লিউয়ের কান্নায় কাঁদছে চীন
বেইজিং অলিম্পিক
উৎপল শুভ্র
২১ জুলাই ২০২১
অ্যাথলেটিকস শুরু হতে না হতেই শোকের চাদরে ঢেকে গিয়েছিল চীন। রক্ত-মাংসে গড়া প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে হারলেও সান্ত্বনা থাকে, চীনের অ্যাথলেটিকসের মুখ লিউ শিয়াং তো পুরোনো চোটের কাছে হার মেনে প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন ট্র্যাকে নামার আগেই।
প্রথম প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০০৮। প্রথম আলো
চার বছর ধরে লালিত স্বপ্ন ধুয়েমুছে গেল চোখের জলে! লিউ শিয়াংয়ের স্বপ্ন। চীনের স্বপ্ন। যে বার্ডস নেস্ট-এ ওড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেখানে দৌড়াতে গিয়েই হোঁচট খেয়ে কেঁদে বিদায় নিলেন লিউ শিয়াং। কিছুক্ষণ পর প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে কাঁদলেন তাঁর কোচ। কাঁদল বোধ হয় চীনের ১৩০ কোটি মানুষও।
বলা হচ্ছে, বেইজিং অলিম্পিকের সবচেয়ে বড় অঘটন। সেই অঘটন প্রতিযোগিতায় হলেও মেনে নেওয়া কঠিন হতো চীনের জন্য। আর এখানে, পায়ের পুরোনো চোট আবারও মাথাচাড়া দেওয়ায় প্রতিযোগিতা শুরুর আগেই লিউ শিয়াংয়ের সরে দাঁড়ানো কীভাবে মানবে চীন? বিস্ময়-হতবাক-দুঃখ—সবকিছু ছাপিয়ে যে অনুভূতিটা হচ্ছে, সেটি শোকের। চীন এখন শোকের চাদরে ঢাকা।
প্রতিক্রিয়াটা কি একটু বেশি মনে হচ্ছে? হতে পারে, তবে সত্যি এটাই। এই অলিম্পিক দুহাত ভরে দিচ্ছে চীনকে। দীর্ঘদিন লৌহকপাট দিয়ে রাখা দেশটিকে বাকি বিশ্ব দেখছে নতুন চোখে। দেখছে এবং মুগ্ধ হচ্ছে। অলিম্পিক শুরুর আগে আলোচিত বায়ুদূষণ, তিব্বতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো নেতিবাচক দিকগুলো যেন মুছে গেছে গেমস শুরু হতে না-হতেই। আলোচনায় এখন বার্ডস নেস্ট ও ওয়াটার কিউব নামের স্থাপত্য-বিস্ময়, সবুজে সবুজ বেইজিং, চীনা আতিথেয়তা, গেমসের নিখুঁত আয়োজন। পদক তালিকায়ও জয়জয়কার। সেই ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেস গেমস থেকে শীর্ষস্থানটিকে নিজেদের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলা যুক্তরাষ্ট্রও এবার পেছনে পড়ে যাওয়ার শঙ্কায় কম্পমান। গেমসের এক সপ্তাহ বাকি থাকতেই চীন ছাড়িয়ে গেছে অলিম্পিক ইতিহাসে সেরা সাফল্যকে। কাল সকালে বার্ডস নেস্টের বাইরে রোরুদ্যমান জনতার এতে কিছু আসে-যায় বলে মনে হলো না। দেং পিয়াং নামের ২২ বছরের তরুণ যেমন প্রতিজ্ঞাই করে ফেলেছেন, এই অলিম্পিকে আর অ্যাথলেটিকস দেখতে আসবেন না। এলেই যে লিউ শিয়াংয়ের কথা মনে পড়বে। মনে পড়বে ওই দৃশ্যটা।
১১০ মিটার হার্ডলসের ষষ্ঠ হিটে কাতারের ইসা আল-তাহাওদি আগেই দৌড় শুরু করায় প্রতিযোগীদের আবার ফিরতে হলো লাইনে। আবার যখন দৌড় শুরু হলো, লিউ শিয়াং আর নেই! আগেরবার দৌড় শুরু করতেই ব্যথায় কুঁচকে গেছে তাঁর মুখ। খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফিরে ঊরুতে লাগানো নম্বরটা ছিঁড়ে ফেললেন, হতাশায় দেয়ালে লাথি দিলেন কয়েকবার। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের ফাইনাল সব রাতে হয় বলে সকালে তেমন দর্শক হয় না। লিউ শিয়াংকে দেখার জন্যই কাল সকালে অর্ধেকেরও বেশি ভরা বার্ডস নেস্ট চোখের সামনে স্বপ্নের এমন নিদারুণ মৃত্যু দেখে নিস্তব্ধ তখন।
বেইজিং অলিম্পিকের সূচি চূড়ান্ত হওয়ার পরই ক্যালেন্ডারের ২১ আগস্ট তারিখটাতে গোল দাগ দিয়ে রেখেছিল চীনারা। সেদিন রাতেই লিউ শিয়াং দৌড়াবেন, এনে দেবেন সোনা, যেটির প্রতিশ্রুতি তিনি চার বছর আগে এথেন্সে সোনা জেতার পরই দিয়ে রেখেছেন। ২১ আগস্ট রাত পৌনে ১০টায় সেই ১১০ মিটার হার্ডলস ঠিকই হবে। চীনাদের কাছে সেটি হবে স্বপ্নের শেষকৃত্যানুষ্ঠান।
লিউ শিয়াংই যে ছিলেন এই বেইজিং অলিম্পিকের ‘পোস্টার বয়’! এথেন্সে তাঁর বিশ্ব রেকর্ড সমান করা দৌড়টা ছিল অ্যাথলেটিকসে কোনো চীনা পুরুষের প্রথম সোনা জয়। এরপর থেকেই চীনের সবচেয়ে বিখ্যাত অ্যাথলেট তিনি। এথেন্সে ৩২টি সোনা জিতেছিল চীন, অথচ বাকি সবার কথা ভুলে লিউ শিয়াংকেই মনে রেখেছে সবাই। এথেন্সের পর তিন বছর ছিলেন প্রায় অপরাজিত, গড়েছেন বিশ্ব রেকর্ড। বেইজিংয়ের রাস্তায় রাস্তায় ভিটামিন ট্যাবলেট নিউট্রিলাইটের বিজ্ঞাপনে লিউ শিয়াংয়ের পোস্টার। কিউবার ডেরন রবলেস তাঁর বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন গত জুনে। তার পরও সেই পোস্টার দেখলে মনে হবে, বিশ্ব রেকর্ডটা এখনো লিউয়েরই আছে! কী যুক্তি? বেইজিং অলিম্পিকেই তো আবার বিশ্ব রেকর্ড গড়ে সোনা জিতবেন লিউ, থাকুক না ওগুলো!
