মস্কোতে ছিলেন, এথেন্সেও আছেন

২০০৪ অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

মস্কোতে ছিলেন, এথেন্সেও আছেন

৯টি অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন অস্ট্রিয়ান সেইলর হুবার্ট রাউদাসল। ৮টি অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন ৪ জন, ৭টি অলিম্পিকে ছিলেন আরও ৫ জন। তবে তাঁদের সবাই সেইলিং, ইকুয়েস্ট্রিয়ান বা শ্যুটিংয়ে, যেগুলোর কোনোটিতেই বয়স এমন শত্রু হয়ে দাড়ায় না। অ্যাথলেটিকসে ৭টি অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার প্রথম উদাহরণ মারলিন ওটিই, সম্ভবত শেষও।

প্রথম প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০০৪। প্রথম আলো

মস্কো, লস এঞ্জেলেস, সিউল, বার্সেলোনা, আটলান্টা, সিডনি, এথেন্স...অলিম্পিকের স্বাগতিক শহরগুলোর নাম লিখে যাচ্ছি কেন? কুইজের একটা প্রশ্ন সাজাতে। সর্বশেষ এই ৭টি অলিম্পিকের মধ্যে একটি মিল বলুন তো? 

না পারলে বলে দিই। মারলিন ওটি। মস্কো অলিম্পিকে ছিলেন, এথেন্সেও আছেন। ছিলেন মাঝের ৫টি অলিম্পিকেও। 

না, সবচেয়ে বেশি অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার রেকর্ড এটি নয়। ১৯৬৪ থেকে ’৯৬— ৯টি অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন অস্ট্রিয়ান সেইলর হুবার্ট রাউদাসল। ৮টি অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন ৪ জন, ৭টি অলিম্পিকে ছিলেন আরও ৫ জন। তবে তাঁদের সবাই সেইলিং, ইকুয়েস্ট্রিয়ান বা শ্যুটিংয়ে, যেগুলোর কোনোটিতেই বয়স এমন শত্রু হয়ে দাঁড়ায় না। অ্যাথলেটিকসে ৭টি অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার প্রথম উদাহরণ মারলিন ওটিই।

শুধু অ্যাথলেটিকস বললেই তো হচ্ছে না, ফিটনেস আর রিফ্লেক্স সবচেয়ে বড় পরীক্ষা যেখানে, মারলিন ওটি সেই স্প্রিন্টার। ২০ বছর বয়সে প্রথম অলিম্পিকে ২০০ মিটারে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন, এথেন্সে ৪৪ বছর বয়সে ১০০ মিটারের হিটে দ্বিতীয় হয়ে পরের রাউন্ডে উঠলেন কাল। তাঁর হিটে এমন দুজন ছিলেন, ওটি প্রথম অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার সময় যাঁদের জন্মই হয়নি! 

শরীরে ঘাম, তখনো একটু হাঁপাচ্ছেন। দৌড় শেষ করে মিক্সড জোনে দাঁড়িয়ে ৭ অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার রহস্য নিয়ে একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে এক পর্যায়ে বললেন, ‘আমার মৃত্যুর পর আমার শরীর পরীক্ষা করলে হয়তো এর উত্তর পাওয়া যাবে। আমি সেই অনুমতি দিয়ে যাব।’ ওটি নিজে কি এমন ভেবেছিলেন? ‘না, একদমই ভাবিনি। ১৯৮০ সালে যখন মস্কোতে গেলাম, তখন যদি আমাকে প্রশ্ন করা হতো ২৪ বছর পরও আমি অলিম্পিকে দৌড়াব কি না, আমি হয়তো হেসেই মরে যেতাম।’ বলার সময়ও হাসলেন। 

অলিম্পিক নিয়ে মারলিন ওটির প্রথম স্মৃতির বয়স আরও চার বছর বেশি, ১৯৭৬ সালের মন্ট্রিয়ল অলিম্পিকই প্রথম অলিম্পিক শব্দটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তাঁকে। ‘তখন আমাদের টেলিভিশন ছিল না। রেডিওতে সবাই অলিম্পিকের ধারাবিবরণী শুনছিল। আমি ভেবেই পাচ্ছিলাম না, এটা নিয়ে এত মাতামাতির কী আছে। তারপরই কে যেন বলল, জ্যামাইকার একজন জিতে যাচ্ছে। তখনই আমি আমার পরিবারের সবাইকে বলি, আগামী অলিম্পিকে অংশ নিতে যাচ্ছি আমি।’ সেই যে অংশ নিতে শুরু করলেন, এখনো পর্যন্ত তাতে ছেদ পড়েনি।

