দ্রুততম মানবের হ্যাটট্রিকের সেই রাত
২০১৬ রিও অলিম্পিক
উৎপল শুভ্র
২০ জুলাই ২০২১
চার বছর আগে লন্ডন অলিম্পিকে টানা দ্বিতীয়বার `ট্রিপল` জিতেই সর্বকালের সেরা স্প্রিন্টারের স্বীকৃতি পাওয়া হয়ে গিয়েছিল বোল্টের। তারপরও কারও মনে ক্ষীণতম সংশয় থেকে থাকলে সেটিও মুছে দিয়েছেন রিওতে। ছেলে-মেয়ে মিলিয়েই অলিম্পিকে তিনটি ১০০ মিটার জেতেননি আর কেউ। তবে বোল্টকে কে যেন বলেছেন, অমরত্ব পেতে তিনটি অলিম্পিকে ট্রিপল জিততে হবে। বোল্ট রিওতে এসেছিলেন সেই অমরত্বকে ধাওয়া করতেই।
প্রথম প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো
দৌড় তো মাত্র ১০ সেকেন্ডের। আরও নির্দিষ্ট করে বললে এদিন ৯.৮১ সেকেন্ড। কিন্তু সেটির রেশ যেন শেষই হতে চায় না। তিনি উসাইন বোল্ট হলে তো আরও না।
দৌড় শেষ করে চক্কর দিলেন পুরো স্টেডিয়াম। সব সময়ই দেন। হাত মেলালেন অনেকের সঙ্গে। সব সময়ই মেলান। অলিম্পিক মাসকটকে সঙ্গী করে নেওয়ার অভ্যাসটাও পুরোনো। এবারও তা নিলেন। সেটি হাতে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একসময় তা দিয়েও দিলেন এক দর্শককে। হেপ্টাথলনের পুরস্কার বিতরণী হয়েছে একটু আগে। তাঁর সঙ্গে পদকজয়ীদের সেলফি তোলার আবদার মেটালেন। কিন্তু উসাইন বোল্টের সমার্থক হয়ে যাওয়া সেই উদযাপন কোথায়? এবার সেটি হলো অনেক পরে। দুই হাতে তির ছোড়ার বিখ্যাত সেই ভঙ্গি—লাইটনিং বোল্ট!
‘উসাইন বোল্ট’ ‘উসাইন বোল্ট’ চিৎকারে মুখর অলিম্পিক স্টেডিয়াম এবার যেন ফেটে পড়ল। দর্শকদের এমন জড়িয়ে ফেলা বোল্টের দর্শনেরই অংশ। এই অলিম্পিকে এসে আবারও জানিয়েছেন যে দর্শনের কথা, নিজেকে তিনি মনে করেন বিনোদনের ফেরিওয়ালা। কারণ দর্শক বিনোদন পেতেই ভিড় করে গ্যালারিতে। এদিনও সংবাদ সম্মেলনে এসে বললেন, দর্শক শুধুই দর্শক হয়ে থাকবে কেন, যা হচ্ছে, তাদেরও সেটির অংশ করে নিতে হবে।
উসাইন বোল্ট ট্র্যাকে নামলেই যে পুরো স্টেডিয়াম তাঁর হয়ে যায়, সেটির কারণ শুধু এই ধরাধামে সবচেয়ে জোরে দৌড়াতে পারার ক্ষমতা নয়, ওই দর্শনেরও তাতে বড় ভূমিকা। আগের দিনের হিট থেকে শুরু করে ফাইনালের ঘণ্টা দেড়েক আগে সেমিফাইনাল—বোল্টকে ঘিরে উন্মাদনা আবারও পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল, বোল্ট শুধু সর্বকালের সেরা স্প্রিন্টারই নন, সম্ভবত খেলাধুলার ইতিহাসে জনপ্রিয়তম চ্যাম্পিয়নও।
ট্র্যাকে বোল্ট আর গ্যাটলিন যেন ‘ভালো-মন্দ’, ‘সুর-অসুর’-এর প্রতীক। ডোপ টেস্টে ধরা পড়ে দুবার নিষিদ্ধ হওয়া জাস্টিন গ্যাটলিনের জন্য তাই গ্যালারি থেকে দুয়োধ্বনি ওঠে। বোল্টের নাম উচ্চারিত হওয়ামাত্র তুমুল উল্লাস। ট্র্যাকের লড়াইটাও গ্যাটলিনের সঙ্গেই হলো। যাতে যথারীতি গ্যাটলিন দ্বিতীয়। সান্ত্বনা বলতে, অলিম্পিকের ১০০ মিটারে সবচেয়ে বেশি বয়সে পদক জেতার রেকর্ডটা ১৯৯২ অলিম্পিকে সোনাজয়ী লিনফোর্ড ক্রিস্টির কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারলেন।
