পানিতে ব্যালে এবং দুই আনাস্তাসিয়ার গল্প
বেইজিং অলিম্পিক ২০০৮
উৎপল শুভ্র
৬ এপ্রিল ২০২১
সিনক্রোনাইজড সুইমিংই এই বিশ্বের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন খেলা, যেটির অন্য নাম ‘ওয়াটার ব্যালে’। জিমন্যাস্টিকসও তো আছে এতে। পানিতে ডুবে-ভেসে অমন ফুল ফোটাতে জিমন্যাস্টিকস-সাঁতার-নাচ তিনটিতেই অসম্ভব দক্ষতা লাগে। সফল হতে আরও যেসব গুণ থাকতে হয়, সেই তালিকাটা দেখে মনে হলো, ছন্দোবদ্ধ সাঁতারুদেরই তাহলে বিশ্বের সেরা ক্রীড়াবিদ মানতে হয়!
প্রথম প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০০৮। প্রথম আলো।
দুই আনাস্তাসিয়ার গল্প বলি, শুনুন। আনাস্তাসিয়া দেভিদোভা ও আনাস্তাসিয়া এমরাকোভা। নাম দুটি এর আগে শোনেননি? শোনা উচিত ছিল। এঁরা দুজন মিলে যে খেলাটি খেলেন, তাতে গত সাত বছর ধরে অপরাজিত। টানা তিনবারের ইউরোপিয়ান ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, অলিম্পিকে টানা দ্বিতীয় সোনা জিতলেন কাল। এ ইভেন্টে সোনা ধরে রাখার ঘটনা অলিম্পিকে প্রথম।
এত সব ‘ক্লু’ দেওয়ার পরও চিনতে পারেননি! লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। এটাই স্বাভাবিক। কারণ যে খেলায় দুই আনাস্তাসিয়া বিশ্বসেরা, সেটির নাম সিনক্রোনাইজড সুইমিং। বাংলায় কাছাকাছি নাম কী হতে পারে, ছন্দোবদ্ধ সাঁতার?
সিনক্রোনাইজড সুইমিংই বলুন বা ছন্দোবদ্ধ সাঁতার—আপনার মতো বাংলাদেশে সবাই এটি খুব আগ্রহভরে দেখে, কিন্তু প্রতিযোগীদের নাম মনে রাখে না। কাল বিকেলে ওয়াটার কিউবে এই খেলার দ্বৈত প্রতিযোগিতার ফাইনাল দেখতে যাওয়ার আগে আমিই কি আনাস্তাসিয়াদের চিনতাম নাকি!
জিমন্যাস্টিকস কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে, তবে শেষ পর্যন্ত সেটিও পরাজিত। কোনো সন্দেহ নেই, সিনক্রোনাইজড সুইমিংই এই বিশ্বের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন খেলা, যেটির অন্য নাম ‘ওয়াটার ব্যালে’। জিমন্যাস্টিকসও তো আছে এতে। পানিতে ডুবে-ভেসে অমন ফুল ফোটাতে জিমন্যাস্টিকস-সাঁতার-নাচ তিনটিতেই অসম্ভব দক্ষতা লাগে। সফল হতে আরও যেসব গুণ থাকতে হয়, সেই তালিকাটা দেখে মনে হলো, ছন্দোবদ্ধ সাঁতারুদেরই তাহলে বিশ্বের সেরা ক্রীড়াবিদ মানতে হয়! শক্তি, সহ্যক্ষমতা, নমনীয়তা, ক্ষিপ্রতা, সময়জ্ঞান... দীর্ঘ তালিকার সঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে যোগ করুন ‘দম’কে। একটু পরপরই যে চলে যেতে হয় পানির নিচে। আর কোনো খেলায় বোধ হয় এই দম বন্ধ করে রাখার ব্যাপারটি নেই।
আগেই বলেছি, আনাস্তাসিয়ারা দ্বৈত ছন্দোবদ্ধ সাঁতারে ২০০১ সাল থেকে অপরাজিত। বেইজিংয়েও সোনা জেতার ব্যাপারটি তাই একরকম পূর্বনির্ধারিতই ছিল। নিশ্চিত জাতীয় সংগীত বাজছে, সেই অনির্বচনীয় অনুভূতির স্বাদ পেতে রাশিয়া দলের অন্য অনেক অ্যাথলেট তাই দল বেঁধে ওয়াটার কিউবে। রুশ পতাকায় একরকম ছেয়ে থাকল গ্যালারি। অন্য দেশের একটাই পতাকা দেখলাম, সেটি স্পেনের। দুই স্প্যানিয়ার্ড তরুণী আন্দ্রিয়া ফুয়েন্তেস ও গেমা মেংগুয়েল যথারীতি আনাস্তাসিয়াদের সঙ্গে পারলেন না। তবে রুপা পেয়েই বিজয়মঞ্চে যেভাবে কাঁদলেন, মনে হলো আনাস্তাসিয়াদের রাজত্বে রুপাটাকেই সোনা বলে মানছেন তাঁরা!
