অমরত্বের সংজ্ঞাও দিয়ে দিলেন বোল্ট
রিও অলিম্পিক ২০১৬
উৎপল শুভ্র
৬ এপ্রিল ২০২১
অলিম্পিকে তাঁর শেষ দৌড়টাও জিতলেন। টানা তৃতীয় অলিম্পিকে ট্রিপল, ইতিহাসে যে কৃতিত্ব নেই আর কারও। রহস্যটাও বলে দিলেন বোল্টই, ‘এত বছর ধরে কত ত্যাগ স্বীকারই না করে এসেছি! সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম। কত কিছুর মধ্য দিয়েই না যেতে হয়েছে! এটা ঘাম আর অশ্রুর গল্প বন্ধু, ঘাম আর অশ্রুর গল্প।’
প্রথম প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো।
‘ট্রিপল ট্রিপল’ তো হলো। তার সঙ্গে অমরত্বও।
তা এই অমরত্ব মানে কী? উসাইন বোল্ট দিয়ে দিচ্ছেন সংজ্ঞাটা—অপরাজেয়।
আগের দুই অলিম্পিকের মতো ১০০ ও ২০০ মিটারের পর রিলেতেও সেই অপরাজেয় বোল্টকে দেখল রিও অলিম্পিক। চারজনের দৌড়, কিন্তু জ্যামাইকাকে জেতালেন তো বোল্টই। শেষ লেগে সামনে থাকা প্রতিযোগীদের অনায়াসে পেছনে ফেলে। ‘হাতে ব্যাটনটা পাওয়ার পরই জানতাম, আমি জিতে গেছি। কারণ ওই লেগে আমাকে পেছনে ফেলে কেউ ফিনিশিং লাইনে যেতে পারবে না’—শুনতে শুনতে মনে হলো, বোল্ট মানে অপরাজেয় তো বটেই, বোল্ট মানে নিজের ওপর অগাধ বিশ্বাসও।
অলিম্পিক যা শেষবারের মতো দেখে নিল। রিলে শেষ করে আবারও বলে দিলেন, ‘এটাই আমার শেষ অলিম্পিক। স্যরি গাইস্, এটাই শেষ।’
অলিম্পিকের ১২০ বছরের ইতিহাসে দুবার ‘ট্রিপল’ই জেতেনি কেউ, তিনবারের কথা তো কল্পনাও করেনি। অকল্পনীয় সেই কীর্তি গড়ার রহস্য জানতে চান? পরিশ্রম আর ত্যাগ। শুধু প্রতিভাই যে তাঁকে এখানে আনেনি, সেই জানা কথাটাই আবারও সবাইকে জানিয়ে দিলেন বোল্ট, ‘এত বছর ধরে কত ত্যাগ স্বীকারই না করে এসেছি। সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম। কত কিছুর মধ্য দিয়েই না যেতে হয়েছে! এটা ঘাম আর অশ্রুর গল্প বন্ধু, ঘাম আর অশ্রুর গল্প।’
কিন্তু বোল্ট নিজেও কি ভেবেছিলেন, এমন কিছু সম্ভব? না, ভাবেননি। বেইজিংয়ের পর লন্ডন ভেবেছেন, লন্ডনের পর রিও। তবে শুরুতে এমন কিছু তাঁরও কল্পনায় ছিল না, ‘এর কাছাকাছি কিছুও ভাবিনি কখনো। কখনোই ভাবিনি পরপর তিনটা অলিম্পিকে এমন করব। প্রথমটাতে (বেইজিং ২০০৮) ছিল শুধুই আনন্দ। দ্বিতীয়টা (লন্ডন ২০১২) ছিল চ্যালেঞ্জ। এরপর এখানে এসে তৃতীয়বারের মতো এটি করা এককথায় অবিশ্বাস্য। আমি এমন কিছু করে যেতে চেয়েছি, যাতে আর কখনো কেউ তা করতে না পারে। আমি নিজেকে নিয়ে গর্বিত।’
