ফেলপসে উদ্ধার খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র

বেইজিং অলিম্পিক ২০০৮

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

ফেলপসে উদ্ধার খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র

ছবি: গেটি ইমেজেস

এক অলিম্পিকে মার্ক স্পিৎজের জেতা ৭টি সোনাকে একটা সময় পর্যন্ত অস্পর্শনীয়ই জেনে এসেছিল বিশ্ব। মাইকেল ফেলপসের আবির্ভাবে সেই ভুলটা ভাঙতে শুরু করেছিল ২০০৪ অলিম্পিকে, এথেন্সে না ভাঙতে পারলেও ফেলপস স্পিৎজের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলেন বেইজিংয়ে। এক অলিম্পিকে ৮ সোনা জয়ের পর ফেলপসকে নিয়ে মাতামাতির কিছু নমুনা পাবেন এই লেখায়।

প্রথম প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০০৮। প্রথম আলো।

শেয়ারবাজারে ধস, ডলারের মূল্যপতন, ইরাকনীতির তীব্র সমালোচনা, জাতশত্রু চীনের কাছে অলিম্পিক আধিপত্য খোয়ানোর আশঙ্কা। মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভ্রূ কুঁচকে যেতে এর চেয়ে আর বেশি কিছু কি দরকার ছিল? এমন অবস্থায় একটা অন্তত সুখবর খোঁজ করছিলেন জর্জ বুশ। পেয়েও গেলেন খবরটা। সেই সুসংবাদ এনে দেওয়া ‘ত্রাতা’কে একটা ফোন করলেন, ‘আপনি যেহেতু আটটি সোনা জয়ের প্রত্যাশার চাপ সামলাতে পেরেছেন, সবকিছুই সামলাতে পারবেন।’ ‘সবকিছু’ বলে কোন দিকে ইঙ্গিত করলেন বুশ?

কোনো ইঙ্গিতেই লাভ নেই। এখন আর কোনো কিছু সামলানোর কথা মাথায় আনছেন না মাইকেল ফেলপস। এখন তিনি বাড়ি ফিরে নিজের বিছানায় একটু ঘুমোতে পারলে বাঁচেন! কিন্তু ফেলপস না চাইলেই তো আর চলবে না। যে কীর্তি তিনি করে ফেলেছেন, তাতে তাঁকে ছাড়ে কে! সকাল-বিকেল তাঁকে এখন জর্জ বুশ, মাইকেল জর্ডানদের ফোন সামলাতে হচ্ছে। সারা বিশ্বের এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত তারকা হয়ে উঠেছেন আটে আট সোনা জেতা ফেলপস। হয়ে উঠেছেন মাইকেল জর্ডান, রজার ফেদেরার, টাইগার উডসদের চেয়েও বড় তারকা! কিছুটা হ্যাপা তো তাঁকে সামলাতে হবেই।

‘হ্যাপা’ বলাটা ঠিক হলো কি না কে জানে! কারণ এই চোটেই ফেলপসের ওপর হামলে পড়ছে বিশ্বখ্যাত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো। বিজ্ঞাপনে চাই এই জলদানবকে। আগে থেকেই ‘ভিসা’ আর ‘স্পিডো’র সঙ্গে কয়েক মিলিয়নের চুক্তি ছিল তাঁর। বছরে মোটামুটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলারের মতো আয় ছিল তাঁর বিজ্ঞাপন বাবদ। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ক্রীড়া আইনজীবী সংস্থার এক কর্মকর্তা অনুমান করছেন, সংখ্যা এবার বেড়ে এক লাফে ‘তিন থেকে পাঁচ কোটি’ মার্কিন ডলারে পৌঁছাতে পারে।

কী পাবেন, সেটা পরের কথা। আপাতত নগদেই পাচ্ছেন তিনি সারা বিশ্বের বন্দনা। যাঁর রেকর্ড ভেঙে কীর্তি, সেই মার্ক স্পিৎজ তো আগের দিনই যা বলার বলে দিয়েছেন। কাল লাখ কথার এক কথা বললেন অস্ট্রেলীয় সাঁতারু লিব্বি ট্রিকেট। ফেলপস কিংবদন্তি, অতিমানব—এসব বিশেষণের কাছ দিয়েও গেলেন না তিনি। মানুষ হিসেবেই দেখছেন ফেলপস। তবে এমন এক মানুষ, যিনি অসম্ভবকে সম্ভব করার স্বপ্নটা জিইয়ে রাখেন, ‘সে নিশ্চিতভাবে কিছু সীমানা ভেঙে ফেলেছে। সবচেয়ে বড় কথা, সে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে। এবং আমরা নিজেদের ওপর যেসব সীমাবদ্ধতা টেনে দিই, সেগুলোকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।’