এবার অবশ্য একটু দুঃসাহসী স্বপ্ন দেখেছিলেন ফুয়েন্তেস-মেংগুয়েল। এ বছরই যে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন দুজন। আসল কারণ অবশ্য আনাস্তাসিয়ারা তাতে ছিলেন না। প্রতিযোগিতায় রওনা হওয়ার তিন-চার দিন আগে থেকে দুজনেরই খুব জ্বর, সঙ্গে সর্দিকাশি। শেষ পর্যন্ত আর যাওয়াই হয়নি। বেইজিংয়ে এসেই অবশ্য সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘আমরা দুজন থাকলে ওরা আবার কবে সোনা জিতেছে?’
জ্বরজারি-সর্দিকাশি এসব যে আনাস্তাসিয়াদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী নয়, সেটিই তো বিস্ময়ের কথা। প্রতিদিন আট ঘণ্টা পুলে কাটে তাঁদের, দুই ঘণ্টা জিমে। দেভিদোভা তাও ১২ বছর বয়সে শুরু করেছেন, এমরাকোভার তো সেই পাঁচ বছর বয়স থেকেই ‘পানিতে বড় হয়ে ওঠা’। কাল সোনার পদক গলায় ঝুলিয়ে হাসিতে ঝলমল দেভিদোভা বললেন, ‘আমরা আজ যে রুটিনটা করেছি, সেটা খুব কঠিন। একবার ত্রিশ সেকেন্ড দম বন্ধ করে থাকতে হয়। এর পর এক-দুবার নিঃশ্বাস নিয়েই আবার ১৮ সেকেন্ড।’
ওহো, শুধু আনাস্তাসিয়াদের কথা বলে যাচ্ছি, খেলাটার নিয়মকানুনটা বোধ হয় আপনার জানা নেই। বাংলাদেশে এই খেলা হলে না জানবেন! সংক্ষেপে কি একটু জানিয়ে দেব! সিনক্রোনাইজড সুইমিংয়ে কিছু জাতীয় বা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ছেলেরাও অংশ নেয়, তবে অলিম্পিক ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে শুধুই মেয়েরা। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে একক প্রতিযোগিতাও আছে, তবে অলিম্পিকে শুধু দ্বৈত ও দলগত। দলগত বিভাগের একটিই পর্ব, তবে দ্বৈতে দুটি। প্রথম পর্বে টেকনিক্যাল ও ফ্রি রুটিন। দ্বিতীয় পর্বে শুধু ফ্রি রুটিন। টেকনিক্যাল রুটিনে সবাইকেই নির্দিষ্ট কিছু বিষয় করে দেখাতে হয়। ফ্রি রুটিনে যার যা ইচ্ছে। জিমন্যাস্টিকসের ফ্লোর এক্সারসাইজের মতো এখানেও নিজেদের পছন্দমতো মিউজিকের সঙ্গে। সুইমিং পুলের নিচে স্পিকার বসানো আছে, যাতে পানির নিচে গিয়েও মিউজিক শুনতে পান প্রতিযোগীরা। দ্বৈতের প্রথম পর্বে টেকনিক্যাল ও ফ্রি রুটিন মিলিয়ে সেরা ১২টি দল ফাইনালে ওঠে। ফাইনালের ফ্রি রুটিনে পাওয়া পয়েন্টের অর্ধেক আর প্রথম পর্বে টেকনিক্যাল রুটিনের অর্ধেক পয়েন্ট যোগ করে নির্ধারিত হয় বিজয়ী। পয়েন্ট দেওয়ার কাজটি করেন পাঁচজন করে বিচারকের দুটি প্যানেল। একটি টেকনিক্যাল ব্যাপার-স্যাপার দেখে, অন্যটি সৌন্দর্য। ফাইনালে দলগত বিভাগে চার মিনিট সময়, দ্বৈতে সাড়ে তিন মিনিট।
