রাফায়েলা ও তাঁরা দুজন

২০১৬ রিও অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২০ জুলাই ২০২১

রাফায়েলা ও তাঁরা দুজন

ছবি: গেটি ইমেজেস

রিওর সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ এক এলাকায় জন্ম রাফায়েলার। যেখানে চুরিচামারি, খুনখারাবি ছিল প্রতিদিনের রুটিন ব্যাপার। একসময় পুলিশও যেখানে যেতে ভয় পেত। সেই নরক থেকে উঠে এসে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন-রাফায়েলা সিলভাকে কী করতে হয়েছে, তা তিনি নিজে জানেন আর জানেন সর্বজ্ঞ ঈশ্বর।

প্রথম প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো

ও’গ্লোবো পত্রিকার প্রথম পাতায় বিশাল একটা ছবি। সোনার পদকে কামড় দিয়ে হাসছেন তিনি। একটু আগের ছবিটাও টেলিভিশনে দেখা হয়ে গেছে। বিজয়মঞ্চে দাঁড়িয়ে তখন কাঁদছিলেন।

ব্রাজিলের সব পত্রপত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠাজুড়েই কাল রাফায়েলা সিলভা। তৃতীয় দিনে এসে ব্রাজিলকে যিনি জিতিয়েছেন রিও অলিম্পিকে প্রথম সোনা। যেটির আরও একটা তাৎপর্য আছে। রিও অলিম্পিকে ব্রাজিলকে প্রথম সোনা এনে দিলেন রিওরই এক মেয়ে।

রাফায়েলা সিলভার বাহুতে একটা উলকি আছে। গত বছর জুডোর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রাজিলের প্রথম মেয়ে হিসেবে সোনা জেতার পর যেটি আঁকিয়েছিলেন। কোনো ছবি নয়, পর্তুগিজ ভাষায় লেখা কিছু কথা। যেটি বাংলা করলে এমন হয়—‘আমাকে কতটা ভুগতে হয়েছে, এখানে আসতে কী করতে হয়েছে, শুধু ঈশ্বরই তা জানেন।’

পদক নিতে গিয়ে কাঁদছেন রাফায়েলা। ছবি: গেটি ইমেজেস

রাফায়েলা সিলভা নিজেও জানেন। রিও ডি জেনিরো কোপাকাবানার বিস্তৃত সৈকত, বিশ্বের সবচেয়ে বর্ণিল কার্নিভাল, পাহাড়ের মাথায় দুই হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রাইস্ট দ্য রিডিমারের জন্য যতটা বিখ্যাত, ততটাই কুখ্যাত অপরাধপ্রবণতার জন্য। রিওর সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ এক এলাকায় জন্ম রাফায়েলার। যেখানে চুরিচামারি, খুনখারাবি ছিল প্রতিদিনের রুটিন ব্যাপার। একসময় পুলিশও যেখানে যেতে ভয় পেত। সেই নরক থেকে উঠে এসে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন—রাফায়েলা সিলভাকে কী করতে হয়েছে, তা তিনি নিজে জানেন আর জানেন সর্বজ্ঞ ঈশ্বর।

লন্ডন অলিম্পিকে প্রথম রাউন্ডেই ডিসকোয়ালিফাইড হয়ে গিয়েছিলেন। এর সঙ্গে জুটেছিল ‘বানর’ ‘বানর’ বলে টিপ্পনী। ক্ষোভে-দুঃখে খেলাই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। মনোবিদের সঙ্গে কাটানো দীর্ঘ সময় আবার জুডোতে ফেরায় তাঁর মন।

খেলা ছেড়ে দিতে চেয়েও আবারও ফিরেছেন, এমন অনেকেই আছেন এই অলিম্পিকে। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত নামটি আপনার জানা থাকার কথা। কোনো ক্ষোভ-দুঃখ থেকে নয়, মাইকেল ফেলপসের সাঁতার ছেড়ে দেওয়ার কারণ ছিল অন্য। ‘অনেক হয়েছে, অনেক পেয়েছি, এবার যাই’—অলিম্পিকে ১৮টি সোনা আর ২২টি পদকের চূড়ায় উঠে এমন মনে হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। পুলের নীল জলের অমোঘ আকর্ষণ আর রক্তে মিশে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝনঝনানি আবারও ফিরিয়ে এনেছে তাঁকে। হয়তো সাঁতার-পরবর্তী জীবন এলোমেলো হয়ে যাওয়াও।