ফেলপস কি সর্বকালের সেরা? এ নিয়ে বিতর্ক এখনই শেষ হয়ে যাবে না। তবে নাতালি কগলিনের কথা বিশ্বাস করলে মানতে হয়, যত দিন গড়াবে ততই ফেলপসের এই কীর্তি আরও মহান হবে, ‘আমার ধারণা, বছরের পর বছর গড়াবে এবং সবাই একটু একটু করে উপলব্ধি করতে পারবে, সে কতটা বিস্ময়কর ছিল এবং ভিন্ন ছিল কতটা।’

অষ্টম স্বর্ণ এসেছিল ৪×১০০ মিটার মিডলে রিলেতে। ছবি: গেটি ইমেজেস

কতটা ভিন্ন, কতটা কীর্তিমান—এসব বিচার বিশ্ব করবে। যুক্তরাষ্ট্র আপাতত এই ফেলপসে উদ্ধার খুঁজছে। অনেক বিড়ম্বনা থেকে উদ্ধার। অনেক কলঙ্কের আওয়াজের মধ্যে একটা গর্বের শব্দ। এ শব্দটাই শুনতে পেয়েছেন মার্কিন অলিম্পিক কমিটির চেয়ারম্যান পিটার উয়েবেরথ, ‘এই যুগে সম্ভবত আর কেউ আমাদের এমন গর্বিত করতে পারেনি।’

সংখ্যাতত্ত্বে ফেলপস

৮ নিয়ে আহ্লাদে আটখানা শুধু চীনারাই হচ্ছে না। মাইকেল ফেলপসও হচ্ছেন। বেইজিংজয়ী এই অ্যাথলেট বলছেন, ৮ তাঁর ‘লাকি’ নম্বর। বলে-কয়ে ৮টি সোনা জিতে নেওয়া লোকের কি আর সেটা বলতে হয়! তারপরও ফেলপস আটের কথা বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন ২০০৮ সালের ৮ নম্বর মাসে ৮ তারিখ ৮টা ৮ মিনিটে বেইজিং অলিম্পিক শুরু হওয়ার দিকে। ভদ্রলোক তা হলে সত্যিই সংখ্যাতত্ত্বে বিশ্বাসী!

তাহলে ফেলপসের আরও কিছু সংখ্যাতত্ত্বের খোঁজ নেওয়া যাক। যেগুলো অবশ্য ‘৮’ নয়—

★ বেইজিংয়ে সব মিলে ৩৩০০ মিটার সাঁতরেছেন তিনি ৩০ মিনিট ৫৮.৭৮ সেকেন্ড সময়ে। গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ৩.৯৯ মাইল বা ঘণ্টায় ৩.৪৭ নটিক্যাল মাইল গতিতে সাঁতরেছেন তিনি (ঘটনা যেহেতু জলে, নটিক্যাল মাইলের হিসাবই ভালো)!

★ বাছাইপর্বে ফেলপস ঘণ্টায় ৩.৯২ মাইল গতিতে এবং ফাইনালে ৪.০৭ মাইল গতিতে সাঁতরেছেন।

★ সব মিলে আটটি ফাইনালে ৬৫০ মিটার ফ্রি-স্টাইল সাঁতরেছেন ১৩ মিনিট ৪৪.৬১ সেকেন্ড সময় নিয়ে। ফ্রি-স্টাইলে তাঁর গতি ছিল ঘণ্টায় ৪.৩০ মাইল।

★ সব মিলে ১২ মিনিট সময় ব্যয় করেছেন বিজয়মঞ্চে দাঁড়িয়ে মার্কিন জাতীয় সংগীত শুনতে।

★ যুক্তরাষ্ট্র পুরুষ সাঁতার দলের ২২ সদস্যের ১৭ জনই ফেলপসের মাধ্যমে কমপক্ষে একটি সোনার স্বাদ পেয়েছেন (নিয়ম অনুযায়ী বাছাইপর্বে সাঁতরানো রিলে দলের সাঁতারুরাও একটি করে পদক পান দল ফাইনালে জিতলে। তাতে বাছাইপর্বের ওই খেলোয়াড় ফাইনালে থাকুন আর না-ই থাকুন)।

★ ওপরের আইন অনুযায়ীই ফেলপসের ছোঁয়া আছে যুক্তরাষ্ট্র সাঁতার দলের বাক্সে জমা হওয়া ২৭টি পদকে।

★ ব্যক্তিগত পাঁচটি ইভেন্টে সব মিলে ১৪ বার সাঁতরাতে নামতে হয়েছে ফেলপসকে। যাতে ৯৮ জন প্রতিযোগীর সঙ্গে লড়েছেন তিনি।

★ রোববার পর্যন্ত ফেলপসের চেয়ে বেশি সোনা দেশ হিসেবেও জিতেছে মাত্র ৪টি দেশ। তাঁর সমান সোনার মালিক ছিল ৩টি দেশ। অলিম্পিকে অংশ নেওয়া বাকি সব দেশই এদিন পর্যন্তও তাঁর নিচে!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×