আনাস্তাসিয়ারা অবশ্য সময় নিলেন ৩ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড। এই সময়ের মধ্যে যা যা করলেন, তাতে বিস্ময়াভূত হওয়া ছাড়া উপায় থাকল না। অন্য ১১ দেশের জুটিগুলোকে দেখেও একই অনুভূতি জেগেছে। তবে আনাস্তাসিয়ারা যে অনেক এগিয়ে, অনভ্যস্ত চোখেরও সেটি বুঝতে কোনো সমস্যা হলো না। টেকনিক্যাল বিচারে পাঁচ বিচারকের কাছ থেকেই পুরো ১০ পয়েন্ট পেলেন, সৌন্দর্যের বিচারেও দশমিক ১ কম পেলেন মাত্র দুজনের কাছ থেকে।
ভেসে বেড়ানো-হাতে মুদ্রা ফুটানো—এসব সামান্য সময়ের জন্যই, পায়ের খেলাই বেশি। যা দেখতে দেখতে শুধু ভাবছিলাম, পানির নিচে উল্টো হয়ে থেকে দুজনের একই সঙ্গে একই রকম ওই পায়ের খেলা দেখাতে পারায় কত ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাধনা লুকিয়ে! কখনো কখনো তো দুজনের চার পা এমনভাবে জড়িয়ে গেল যে, কোনটা কার পা তা বোঝাই কঠিন! এমন করতে তো দুজনের মধ্যে টেলিপ্যাথি জাতীয় কিছুও থাকতে হয়। সেটি যাদের মধ্যে জন্মগতভাবেই আছে, সেই চীনা জুটি অল্পের জন্য চতুর্থ হয়ে পদকবঞ্চিত হলো। তার পরও এই ইভেন্টে এটাই চীনের সেরা সাফল্য। এবার পদক জয়ের জন্য জাপান থেকে কোচ আনা হয়েছিল। এই খেলায় জাপানের নাম আছে। ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে অলিম্পিকে জায়গা পাওয়া সিনক্রোনাইজড সুইমিংয়ে প্রতিবারই কোনো না কোনো পদক পেয়েছে তারা, যদিও সোনা জেতা হয়নি একবারও। সোনাটা শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই বাঁধা ছিল। ২০০০ সিডনি থেকে সেটিকে নিজেদের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছে রাশিয়া। সিডনির পর এথেন্সেও দলগত ও দ্বৈতের দুটি সোনাই তাদের। এবারও তা-ই হওয়ার কথা, আগামী পরশুর দলগত ফাইনালটাকে দেখলাম কেউই আনুষ্ঠানিকতার বেশি কিছু ভাবছেন না।
চীনা জুটির মধ্যে টেলিপ্যাথির কথা বলছিলাম। ওদের কোচ মাসায়ো ইমুরা ব্রোঞ্জ হারানোর দুঃখের মধ্যেও হাসতে হাসতে বললেন, “ওরা খুব ভালো করেছে। ভবিষ্যতে আরও করবে। ওদের মধ্যে তো খুব মিল। একজন ‘পেট ব্যথা করছে’ বললে অন্যজন সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘আমারও’!”
হতেই পারে। জায়াং তিংতিং ও জায়াং ওয়েনওয়েন যে যমজ বোন!