পিং পংয়ের দেশে
বেইজিং অলিম্পিক
উৎপল শুভ্র
২১ জুলাই ২০২১
বেশির ভাগ খেলার মতো টেবিল টেনিসেরও জন্মদাতা ইংল্যান্ড। তবে খেলাটার ধারক এবং বাহক, দুটোই চীন। ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিক কাভার করতে গিয়ে উৎপল শুভ্র তো শুনেছিলেন অবাক করে দেওয়ার মতো এক তথ্য, চীনে প্রতিযোগিতামূলক টেবিল টেনিস খেলোয়াড়ের সংখ্যাই এক কোটি!
প্রথম প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০০৮। প্রথম আলো
‘চুংগুয়ো জাইও’! ‘চুংগুয়ো জাইও’! একটু পরপরই স্লোগান উঠছিল পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেসিয়ামের গ্যালারি থেকে। অর্থ—‘চীন, এগিয়ে যাও!’
চীন এগিয়েও গেল। সরাসরি ৩-০ ম্যাচে জয়। ১ ঘণ্টা ২৩ মিনিটেই ফাইনাল শেষ করে পুরুষদের দলগত সোনা। স্কোরলাইন আর সময়ের ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব ছিল না। তবে ফলাফল এমনই হবে, যেন জানত সবাই। খেলাটার নাম যে টেবিল টেনিস।
চীনারা বলে ‘পিং পং’ এবং পিং পং এখানে শুধুই একটা খেলা নয়, চীনা সংস্কৃতির অংশ। বেশির ভাগ খেলার মতো টেবিল টেনিসেরও জন্মদাতা ইংল্যান্ড। নামের সঙ্গে টেনিস আছে, কারণ জন্মটা টেনিসেরই অপভ্রংশ হিসেবেই। যত দূর জানা যায়, ছাদের নিচে ‘টেনিস’ খেলার জন্য টেবিলের আশ্রয় নেওয়া থেকেই। ইংল্যান্ড জন্মদাতা হতে পারে, তবে টেবিল টেনিস বিশ্বে এখন তাদের নামগন্ধও নেই। অনেক বছর ধরেই এই খেলার ধারক-বাহক ও পৃষ্ঠপোষক সবই চীন। এই দেশে প্রতিযোগিতামূলক টেবিল টেনিস খেলোয়াড়ের সংখ্যাই নাকি এক কোটি!
দিন দুয়েক আগে চীনা টেলিভিশনে অলিম্পিক-বিষয়ক বিশেষ অনুষ্ঠানে দুই উপস্থাপক মিলে কৈশোরের স্মৃতিচারণা করছিলেন। উপস্থাপকদের একজন ছেলে, অন্যজন মেয়ে। তবে কৈশোরের উজ্জ্বলতম স্মৃতি দুজনেরই এক—উঁচু কোনো জায়গা পেলেই মাঝখানে ইট-টিট দিয়ে নেট বানিয়ে পিং পং খেলা। সব চীনাদেরই নাকি এটি অভিন্ন কৈশোর-স্মৃতি। এই দেশ যে টেবিল টেনিস বিশ্ব শাসন করবে, তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে।
শাসন করার ব্যাপারটা বোঝাতে পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। ১৯৮৮ সিউলে টেবিল টেনিসের অলিম্পিক অভিষেক। বেইজিংয়ের আগে পাঁচটি অলিম্পিকে টেবিল টেনিসে ২০টি সোনার ১৬টিই জিতেছে চীন। ১৬টি সোনা জয়ের আনন্দের চেয়েও বাকি ৪টি সোনা হারানোর দুঃখটাই বেশি পোড়ায় চীনকে!