শুধু ভিটামিন ট্যাবলেট কেন, ক্রেডিট কার্ড-ল্যাপটপ-কাঠের মেঝে... কিসের বিপণনে ব্যবহৃত হননি লিউ! এই হার্ডলার হয়ে উঠেছিলেন চীনা ক্রীড়াঙ্গনের মুখ। নামধামের সঙ্গে টাকাও কামিয়েছেন দেদার। চীনা ক্রীড়াবিদদের মধ্যে একমাত্র এনবিএ তারকা ইয়া মিংয়ের উপার্জনই ছিল লিউয়ের চেয়ে বেশি। সিচুয়ানে ভূমিকম্পের পর ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে দানই করেছিলেন তিন কোটি টাকারও বেশি।
এসবের অপরিহার্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে চাপটাও বাড়ছিল। বেইজিং অলিম্পিকে সোনা জয়ের চাপ। লিউয়ের কোচ সান হাইপিং কিছুদিন আগে জানিয়েছিলেন, চীনা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাঁকে বলেছেন, বেইজিংয়ে সোনা জিততে না পারলে লিউয়ের এত দিনের সব অর্জন বৃথা হয়ে যাবে। দিনকয়েক আগে লিউয়ের বাবা লিউ শুয়েজেনের কণ্ঠেও ফুটে বেরিয়েছে উদ্বেগ, ‘নিজের ছেলেকে এমন অগ্নিপরীক্ষায় নামতে দেখে যেকোনো বাবা-মায়েরই উদ্বেগ হবে, আমাদেরও হচ্ছে।’ ‘অগ্নিপরীক্ষা’টা হওয়ার কথা ছিল ২১ আগস্ট, বেইজিং অলিম্পিকে লিউ শিয়াংয়ের গল্প এমন শুরু হতে না-হতেই শেষ হয়ে যাবে, এটা কেউ কল্পনাও করেননি।
প্রশ্নটা তাই উঠছেই, পায়ের চোটটাই আসল কারণ নাকি এটি ১৩০ কোটি মানুষের অবিশ্বাস্য প্রত্যাশার চাপ থেকে পালানো? চীনের অ্যাথলেটিকস দলের প্রধান কোচ ফেং শোইয়ং ও লিউয়ের কোচ সান হাইপিংয়ের শোকবিধুর সংবাদ সম্মেলনেও ‘বেরসিক’ এক সাংবাদিক প্রশ্নটা করে বসলেন। সান এর আগেই বার কয়েক কেঁদেছেন, এবার একেবারেই আবেগের বাঁধ গেল তাঁর। ‘আপনাদের মধ্যে কেউ ক্রীড়াবিদ থেকে থাকলে বুঝতে পারবেন, কেমন ব্যথা হলে কেউ এভাবে প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়ায়’—বলতে বলতে কাঁদছেন আর রুমাল দিয়ে চোখ মুছছেন।
এ ধরনের প্রশ্ন ওঠার আরেকটা কারণ অনেক দিন ধরেই লিউ শিয়াংয়ের রহস্য হয়ে থাকা। হ্যামস্ট্রিংয়ে চোটের কারণে প্রায় এক বছর কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেননি, নিউইয়র্কে এক প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন শেষ মুহূর্তে। এ সময়টায় তাঁর সর্বশেষ পরিস্থিতিও ঢেকে রাখা হয়েছে গোপনীয়তার আবরণে। চীনা সাংবাদিকেরা অনেক চেষ্টা করেও সাক্ষাত্কার পাননি। এর সবকিছুকেই দেখা হচ্ছিল অসম্ভব চাপের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে। চাপটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল কিউবান তরুণ রবলেসের উত্থান। রবলেস তাঁর বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার দুদিন পরই লিউ শিয়াং নিজের নতুন কালো ক্যাডিলাক গাড়ির EC 1288 (লিউয়ের বিশ্ব রেকর্ডের টাইমিং ১২.৮৮ সেকেন্ড অনুসারে) নম্বর প্লেট বদলে ফেলেছিলেন FQ 1277-এ। সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর লক্ষ্য রেকর্ডটাকে ১২.৭৭ সেকেন্ডে নামিয়ে আনা।
সেটি যদি কোনোদিন করতেও পারেন, তার পরও বুকের গহিনে এই দুঃখটা চিরদিনই বয়ে বেড়াতে হবে লিউ শিয়াংকে। যে দুঃখের নাম—বেইজিং অলিম্পিক!