বেইজিং অলিম্পিকের সেই অপ্রতিরোধ্য ফেলপস হয়তো নন, তবে সাঁতারটা যে তিনি এখনো বাকি অনেকের চেয়ে ভালো পারেন, এর প্রমাণ এরই মধ্যে দিয়েছেন। ৪ x ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলেতে যুক্তরাষ্ট্রের সোনায় তাঁরই সবচেয়ে বড় অবদান। পত্রিকার পাঠকেরা এই লেখা যখন পড়ছেন, ততক্ষণে কি ফেলপস গড়ে ফেলেছেন আরেকটি নতুন ইতিহাস?

রিওতে মঙ্গলবার রাতে যখন পুলে নামবেন, বাংলাদেশে তখন বুধবার সকাল। এতক্ষণে ২০০ মিটার বাটারফ্লাই হয়তো শেষও হয়ে গেছে। যাতে জিতে থাকলে প্রথম সাঁতারু হিসেবে চারটি অলিম্পিকে এক ইভেন্টের সোনা জয়ের নতুন ইতিহাস লিখে ফেলেছেন ফেলপস। তিনটি অলিম্পিকে একই ইভেন্টে সোনাও পুরুষ সাঁতারুদের মধ্যে আর কারও নেই। কিন্তু এই কীর্তির অংশীদার হয়ে আছেন দুজন মেয়ে—অস্ট্রেলিয়ার ডন ফ্রেজার (১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ১৯৫৬-৬৪) ও হাঙ্গেরির ক্রিস্টিনা এগারজেগি (২০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোক, ১৯৮৮-৯৬)। পুরুষ-মহিলা মিলিয়েই ফেলপসের এক এবং অনন্য হয়ে যাওয়াটা মনে হচ্ছে অবশ্যম্ভাবী। ২০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে যদি না-ও পেরে থাকেন, সুযোগ আসবে পরদিনই। ২০০ মিটার ব্যক্তিগত মিডলে আছে, আছে ১০০ মিটার বাটারফ্লাই এবং আরও দুটি রিলে।

অলিম্পিকে তাঁর ১৯টি সোনার ১১টিই একক ইভেন্টে। এই অলিম্পিকে আর একটি জিততে পারলেই সবচেয়ে বেশি বয়সে ব্যক্তিগত সোনা জেতার রেকর্ডটাও করে ফেলবেন ফেলপস। বয়স এখন ৩১, সাঁতারের পৃথিবীতে ফেলপস রীতিমতো বুড়ো।

বয়সটাকে নিছকই সংখ্যা বলে প্রমাণ করার কাজটা ফেলপস শুধু পুলেই করেন। গত দুটি অলিম্পিকে স্পটলাইট নিয়ে যাঁর সঙ্গে লড়াই, জ্যামাইকান সেই গতিমানব যা করেন প্রতিটি পদক্ষেপেই। ট্র্যাকে নামার আগে গত পরশু শেষ সংবাদ সম্মেলনে উসাইন বোল্ট ভালোমতোই বুঝিয়ে দিলেন, বয়স বাড়লেও মনটা তাঁর সেই কৈশোরেই আটকে আছে। সংবাদ সম্মেলনে ঢোকার সময় মৃদু একটা হাততালি উঠেছে। বোল্টের তা পছন্দ হয়নি। ‘এটা কী হচ্ছে, আরও জোরে তালি দিতে হবে’—দাবি জানিয়ে তা আদায়ও করে নিয়েছেন অবলীলায়। হাসি-তামাশা-রসিকতা-ছেলেমানুষিতে ভরা বোল্টের চিরন্তন সংবাদ সম্মেলন। যেটির এক ফাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন ১৯ সেকেন্ডের নিচে ২০০ মিটার দৌড়ানোর অবিশ্বাস্য এক লক্ষ্যের কথাও।

সংবাদ সম্মেলনের শেষটা হয়েছে আরও অদ্ভুতভাবে। সাম্বা নাচতে থাকা ব্রাজিলিয়ান মেয়েদের সঙ্গে মিশে গেছেন বোল্ট। নেচেছেন নিজেও।

অলিম্পিকে ‘বোল্ট পার্টি’র আগমন-ধ্বনি বাজতে শুরু করেছে!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×