এই সব মৎস্যমানবেরা

২০০৪ অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

এই সব মৎস্যমানবেরা

পোপভ ৬ ফুট ৭, গ্যারি হল ৬ ফুট ৬, ইয়ান থর্প ৬ ফুট ৫। ২০০৪ অলিম্পিকে সাঁতারের মহারথীদের মধ্যে মাইকেল ফেলপস আর পিটার ফন ডেন হুগেনব্যান্ডই খাটো ছিলেন। কারণ তাঁরা ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি! নির্মেদ, নির্লোম ছিপছিপে শরীরগুলো দেখলে মনে হতো যেন দোকানের শোকেসে সাজিয়ে রাখা মেনিকেন। মৎস্যমানবই তো!

প্রথম প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০০৪। প্রথম আলো

অ্যাথলেটিকসে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট যিনি জিতবেন, তিনিই এই গ্রহের দ্রুততম মানব। কিন্তু সাঁতারের স্প্রিন্ট জিতলেন যিনি, তাঁকে কী বলা হবে? দ্রুততম মৎস্যমানব?

এক সাঁতার-লেখক এমনই প্রস্তাব করেছিলেন। ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে জয়ীকে বিশ্বের দ্রুততম মানব সাঁতারু বলা হোক, আর ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইলে জয়ীকে বলা হোক ‘দ্রুততম মৎস্যমানব’। 

মৎস্যমানবই তো। তা না হলে জলের সঙ্গে এমন মিতালি হয় কী করে! গত এক যুগ যাকে ‘দ্রুততম মৎস্যমানব’ বলে মেনে আসা হয়েছে, সেই আলেকজান্ডার পোপভ বিশ্বের সব সাঁতারুর উদ্দেশে কী বলছেন শুনুন, ‘তোমাকে জলের অংশ হয়ে যেতে হবে। তোমার ত্বক দিয়ে, পুরো অস্তিত্ব দিয়ে অনুভব করতে হবে এটিকে। জল তোমার বন্ধু... জলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে নেম না, জলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাও, এটিই তখন তোমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।’

পর পর দুটি অলিম্পিকে (বার্সেলোনা ও আটলান্টা) ৫০ ও ১০০ মিটারের ‘স্প্রিন্ট ডাবল’ জয়ী একমাত্র সাঁতারু পোপভ এথেন্সের সুইমিংপুলে নেমে দেখলেন, তিনি জলকে যতই বন্ধু ভাবুন, সেটি আর তাঁর দিকে আগের মতো বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না। ১০০ মিটারের সেমিফাইনালে বাদ। যে ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইলে অলিম্পিক ও বিশ্বরেকর্ড দুটোই এখনো তাঁর, বাদ সেটির প্রথম হিটেই। মিক্সড জোনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যেন যুগের অবসানই ঘোষণা করলেন পোপভ, ‘বার্সেলোনায় (গত বছর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে) ডাবল জেতার পর অলিম্পিকেও আবার তা করতে ভাবব বলে ভেবেছিলাম। শেষ অলিম্পিকটায় মনে রাখার মতো কিছু থাকল না।’

উৎপল শুভ্রর ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি করে গ্যারি হলই জিতেছিলেন ৫০ মিটারের স্বর্ণ। ছবি: গেটি ইমেজেস

পোপভের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জুয়েল আহমেদের কথা মনে পড়ছিল। বাংলাদেশের সাঁতারু একটু আগেই বলে গেছেন, ‘যার সঙ্গেই কথা বলি, ওপর দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হয়।’ ৬ ফুট ৭ ইঞ্চির পোপভের সঙ্গে কথা বলার সময় তা করতে হয় বেশির ভাগ মানুষকেই। 

পোপভ ৬ ফুট ৭, গ্যারি হল ৬ ফুট ৬, ইয়ান থর্প ৬ ফুট ৫। এই অলিম্পিকে সাঁতারের মহারথীদের মধ্যে মাইকেল ফেলপস আর পিটার ফন ডেন হুগেনব্যান্ড খাটো। কারণ তাঁরা ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি! নির্মেদ, নির্লোম ছিপছিপে শরীরগুলো দেখে মনে হয় যেন দোকানের শোকেসে সাজিয়ে রাখা মেনিকেন। মৎস্যমানবই তো! 