আর কারও এমন কিছু করতে পারা আসলেই খুব কঠিন। যে ‘ঘাম আর অশ্রুর’ কথা বললেন বোল্ট, তা তো আরও অনেকেই ঝরিয়েছেন। আর কেউ তো ‘বোল্ট’ হতে পারেননি। উসাইন বোল্ট এর আগে কখনো আসেননি, ভবিষ্যতেও আসবেন কি না কে জানে! অনন্য অনেক কীর্তির ভিড়ে একটা ক্ষেত্রে অবশ্য বোল্টের পাশেই লিখতে হচ্ছে আরও দুটি নাম—পাভো নুর্মি ও কার্ল লুইস।
বোল্টের মতো অলিম্পিক অ্যাথলেটিকসে ৯টি সোনা জিতেছেন এই দুজনও। নুর্মির কীর্তি সেই ১৯২০ দশকের। ১৯২০ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত ৩টি অলিম্পিকে। ১৫০০ মিটার থেকে শুরু করে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত দৌড়াতেন। মাঝারি ও দূরপাল্লার দৌড়ে একসময় ফিনল্যান্ডের যে আধিপত্য ছিল, সেটির পুরোধা তিনি। প্রথম ‘ফ্লাইং ফিন।’ নুর্মির ৯টি সোনাই দৌড়ে।
কার্ল লুইসের ৫টি দৌড়ে। বাকি ৪টি লং জাম্পে। ৯টি সোনার সঙ্গে একটি রুপাও আছে লুইসের। অলিম্পিকে এই ত্রয়ীর চেয়ে বেশি সোনা জিতেছেন শুধু সাঁতারু মাইকেল ফেল্প্স (২৩)। দুটি ভিন্ন খেলা। ফেল্প্স তাই আলাদাই থাকুন। সর্বকালের সেরা অ্যাথলেটের স্বীকৃতি পাওয়ার লড়াইটা হয়তো ওই তিনজনের মধ্যেই। যেখানে উসাইন বোল্টকে এগিয়ে দিচ্ছে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে জেতা ১১টি সোনা। পাভো নুর্মির সময়ে অলিম্পিক এমন বৈশ্বিক রূপ নেয়নি, প্রতিদ্বন্দ্বিতাটাও এমন তীব্র ছিল না। বোল্ট এত হিসাব-নিকাশ করেছেন কিনা, কে জানে! তবে এটা তো জানেনই, তিনি যা করেছেন, তা করতে পারেনি আর কেউ।
অলিম্পিকে দুবার ‘স্প্রিন্ট ডাবল’ জয়ের রেকর্ডই তো ছিল না আগে। বোল্ট যা লন্ডনেই জিতেছেন। রিওতে ১০০ মিটারের পর ২০০ মিটারও টানা তৃতীয়বার। যে অর্জনের মাহাত্ম্য বুঝতে একটা তথ্যই যথেষ্ট। অলিম্পিকে কেউ দুবার ২০০ মিটারই জিততে পারেননি।
লন্ডনে কিংবদন্তি হতে চেয়েছিলেন। রিওতে পেতে চেয়েছিলেন অমরত্ব। ২০০ মিটার জেতার রাতে সংবাদ সম্মেলনে এসেই ঘোষণা দিয়েছেন, ‘বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছি, আমিই গ্রেটেস্ট।’ কারও মনে যদি কোনো সন্দেহ থেকে থাকে, তাঁদের দিকে ছুড়ে দিলেন প্রশ্ন—‘গ্রেটেস্ট হতে আমাকে আর কী করতে হবে?’