গত ৫টি অলিম্পিকে খেলা হয়েছে পুরুষ ও মহিলা একক ও দ্বৈতে। এবার দ্বৈত বাদ দিয়ে যোগ হয়েছে পুরুষ ও মহিলা দলগত ইভেন্ট। পুরুষ দলগতের মতো মহিলা দলগতের সোনাও চীনের। গত পরশু রাতে সেই সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে সেই ফাইনালটিও একই রকম একতরফা। চীন ৩: সিঙ্গাপুর ০।
ফাইনালে হারলেও চীনই জিতত! হেঁয়ালি মনে হচ্ছে? ঠিক আছে, এভাবে বলা যাক—চীনারাই জিতত! সিঙ্গাপুর দলের সব খেলোয়াড়ই যে চীনা! হংকংয়েরও তা-ই। মেয়েদের বিভাগে বেশির ভাগ খেলাই আসলে চীন বনাম চীন। ৪৮ জন খেলোয়াড়ের ৩০ জনই যে চীনা বংশোদ্ভূত! চীনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকতে না পেরে অলিম্পিক ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ স্বপ্ন পূরণের জন্য তাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন অন্য দেশের পতাকাতলে।
কাল পুরুষ দলগতে সোনা জয়ের পর কোচ লিউ গুয়োলিয়াং এর তাৎপর্য হিসেবে বললেন, ‘দলগত সোনা জেতাটা অন্য রকম। এটা পুরো জাতির শক্তি বোঝাচ্ছে।’ সেটি অবশ্য আরও নানাভাবেই বোঝা যায়। র্যাঙ্কিংয়ের দিকে তাকালে সবচেয়ে বেশি। ছেলেদের বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে চারজনই চীনের। মেয়েদেরটায় আরও বেশি—৫ জন! জন্মসূত্রে জাতীয়তা বিবেচনায় নিলে অবশ্য প্রথম দশজনই চীনের। বাকি ৫ জনের নামের পাশে সিঙ্গাপুর লেখা, দুজনের হংকং। তাঁরাও তো আসলে চীনাই!
চীনা ছেলেদের দলের কোচ লিউ গুয়োলিয়াং ১৯৯৬ অলিম্পিকে একক ও দ্বৈতে দুটি সোনা জিতেছেন। খেলোয়াড় হিসেবে সাফল্যের পর কোচ হিসেবেও এমন সাফল্য, সেই সাফল্যের দিনটি আবার মিলে গেছে তাঁর বিবাহবার্ষিকীর সঙ্গে। এক চীনা সাংবাদিক তা মনে করিয়ে দেওয়ায় আনন্দে ঝলমল করতে করতে বললেন, ‘আমার তো বটেই, দু বছর আগে আমার গুরু কাই ঝেং হুয়াও ১৮ আগস্ট বিয়ে করেছে। তখন আমরা কেউই জানতাম না, এই দিনটি অলিম্পিকে প্রথম পুরুষ দলগত ফাইনালের সঙ্গে মিলে যাবে। এই দিনটা আমার জীবনে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল।’
আনন্দের প্রকাশটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে ভেবেই কি না, সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, ‘আমাদের কাজ এখনো শেষ হয়নি। এখনো দুটি সোনা জিততে বাকি।’ সেই দুটি সোনা মহিলা দলগত ও মহিলা এককের, ফাইনাল ২২ ও ২৩ আগস্ট, যাতে টেবিলের দুপ্রান্তেই চীনাদের উপস্থিতির সম্ভাবনা প্রবল।
কাল দলগত ফাইনালের প্রথম ম্যাচটা যিনি খেললেন, সেই ওয়াং হাওয়ের কথা শুনে মনে হলো তাঁর আর তর সইছে না। র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের এক নম্বর, কিন্তু এই অলিম্পিক শুরু করেছেন বিষম চাপ নিয়ে। গেমস শুরুর আগে কোচ মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘মা লিন ও ওয়াং লিকিন (চীন দলের অন্য দুজন) দুজনেরই অলিম্পিক সোনা আছে, শুধু তোমার নেই। তুমি শূন্য থেকে শুরু করছ, নিজেকে প্রমাণ করো।’
আসল প্রমাণটা এককেই দিতে চান। কারণ এথেন্সে গত অলিম্পিকের ফাইনালে কোরিয়ার রিও সিউং-মিনের কাছে পরাজয়ের দুঃস্বপ্ন এখনো তাঁকে তাড়া করে বেড়ায়। দলগতের সেমিফাইনালে সেই রিওকে উড়িয়ে দিয়েছেন, তবে আসল প্রতিশোধ তো নেওয়া হয়নি এখনো।
টেবিল টেনিসের ওপর বেশি অধিকারবোধ বলেই চীনারা নাকি এতে ব্যর্থতা ক্ষমা করে না। তবে অন্য দেশের কেউ যদি বেশি ভালো খেলেই ফেলে, কী আর করা, তাঁকেই নায়ক করে নেওয়ার ঘটনাও আছে। যেমন জান-ওভে ওয়াল্ডনার। টেবিল টেনিসে এশিয়ান আধিপত্য একমাত্র তিনিই ভেঙেছিলেন। ১৯৯২ বার্সেলোনা গেমসে এককে সোনাজয়ী এই সুইডিশ চীনে এমনই জনপ্রিয় যে, সেটিকে কাজে লাগাতে ওয়াল্ডনার বেইজিংয়ে একটি রেস্টুরেন্টও খুলে ফেলেছেন। সেটিতে অবশ্য সুইডিশ খাবারই বিক্রি হয়।