ইয়ান থর্পের পা দুটো দেখছিলাম। সাইজ ১৭, পা তো নয়, যেন নৌকা! সিডনি অলিম্পিকের সময় এক সাঁতারু বলেছিলেন, ‘থর্পের পেছনে পড়ে যাওয়া (তা তো প্রায় সবাইকেই পড়তে হয়) মানে আপনার মনে হবে আপনি ওয়াশিং মেশিনে হাবুডুবু খাচ্ছেন।’ মাইকেল ফেলপস দু'পাশে হাত মেললে (সাঁতারের ভাষায় ‘উইংস’) সেটির দৈর্ঘ্য হয় সাড়ে ৭৬ ইঞ্চি। ভুল পড়েননি, তাঁর উচ্চতার চেয়েও আধা ইঞ্চি বেশি!

ইয়ান থর্প আর মাইকেল ফেলপসকে নিয়ে উন্মাদনার পাশে বাকি সবাই এবার ম্লান। তবে ‘মৎস্যমানব’ সংক্রান্ত আলোচনায় তাঁরা দুজন আসছেন না। স্প্রিন্ট সাঁতার তাঁদের বিষয় নয়। এ কারণেই রুপা পেলেও যাঁর মন খারাপ হয়, সেই থর্প ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে ব্রোঞ্জ জিতেই এমন খুশি। থর্প ‘মৎস্যমানব’ হতে চাননি, মাঝারি পাল্লার ফ্রি স্টাইলে সর্বকালের সেরা সাঁতারুর স্বীকৃতিটা তিনি চান। অনেকেই বলবেন, তা তো পাওয়া হয়েই গেছে। 

স্প্রিন্ট সাঁতারে এই স্বীকৃতির দাবিদার আলেকজান্ডার পোপভ। আর সেই পোপভ সাঁতার-জীবনে তার সবচেয়ে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বলছেন গ্যারি হল ও পিটার ফন ডেন হুগেনব্যান্ডের নাম। আরও ভেঙে বলতে বললে হয়তো বলতেন, ১০০ মিটারে হুগেনব্যান্ড, ৫০ মিটারে হল। 

পোপভ-হলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইতিহাস অনেক পুরনো। সেই ১৯৯৪ সালে রোমে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ৫০ ও ১০০ মিটার দুটোতেই পোপভের পেছনে থেকে রুপা জিতেছিলেন হল, সিডনি অলিম্পিকের আগ পর্যন্ত এই রুপাই জিতে গেছেন। সিডনিতেই পোপভকে হারিয়ে প্রথম ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইলে সোনা জেতেন হল, হুগেনব্যান্ড পান রুপা, পোপভ ষষ্ঠ! ১০০ মিটারে প্রথম তিনটি নাম ছিল হুগেনব্যান্ড-পোপভ-হল। সিডনিতে জেতা ১০০ মিটারের সেই সোনা এথেন্সেও ধরে রেখেছেন হুগেনব্যান্ড। পোপভ তো সেমিফাইনালেই বাদ, হল শুধু ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইল আর ৪ গুনিতক ১০০ মিটার রিলেতেই অংশ নিচ্ছেন এবার। 

পোপভ জল ভয় পেতেন বলে আট বছর বয়সে তাঁকে সাঁতার স্কুলে ভর্তি করে দেন তাঁর বাবা। হুগেনব্যান্ড ফুটবল, হকি, জুডো, ওয়াটারপোলো সব খেলাই খেলতেন। ওয়াটারপোলো খেলার সময়ই বুঝতে পারেন স্প্রিন্ট সাঁতারে তাঁর সম্ভাবনার কথা। গ্যারি হলের অবশ্য সাঁতারু না হয়ে কোনো উপায় ছিল না। গ্যারি হল জুনিয়র বলা হয় তাঁকে, কারণ বাবার নামও গ্যারি হল এবং সিনিয়র হলও ছিলেন সাঁতারু। ১৯৬৮, ১৯৭২ ও ১৯৭৬ অলিম্পিকে অংশ নিয়ে সোনা-রুপা-ব্রোঞ্জ সবই জিতেছেন, ১১টি বিশ্বরেকর্ড গড়ার কৃতিত্বও আছে। এথেন্স অলিম্পিকে এসেই একটি রেকর্ড গড়ে ফেলেছেন হল, বাবা-ছেলে দুজনেরই তিনটি করে অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার ঘটনা সাঁতারে এই প্রথম।

এই লেখা যখন লিখছি, দু'ঘণ্টা পর ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইল ফাইনাল। সেই ফাইনালে পোপভ-হুগেনব্যান্ড দুজনের কেউই নেই, ‘বিশ্বের দ্রুততম মৎস্যমানব’ তো হয়েই গেছেন গ্যারি হল!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×