নিজেকে ‘গ্রেটেস্ট’ বলে ঘোষণা করাটা কি কারও কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে? উঁকি দিচ্ছে না মোহাম্মদ আলীর মুখ! আরেকটি জাদুকরি দৌড়ের পর উসাইন বোল্ট যেন মোহাম্মদ আলীই। বব মার্লে তাঁকে নিয়ে গান লিখলে সেটির শিরোনাম কী হতে পারে, প্রশ্নে যিনি নির্বিকার মুখে বলে দেন, ‘দ্য গ্রেটেস্ট অব অল টাইম।’ একটু আগেই দাবি করেছেন, ‘আমি মানুষকে খেলা দেখতে টেনে এনেছি। খেলাটাকে আমি নিয়ে গেছি অন্য পর্যায়ে।’
আলীর মুখে এমন কথা খুব মানাত। উসাইন বোল্টের মুখেও মানিয়ে যাচ্ছে। বোল্ট তো ‘আলী’-ই হতে চেয়েছেন। হতে চেয়েছেন ‘পেলে’। গ্রেটেস্টদের কাতারে দাঁড়ানোর সেই স্বপ্ন পূরণের জন্যই এত কষ্ট, এত ঘাম, হয়তো রক্তও। আলস্য তাঁর খুব প্রিয়। সেই ‘অলস’ বোল্ট ট্রেনিংয়ে কখনো কখনো রক্তবমিও নাকি করেছেন। ‘গ্রেটেস্ট’ বলতে বারবারই বলেছেন আলী আর পেলের কথা। তাঁদের পাশে কি এখন লেখা হয়ে গেল তাঁর নামও? বোল্ট এবার ঢুকে পড়ছেন বিনয়ের আবরণে। সেই বিচারের ভার ছেড়ে দিচ্ছেন সংবাদমাধ্যম আর ফ্যানদের ওপর। সঙ্গে সঙ্গেই আবার কৌতুক করে বলছেন, ‘দেখি, আজ আর আগামীকাল আপনারা কী লেখেন!’
অলিম্পিকে শেষবারের মতো দৌড়ানোর পর ২০০ মিটার জয়ের পর নিজেকে যে ‘গ্রেটেস্ট’ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা মনে করিয়ে দিলেন আবারও। অনেক ঘাম, অনেক অশ্রু ঝরেছে, কিন্তু একটা বিশ্বাস থেকে কখনোই সরেননি, ‘অসম্ভব বলে কিছু নেই।’ নিজের অর্জন সম্পর্কে বললেন, ‘আমি সব সময়ই বলে এসেছি, “অসম্ভব বলে কিছু নেই।” নিজের জন্য কখনোই আমি কোনো সীমা নির্ধারণ করে দিইনি।’
অলিম্পিক মিস করবেন। সবচেয়ে বেশি মিস করবেন দর্শকের সঙ্গে তাঁর ওই বন্ধনকে। বলেই মজা করলেন, ‘তবে যেটি মিস করব না, তা হলো ইন্টারভিউ। পাঁচ শর মতো বোধ হয় দিয়ে ফেলেছি।’ আরও হয়তো দিতে হবে। শেষ অলিম্পিক ঠিক আছে, কিন্তু এখনই তো অবসর নিয়ে ফেলছেন না। আগামী বছর বিশ্ব অ্যাথলেটিকস শেষে ট্র্যাককে বিদায় জানানোর কথা বলে দিয়েছেন আগেই।
এরপর, এরপর কী করবেন? জ্যামাইকাকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন। জ্যামাইকা বলতেই মানুষ এখন ‘বোল্টের দেশ’ বোঝে। জ্যামাইকাতে আরও বেশি পর্যটক টেনে এসেছেন বলে দাবি করলেন নিজেই। যা করার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ। অবসর নেওয়ার পর অন্য কোনো ভূমিকায়ও করে যেতে চান সেটি।
এসব পরের কথা। আপাতত নির্ভার বোল্টের একটাই চাওয়া—লম্বা একটা ছুটি!
(সংযোজন: অন্যের দোষে উসাইন বোল্টকে বিসর্জন দিতে হয়েছে 'ট্রিপল ট্রিপল'-এর গৌরব। ২০০৮ অলিম্পিকে বোল্টের জ্যামাইকান সতীর্থ নেস্টা কার্টার ডোপ টেস্টে ধরা পড়ায় সেই সোনাটি হারাতে হয়েছে বোল্টকে। তাঁর অলিম্পিক সোনার সংখ্যা হয়ে গেছে ৮। অলিম্পিক অ্যাথলেটিকসে সবচেয়ে বেশি ৯টি সোনা জয়ের রেকর্ডে পাভো নুর্মি ও কার্ল লুইসের পাশেও তাই আর নাম নেই বোল্টের)।