চিংলিশ

অলিম্পিকের বেইজিং

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

চিংলিশ

ছবি: গেটি ইমেজেস

বেইঞ্জিং অলিম্পিক কাভার করতে উৎপল শুভ্র যতদিনে চীনে পা রাখলেন অলিম্পিকের পাঁচ দিন চলে গেছে। এই লেখাটা অলিম্পিককে প্রথম দর্শনের অভিজ্ঞতা নিয়ে। বার্ডস নেস্ট স্টেডিয়াম আর ওয়াটার কিউবের স্থাপত্যকর্মের প্রশংসার সঙ্গে যাতে উঠে এসেছে চীনাদের ইংরেজি দুর্বলতার কথাও।

প্রথম প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০০৮। প্রথম আলো

অসংখ্যবার যা ছবিতে দেখেছেন, দেখেছেন টেলিভিশনের পর্দায়, সেটি চর্মচক্ষে প্রথম দেখার অনুভূতিটা কেমন? গত পরশু রাতে এই রোমাঞ্চের কথা আমার চেয়ে ভালো কেউ বলতে পারত না!

গত পরশু দুপুরে চায়না ইস্টার্নের বিমানে চেপে কুনমিংয়ে ঘণ্টাতিনেক যাত্রাবিরতির পর মাঝরাত পেরিয়ে বেইজিংয়ে। শরীরের কোষে কোষে ক্লান্তি। বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সিতে হোটেলে আসার পথে ঝিমুচ্ছি। হঠাৎ ডান দিকে তাকিয়ে সব ক্লান্তি উধাও! আলোতে ঝলমল করছে ‘বার্ডস নেস্ট’! পাশেই এই অলিম্পিকের আরেক স্থাপত্য-বিস্ময় ওয়াটার কিউব। গায়ে মায়াবী এক নীল আলো। এমনভাবে বানানো যে দেখতে ঠিক যেন বড় বড় জলের ফোঁটা!

হোটেলে পৌঁছানোর পর স্বস্তি। ঠিক জায়গাতেই যাচ্ছি কি না, এমন একটা অস্বস্তি যে সঙ্গী হয়েই ছিল। তা কাটানোর একমাত্র উপায় ছিল ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলা। একবার সেই চেষ্টাও করেছিলাম। ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। হড়বড় করে কী যেন বললেন! ভদ্রলোকের জাতীয়তা জানা ছিল বলেই কথা না বুঝলেও ভাষাটা কী তা অনুমান করতে পারলাম। নইলে হিব্রু-পালি যা কিছু একটা ভেবে নিতেও পারতাম।

কথা না বুঝলেও এটুকু বোঝা গেল যে, ড্রাইভার সাহেব ইংরেজির বিন্দুবিসর্গও বোঝেন না। শুরু থেকেই অলিম্পিক কাভার করতে আসা বাংলাদেশের অন্য সাংবাদিকদের লেখা থেকে আগেই জেনেছিলাম সমস্যাটা। বিমানে তা আরও ভালো করে জেনেছি। চীনা বিমানবালারা পর্যন্ত একেকজন ইংরেজির জাহাজ! একদমই বলতে পারেন না তা নয়, তবে এমনই বিচিত্র সেই উচ্চারণ যে, ইংরেজিই বলছেন এটা বোঝা সহজ কম্মো নয়। সহযাত্রী দু-একজনের সঙ্গে কথা বলেও একই অভিজ্ঞতা। মহা চিন্তায় পড়ে গেলাম। বেইজিংয়ে মাঝরাতে নামার পর তা হলে কী হবে, ট্যাক্সি ড্রাইভারকে হোটেলের ঠিকানা বোঝাব কীভাবে!

বেইজিংয়ে নামার পর কুনমিং আর ঢাকা থেকে আসা যাত্রীদের আলাদা করা হলো। তখনই সহায় হয়ে এলেন চীনা এক ভদ্রলোক। এই দেখো, চাই চ্যাং জাতীয় কী নাম বলেছিলেন ভুলেই গেছি! বড়পুকুরিয়ার কয়লাখনিতে যে চীনা কোম্পানি কাজ করে, ভদ্রলোক সেটির বড় এক কর্তা। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারেন। বুদ্ধি করে তাঁকে দিয়ে হোটেলের নাম-ঠিকানাটা চায়নিজে লিখিয়ে নিলাম। উনি আরেকটু বেশি করলেন, ঠিকানার ওপরে ‘আমি এই হোটেলে যেতে চাই’ এই কথাটাও চায়নিজে লিখে আমাকে বললেন, এটা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে দিলেই হবে।

সেই বিখ্যাত 'ওয়াটার কিউব'। ছবি: ইউয়ান্ডা

আমার সব আশঙ্কাকে মিথ্যা প্রমাণ করে শেষ পর্যন্ত অবশ্য বিমানবন্দর থেকে হোটেলের যাত্রাপথটা নির্বিঘ্নই হলো। অবদান সবটা অলিম্পিকেরই প্রাণ হয়ে থাকা স্বেচ্ছাসেবকদের। বিমানবন্দরে অলিম্পিকের জন্য বিশেষ বুথে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড সত্যায়িত করার পর এটিএম মেশিনে ডলার ভাঙানো থেকে শুরু করে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে হোটেলের ঠিকানা বুঝিয়ে-টুঝিয়ে দিতে আমাকে ঘিরে রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁদের তিন-তিনজন।

সুপার এইট হোটেলের রিসেপশনেও দাঁড়ালাম একটু অস্বস্তি নিয়েই। ৪ আগস্ট আসব বলে হোটেল বুকিং দিয়েছিলাম। চারবার পিছিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৩ তারিখে, রুম রাখা আছে কি না কে জানে! কী শান্তি, আছে! 

রুমে ঢুকে অবশ্য একটু মন খারাপই হলো। ১১০ ডলার ভাড়া, অথচ ঘরে হাঁটতে গেলে নিজের সঙ্গেই নিজের ধাক্কা লাগে, এমন অবস্থা! মন খারাপ ভাবটা কেটে গেল ফ্র্যাঙ্ক নামে ২০ বছর বয়সী তরুণের আতিথেয়তায়। বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়ছেন, অলিম্পিকের অংশ হওয়ার জন্যই কাজ করছেন এই সময়টায়। দারুণ হাসিখুশি ছেলে। যদিও হোটেলে হরেক দেশের সাংবাদিকদের মধ্যে বাংলাদেশের কাউকে প্রথম পেয়ে এমন খুশির কী আছে, তা একদমই বুঝলাম না।

ইংরেজির ছাত্র, তবে খুব ভালো ছাত্র বলে মনে হলো না। বোঝা এবং বোঝানো দুটিই একই রকম কঠিন মনে হলো। আমি যা-ই বলি, ‘প্লিজ আস্তে বলো’ অনুরোধ। কাল সকালে মেইন প্রেস সেন্টারেও একই অভিজ্ঞতা আমার প্রয়াত বাবার কথা বারবারই মনে করিয়ে দিল। একটু দ্রুত কথা বলার অভ্যাস বলে বাবা আমাকে প্রায়ই ধমক দিয়ে বলতেন, ‘দাঁড়ি-কমা দিয়ে কথা বল্!’ চীনাদের সঙ্গে ইংরেজি বলতে গিয়ে শুধু দাঁড়ি-কমা দিলেই চলছে না, প্রতিটি শব্দের পর ‘যাত্রাবিরতি’ করতে হচ্ছে!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×