কোথায় থামবেন ফেলপস!
২০১৬ রিও অলিম্পিক
উৎপল শুভ্র
২০ জুলাই ২০২১
২০০৮ অলিম্পিকের মাস চারেক পর বাজারে এসেছিল তাঁর আত্মজীবনী। যেটির নাম নো লিমিটস। নিচে ছোট করে লেখা ছিল আরও চারটি শব্দ-দ্য উইল টু সাকসেস। সাফল্য পাওয়ার জন্য তীব্র ইচ্ছাশক্তি সব চ্যাম্পিয়নেরই থাকে। সেটাই তাঁদের চ্যাম্পিয়ন বানায়। সেটি তাই চলছে না। মাইকেল ফেলপসকে বোঝাতে বইয়ের মূল নামটাই বোধ হয় বেশি উপযুক্ত—নো লিমিটস!
প্রথম প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো
কী বলবেন ফেলপসকে?
জলদানব? বলা হয়ে গেছে। অতিমানব? এটাও অনেক পুরোনো।
তাহলে নতুন কী নামে ডাকা যায়?
আসলেই কঠিন সমস্যায় ফেলে দিচ্ছেন মাইকেল ফেলপস।
বেইজিং অলিম্পিকে যখন ৮টি ইভেন্টে পুলে নেমে ৮টিতেই সোনা জিতলেন, তখনই বিশেষণের ভান্ডারে টান পড়ে গিয়েছিল। সেই অলিম্পিক শেষে মেইন প্রেস সেন্টারে অদ্ভুত একটা আলোচনা শুনেছিলাম। মাইকেল ফেলপস যদি একটা ‘দেশ’ হতেন, তাহলে পদক তালিকার কত নম্বরে থাকত তাঁর নাম!
লন্ডন অলিম্পিক শেষে ‘বিদায়’ নিলেন ১৮টি সোনা ও মোট ২২টি পদক জিতে। বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেওয়ার মতো সেটিই ছিল যথেষ্ট।
অবসর থেকে ফিরে ‘বুড়ো’ ফেলপস রিও অলিম্পিকে যা করছেন, সেটিকে তাহলে কী বলবেন? আক্ষরিক অর্থেই তো তা ভাষায় প্রকাশ করা যাচ্ছে না। আর কী-ই বা বলার বাকি আছে! ব্যাখ্যাতীত কিছুকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়!
হাত পাততে হচ্ছে ফেলপসের কাছেই। ২০০৮ অলিম্পিকের মাস চারেক পর বাজারে এসেছিল তাঁর আত্মজীবনী। যেটির নাম নো লিমিটস। নিচে ছোট করে লেখা ছিল আরও চারটি শব্দ—দ্য উইল টু সাকসেস। সাফল্য পাওয়ার জন্য তীব্র ইচ্ছাশক্তি সব চ্যাম্পিয়নেরই থাকে। সেটাই তাঁদের চ্যাম্পিয়ন বানায়। সেটি তাই চলছে না। মাইকেল ফেলপসকে বোঝাতে বইয়ের মূল নামটাই বোধ হয় বেশি উপযুক্ত—নো লিমিটস!
উচ্চতায় ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি। দুপাশে দুহাত ছড়িয়ে দিলে যে প্রস্থটা হয়, সাঁতারের ভাষায় যেটিকে বলে ‘উইংস’, তা তাঁর উচ্চতাকে ছাড়িয়ে যায়। তাঁর শরীরটা যেন সাঁতরানোর জন্যই অর্ডার দিয়ে বানানো। তা না হয় হলো, তবে এমন তো আরও অনেকেই ছিলেন। কে, কবে অলিম্পিক সোনাকে এমন ছেলেখেলার বিষয় বানিয়ে ফেলতে পেরেছেন!
