নিজের সেরাটাও হলো না বাকির
২০১৬ রিও অলিম্পিক
উৎপল শুভ্র
২০ জুলাই ২০২১
অলিম্পিকে পদক জয়ের স্বপ্ন দেখা তো বাংলাদেশের প্রতিযোগীদের জন্য দূর অস্তই, লক্ষ্যটা তাই থাকে নিজের সেরা স্কোর করার। রিও অলিম্পিকে গিয়ে বাকিরও একই লক্ষ্য ছিল। তবে বাকি ছুঁতে পারেননি সেটাও। সান্ত্বনা হয়ে ছিল একটা তথ্যই, আরও অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া শুটাররাও শেষ করেছিলেন বাকির পেছনে থেকে।
প্রথম প্রকাশ: ৯ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো
তাঁর শয়নে-স্বপনে শুটিং। গত কিছুদিন ঘুমালে যে স্বপ্নটা প্রায় নিয়মিতই দেখতেন, তাতে রাইফেলের ট্রিগার টিপছেন আর সবই লাগছে ‘পাখির চোখে’। স্বপ্নে শুটিং রেঞ্জ বদলে বদলে যেত। কখনো কি সেটি দেওদোরোর শুটিং রেঞ্জের রূপ নিত?
আবদুল্লাহ হেল বাকি নিশ্চিত নন। তবে রিও অলিম্পিকে আসা নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে মনের কোণে একটা স্বপ্ন তো ডালপালা মেলছিলই। বাংলাদেশের কোনো ক্রীড়াবিদের অলিম্পিক পদকের স্বপ্ন দেখাটাই বাড়াবাড়ি। কিন্তু অলৌকিক কিছু কি আর ঘটে না!
না, ঘটে না। অন্তত প্রতিদ্বন্দ্বিতামুখর আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে নয়, অলিম্পিক যেটির সর্বোচ্চ মঞ্চ। যে কারণে বাকির কোয়ালিফিকেশন পর্ব পেরিয়ে ফাইনালেই ওঠা হয় না। সেরা আটের মধ্যে থাকাটা তো আর সহজ কথা নয়। কিন্তু বাস্তবোচিত যে লক্ষ্যটা ঠিক করে নিয়েছিলেন, সেটিও যে হলো না। ১০ মিটার এয়ার রাইফেলের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাকির সেরা স্কোর ৬২৪.৮। গত মে মাসে মিউনিখে শুটিংয়ের এক বিশ্বকাপে। রিওতে করতে পারলেন ৬২১.২। ফাইনালিস্ট আটজনের মধ্যে অষ্টমজনের স্কোর যেখানে ৬২৫.৫। খুব বেশি পার্থক্য মনে হচ্ছে না? মনে হবে, যখন জানবেন অষ্টমজন আর বাকির মাঝখানে ১৬ জন আছেন!
দুই বছর আগে গ্লাসগোতে কমনওয়েলথ গেমসে রুপা জিতেছিলেন। কিন্তু কমনওয়েলথ গেমস যদি সাগর হয়, অলিম্পিক মহাসাগর। বাকিরও তা জানা ছিল। আরও ভালো করে জানলেন। শেষ পর্যন্ত ৫০ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ২৫তম। শুরুটা অবশ্য ভালোই করেছিলেন। একটা সময় স্কোরবোর্ডে চার নম্বরেও ছিল তাঁর নাম। কিন্তু ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনঃসংযোগ ধরে রাখা। টানা পৌনে দুই ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে একই রকম মনোযোগে ৬০টি গুলি ছোড়া শারীরিক সক্ষমতার যতটা পরীক্ষা নেয়, তার চেয়ে বেশি মানসিক শক্তির। ১০টি করে শটের প্রথম তিনটি সিরিজে খুবই ভালো করেছিলেন বাকি। তৃতীয়টিতে স্কোর ১০৫.৪। ওই সিরিজে তাঁর চেয়ে মাত্র একজনই বেশি স্কোর করতে পেরেছেন, সেটিও মাত্র দশমিক ৫ বেশি। কিন্তু পঞ্চম সিরিজে এসে বাকি করে বসলেন ১০০.৬। স্বপ্ন-টপ্ন যা ছিল, এতেই তা সমাধিস্থ হয়ে গেল।
সমস্যাটা মনঃসংযোগের বলে মানতে চাইলেন না। তবে কেন এমন হলো, এর উত্তর বাকিরও জানা নেই। শুটিং শেষ করে যখন বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে এলেন, তাঁর চোখেমুখে রাজ্যের আঁধার। দুই হাত দূরে দাঁড়িয়েও শুনতে কান পাততে হয় এমন অনুচ্চ স্বরে বললেন, ‘জানি না কী হয়ে গেল! কাল এখানে প্র্যাকটিসেও আমি ৬২৬ করেছি। আজ আর একটা শট ভালো হলেই তো হয়ে যেত।’
‘হয়ে যাওয়া’ বলতে ফাইনালে কোয়ালিফাই করাটাকেই বুঝিয়েছেন। দেওদোরোর এই শুটিং রেঞ্জের সঙ্গে অলিম্পিকেই বাকির প্রথম পরিচয় নয়। এর আগে এখানে বিশ্বকাপ শুটিংয়ে অংশ নিয়েছেন। তখন এই শুটিং রেঞ্জ, এর আশপাশের জায়গা ভিডিও করে নিয়ে গিয়েছিলেন। গত কিছুদিন যেটি দেখতে দেখতে নিজেকে এখানে কল্পনা করতেন। নিজের পারফরম্যান্সে এতটাই আশাহত যে, এই বিষয়ক প্রশ্নটাই ঠিক বুঝতে পারলেন না।
অলিম্পিকে বাংলাদেশের কোনো ক্রীড়াবিদের অংশ নেওয়া মানেই আক্ষেপটা বেড়ে যাওয়া। অনুশীলন-সুবিধা থেকে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া—সবকিছুতেই তো সেরাদের সঙ্গে আকাশ-পাতাল তফাত। বাকিও যেমন বললেন, ‘এখানে যেসব শুটার এসেছে, তারা প্রায় সব গেমসেই অংশ নেয়। আমরা তো সেই সুযোগ পাই না।’ এত কিছু পাওয়ার পরও চীনের দুই শুটারও যে ফাইনালে কোয়ালিফাই করতে পারেননি, সেটিও মনে করিয়ে দেন বাকি। এঁদের একজন অষ্টমজনের সমান স্কোর করেও কোয়ালিফাই করতে পারেননি। অন্যজন আছেন বাকিরও পেছনে (৩১তম)।
বাকির পেছনে থাকা নামগুলোই ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উল্লসিত করছে। নোবেলজয়ী বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ মশালদৌড়ের অংশ হয়ে পরিণত হয়েছেন এই অলিম্পিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনে। সকাল ৯টায় শুরু বাকির শুটিং ঠিক পেছনে বসে পুরোটা দেখলেন। বেরিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, ‘আমি তো বলব বাকি খুবই ভালো করেছে। ও কোন কোন দেশের প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলেছে, এটা দেখুন। খেলাধুলায় আমাদের যে সুযোগ-সুবিধা, আমি তো এটাকে দারুণ ব্যাপার মনে করি। আমি ওর জন্য গর্বিত।’
আবদুল্লাহ হেল বাকির জন্যও সান্ত্বনা হতে পারে এটাই!