকে, মার্চ পাস্ট করে দাঁড়ায় নিজেদের পতাকার পেছনে; সমাপনীতে তা নয়। এখানে চারপাশ থেকে ইচ্ছেমতো হেঁটে আসে সব দেশের অ্যাথলেটরা, দেশ-জাতি-ভাষা ভুলে মিলেমিশে এক হয়ে যায় সবাই। ১৯৫৬ মেলবোর্ন অলিম্পিক গেমস থেকেই এমন হচ্ছে এবং এর পেছনেও আছে এক চীনা বংশোদ্ভূতের অবদান। সেই গেমসের সময় জন উইং নামের ১৭ বছরের এক চীনা-আমেরিকান আয়োজকদের কাছে এমন করার আবেদন জানিয়ে বলেন, ‘এতে গেমসটা আরও মহান হবে। যুদ্ধ-রাজনীতি-জাতীয়তা ভুলে সবাই হয়ে যাবে এক জাতি।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মতো এক সুর থাকে, সমাপনীর আরেক। অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিকে পুরো বিশ্ব যেমন তাকিয়ে থাকে, সমাপনীর দিকে তেমন নয়। তার পরও এটিও কম মহাযজ্ঞ নয়। এমনই যে, কালকের সমাপনী অনুষ্ঠানের জন্য রিহার্সাল করতে হয়েছে পুরো এক বছর। যেটির শুরুতে থাকল চীনা সংস্কৃতিতে সৌহার্দ্য ও পুনর্মিলনের প্রতীক বৃত্তের খেলা। ঝিকিমিকি আলো ছড়ানো বৃত্ততে আরও মূর্ত হলো মানুষের নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চিরন্তন তাড়না।
সবচেয়ে দারুণ হলো মশাল নেভানোর পর্বটা। বিমানে বোর্ডিং করার মই বেয়ে উঠে গেলেন তিন অ্যাথলেট। স্টেডিয়ামের ওপরের ডিসপ্লে বোর্ডে তখন উড়ে যাওয়া বিমানের ছবি, বড় পর্দায় ফুটে উঠেছে ঠিক বিমানবন্দরের মতো বিমানের আগমন-বহির্গমনের সূচি। অ্যাথলেটরা চলে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ালেন। একজন আস্তে আস্তে মেলে ধরলেন হাতে গোল করে ভাঁজ করে রাখা স্মৃতির অ্যালবাম। যা স্টেডিয়ামের ওপরের পর্দায় ফুটে উঠল ছবি হয়ে, মনে করিয়ে দিল গত ১৬ দিনের হিরণ্ময় সব স্মৃতি। ওই অ্যাথলেট স্মৃতির অ্যালবাম আবারও ভাঁজ করলেন আর নিভে গেল অলিম্পিক মশাল। নেভার সঙ্গে সঙ্গেই আলো পড়ল অন্ধকারে মাটির নিচ থেকে মাঠের মাঝখানে উঠে দাঁড়ানো স্মৃতিস্তম্ভে। সেটির গায়ে গায়ে ৩৯৬ জন মানুষ রূপ নিয়ে ফেলল অনির্বাণ এক শিখার। অলিম্পিক মশাল যে আসলে নেভে না, সবার হৃদয়ে সেটি জ্বলতেই থাকে—এর অপূর্ব প্রতীকী উপস্থাপনা।
নাচগান হলো, বক্তৃতা হলো, হলো ম্যারাথনের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানও। অলিম্পিকের সবচেয়ে কঠিন খেলা, ৪০.২ কিলোমিটারের এই দৌড় প্রথাগতভাবেই শেষ হয় সমাপনী দিন সকালে। পুরস্কার বিতরণীটাও সমাপনী অনুষ্ঠানেই করার প্রথা। কেনিয়ার স্যামুয়েল ওয়ানজিরুকে মাইকেল ফেল্পেসরও তাই ঈর্ষা করার কথা! আট সোনা জিতেছেন তিনি, কিন্তু সমাপনী অনুষ্ঠানের মাঝে সব অ্যাথলেটের উপস্থিতি আর চেয়ে থাকা পুরো বিশ্বের সামনে গলায় সোনার পদক পরার অনুভূতির স্বাদ তো আর তিনি পাননি।
বেইজিং শেষ, অপেক্ষা এখন লন্ডনের। চার বছরের অপেক্ষা। তত দিনেও কি সত্যি হবে ‘এক বিশ্ব এক স্বপ্ন’ স্লোগান! কালকের সমাপনী অনুষ্ঠানে চীনের দুই তরুণ গায়ক ওয়েই ওয়েই ও সান ন্যানের গাওয়া গানের এই চাওয়া—বিশ্ব ভরে দাও উষ্ণ সূর্যালোকের আলোয়!