গত পরশু ২০০ মিটার বাটারফ্লাই ও ২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলে জিতে অলিম্পিক সোনার সংখ্যা নিয়ে গেছেন ২১-এ। এখানেই তো শেষ নয়। কোথায় থামবেন কে জানে! ফেলপস নিজেও যেন একটু বিস্মিত। অলিম্পিক ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সে সাঁতারের ব্যক্তিগত সোনা জয়ের রেকর্ড করার পর কোচ বব বাউম্যানের সঙ্গে আলাপচারিতার কথা জানিয়েছেন নিজেই। পদকের সংখ্যাটাকে নাকি গুরু-শিষ্য দুজনের কাছেই ‘পাগলামি’ মনে হচ্ছে।
রিওতে যাঁদের সঙ্গে সাঁতরাচ্ছেন, তাঁরা সবাই বড় হয়েছেন ফেলপসের সাঁতার দেখতে দেখতে। প্রায় সবারই শৈশব-কৈশোরের নায়ক ছিলেন ফেলপস। টুইটারে কে যেন একটা ছবি পোস্ট করেছেন, নয় বছরের ছোট্ট একটা মেয়ে ফেলপসের অটোগ্রাফ নিচ্ছেন। সেই মেয়েটির নাম বললে আপনার চেনার কথা। কেটি লেডেকি। মেয়েদের সাঁতারের বর্তমান সেনসেশন। বয়স ত্রিশ পেরোনো মানেই যেখানে সাঁতারুদের মৃত্যুঘণ্টা বেজে যাওয়া, ৩১ বছর বয়সী ফেলপস বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই চলেছেন। সন্দেহবাদীদের কথাবার্তাকেও কি নয়! অবসর নিয়ে ফেলার পর ফেরার চেষ্টা করে বেশির ভাগ ক্রীড়াবিদই নিষ্ঠুর একটা সত্যি আবিষ্কার করেন, একসময় অনায়াসেই যা পারতেন, অনেক কষ্ট করেও এখন আর তা পারেন না। অনেক গ্রেটও পারেননি। টেনিসে বিয়ন বোর্গ পারেননি, বক্সিংয়ে মোহাম্মদ আলীও। দুই বছর আগে ফেলপস যখন আবার ফেরার ঘোষণা দিলেন, অনেকেরই সন্দেহ ছিল, রিও অলিম্পিকে সোনা জেতা দূরে থাক, কোয়ালিফাই-ই হয়তো করতে পারবেন না।
কীভাবে পারলেন ফেলপস? প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরেই কি? টুইটারেই ভাইরাল হয়ে যাওয়া আরেকটি ছবি এ কথাই বলে। ২০০ মিটার বাটারফ্লাই সেমিফাইনাল শুরুর আগে ওয়ার্মআপ জোনে তাঁর সামনে এক সতীর্থ মজা করে নাচছেন। মাথায় তোয়ালে দিয়ে একটা চেয়ারে বসে থাকা ফেলপস যেন ধ্যানমগ্ন ঋষি। চোখের স্থির দৃষ্টি হারিয়ে গেছে সুদূরে কোথাও।
পুরোনো আরেকটা তর্কও কিন্তু জাগিয়ে তুললেন ফেলপস। সবচেয়ে বেশি সোনা, সবচেয়ে বেশি পদক—লন্ডন অলিম্পিক শেষেই কথাটা উঠেছিল। মাইকেল ফেলপস কি তাহলে সর্বকালের সেরা অলিম্পিয়ান? ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির সে সময়ের প্রধান জ্যাক রগ যেটিকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন এই যুক্তিতে, সাঁতারে একজনের সাতটি-আটটি পদক জেতার সুযোগ থাকে। অন্য খেলায় যা নেই।
সেরা অলিম্পিয়ান নিয়ে তর্কবিতর্কে ‘দীঘস্থায়িত্ব’ খুব গুরুত্ব পায়। ৪টি সোনা জিতেও অনেকের চোখে তাই সেরা অলিম্পিয়ান আল ওয়ের্টার। সেই ৪টি সোনা চারটি ভিন্ন অলিম্পিকে। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত ডিসকাস থ্রোতে।
২০০০ সালে সিডনি অলিম্পিকে ১৫ বছরের ফেলপস কোনো পদক পাননি। তবে তাতে অংশ নেওয়ার জন্য কিছু নম্বর তো পাবেনই। ষোলো বছর, টানা পাঁচটি অলিম্পিক, ‘অবাস্তব’ মনে হওয়া পদকসংখ্যা, যার সিংহভাগই আবার সোনা—এই অলিম্পিক শেষ হতে হতে সর্বকালের সেরা অলিম্পিয়ানের অদৃশ্য মুকুটটা বোধ হয় মাইকেল ফেলপসের মাথায় পরিয়েই দিতে হবে!