চার বছর আগে লন্ডন অলিম্পিকে টানা দ্বিতীয়বার ‘ট্রিপল’ জিতেই সর্বকালের সেরা স্প্রিন্টারের স্বীকৃতি পাওয়া হয়ে গিয়েছিল বোল্টের। তারপরও কারও মনে ক্ষীণতম সংশয় থেকে থাকলে সেটিও মুছে দিলেন রিওতে। ছেলে-মেয়ে মিলিয়েই অলিম্পিকে তিনটি ১০০ মিটার জেতেননি আর কেউ। বরাবরেই মতোই শুরুটা ছিল ধীর। মাত্র একজনই তাঁর পেছনে। কিন্তু বোল্ট তো বোল্ট হয়েছেন শেষ ৫০ মিটারের জন্য। ১০০ মিটার শেষ করতে তাঁর ৪১ বা ৪২ বার পা ফেললেই হয়। অন্যদের যেখানে ফেলতে হয় ৪৩-৪৪ বার, কারও কারও ৪৬ বারও। শেষ ৫০ মিটারে তাঁর গতি যেন আরও বাড়ে। আসলে তো আর বাড়ে না। অন্যদের গতি তাঁর তুলনায় অনেক কমে যায় বলে মনে হয় অমন। এবারও সেই পুরোনো ছবিই।
হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়ে জ্যামাইকান ট্রায়াল শেষ করতে পারেননি। গত দুটি মৌসুমজুড়েই নানা চোটের সঙ্গে যুদ্ধ। গত বছর বিশ্ব অ্যাথলেটিকস জিতেছেন জাস্টিন গ্যাটলিনকে সেকেন্ডের এক শতাংশ পেছনে ফেলে। এবারও তাই নানা ফিসফাস ছিল—পারবেন তো বোল্ট? ৯.৮৬ সেকেন্ডে সেমিফাইনাল দৌড়েই যেটি থামিয়ে দিয়েছিলেন অনেকটাই। মঞ্চ যত বড়, তিনি ততই দুর্দান্ত। আবারও সেটি প্রমাণ করে মৌসুমে নিজের সেরা সেই সময়কে পেরিয়ে গেলেন ফাইনালে। এবার ৯.৮১ সেকেন্ড। যা নিয়ে বোল্ট একদমই খুশি নন।
বেইজিংয়ে জিতেছিলেন বিশ্ব রেকর্ড গড়ে। লন্ডনে অলিম্পিক রেকর্ড। এবার তেমন কিছু না হওয়ার পেছনে দায়ী করলেন সেমিফাইনাল আর ফাইনালের মাঝখানের সময়টা ব্যতিক্রমীভাবে কমে যাওয়াকে। দুই ঘণ্টার বদলে এখানে যা এক ঘণ্টা ২০ মিনিট। শেষ পর্যন্ত সোনা জিতেই খুশি থাকছেন। রেকর্ড ভাঙার ব্যাপারটা তুলে রাখছেন ২০০ মিটারের জন্য।
বোল্টের মতো চ্যাম্পিয়নরা অন্যদের চেয়ে আলাদা হয়ে যান প্রবল আত্মবিশ্বাসের কারণে। কথাবার্তায়ও সেটি ফুটে বেরোয়। বেরোল এদিনও, ‘নিজেকে নিয়ে আমার কোনো সংশয় ছিল না। আর এ মৌসুমটা তো গত মৌসুমের চেয়ে ভালো কেটেছে। গত মৌসুমে আমি সত্যিই ঝামেলায় ছিলাম।’
তারপরও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ঠিকই সোনা জিতেছেন। ওই যে যত বড় মঞ্চ, ততই অপ্রতিরোধ্য। ২০০৮ সালে বিশ্বমঞ্চে আবির্ভাবের পর বড় কোনো আসরে ব্যর্থতা বলতে ২০১১ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। দেগুতে ফলস স্টার্ট করে ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে যাওয়ার সেই স্মৃতি এদিনও হয়তো ফিরে এসেছিল তাঁর মনে। সেমিফাইনালে বাহরাইনের (সাবেক জ্যামাইকান) অ্যান্ড্রু ফিশার ফলস স্টার্ট করায় যখন আবার দাঁড়াতে হলো স্টার্টিং ব্লকে।
লন্ডনে ১০০ মিটার জিতে নিজেই বলেছিলেন, ২০০ মিটার জিতলেই তিনি কিংবদন্তি। রিওতেও জিতলে কী হবে? কিংবদন্তির পর কী? গত বছরই বোল্টকে কে যেন বলেছিলেন, রিও অলিম্পিকেও ট্রিপল জিততে পারলে অমরত্ব পেয়ে যাবেন তিনি। সেটিকেই শিরোধার্য করে নিয়েছেন। জ্যামাইকান ‘বজ্রবিদ্যুৎ’ এবার তাই অমরত্বের সন্ধানে।
কী আশ্চর্য, এরই মধ্যে কি তা পেয়ে যাননি!