ছবি: গেটি ইমেজেস

প্রথম অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন বলেই কি না, ব্রোঞ্জই তাঁর নিয়তি হয়ে গিয়েছিল। লস এঞ্জেলেসে ১০০ ও ২০০ মিটারে ব্রোঞ্জ, বার্সেলোনায় শুধু ২০০ মিটারে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেও শুধু ব্রোঞ্জই জিতে যাচ্ছিলেন বলে তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল ‘ব্রোঞ্জ কুইন’। গা থেকে এই তকমাটি প্রথম ঝেড়ে ফেললেন ১৯৯৩ স্টুটগার্ট বিশ্ব চ্যাম্পিয়নমিপে। ২০০ মিটারে সোনা জিতলেন, দু'বছর পর গোথেনবার্গেও ধরে রাখলেন সেই সোনা। কিন্তু একজন অ্যাথলেটের জন্য আজন্ম আরাধ্য অলিম্পিক সোনা মরীচিকাই হয়ে থেকেছে। আটলান্টায় ১০০ ও ২০০ মিটার দুটোতেই রুপা, সিডনিতে ৪০০ মিটার রিলেতেও তা-ই। প্রিয় স্প্রিন্টার কে— এই প্রশ্নে রসিকতা করে বললেন, ‘গেইল ডেভার্স। কারণ সব সময়ই আমি তাঁর কাছে হারি।’

অলিম্পিকে ৩টি রুপা আর ৫টি ব্রোঞ্জ; বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ৩টি সোনা, ৪টি রুপা ও ৭টি ব্রোঞ্জ (আর কারও ১৪টি পদক জয়ের রেকর্ড নেই), সিডনিতে ৪০ বছর ১৪৩ দিন বয়সে রিলে জিতে অলিম্পিক অ্যাথলেটিকসে সবচেয়ে বেশি বয়সে পদক জয়ের রেকর্ড— এত সব অর্জনের মধ্যে আক্ষেপ ওই অলিম্পিক সোনাটাই। চিরদিনই যে তা আক্ষেপ হয়ে থাকবে, মেনেই নিয়েছেন সেটি, ‘এবার আমি যদি ফাইনালে উঠতে পারি, সেটিকেই মনে করব অনেক।’ প্রথম হিটে এ বছরে তাঁর সেরা টাইমিং (১১.১৪ সেকেন্ড) করেছেন, যদিও ফাইনাল এখনো অনেক দূরের পথ। এরপর ৩২ জনের দ্বিতীয় রাউন্ড, ১৬ জনের সেমিফাইনাল, তারপর না ফাইনাল।

তাঁর ৭টি অলিম্পিকে অংশ নেওয়া নিয়ে এত যে হই চই হচ্ছে, সেটিকে খুব বড় করে দেখছেন না বলে জানাচ্ছেন (‘আমি এ নিয়ে ওহ, ওয়াও বলছি না। বলছে অন্য লোকে’), তবে সত্যিটা হলো সপ্তম অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার জন্যই ১৯৭৯ থেকে ’৯৭ সালের মধ্যে ১৫ বার জ্যামাইকার সেরা মহিলা ক্রীড়াবিদের গায়ে এখন স্লোভেনিয়ার প্রতীক। ট্রায়ালে ষষ্ঠ হওয়ার পরও তাঁকে সিডনি অলিম্পিকে পাঠানো নিয়ে জ্যামাইকার অন্য ক্রীড়াবিদরা প্রায় বিদ্রোহই করেছিল। তখনই জ্যামাইকাকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। তিন বছর ধরেই স্লোভেনিয়ায়। তাঁর কোচ স্লোভেনিয়ান, স্লোভেনিয়ায় প্র্যাকটিস সুবিধা ভালো— শুধু ওটির মুখের কথার ওপর নির্ভর করলে কারণ এগুলোই। আসল কারণটা বলছেন না, জ্যামাইকা থেকে তাঁর অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করা একটু কঠিনই হতো।

পদকের আশা নিজেই করছেন না। ফাইনালে ওঠার লক্ষ্য পূরণ হলো কি হলো না, তাতেও কিছু আসে-যায় না। ৪৪ বছর বয়সে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে নেমেই তো জিতে গেছেন মারলিন ওটি।

চার বছর পর বেইজিংয়েও কি এমন কিছু লেখা হবে? তখন বয়স হবে ৪৮, কীভাবে সম্ভব? 

ওটি কিন্তু হেসে বলছেন, ‘হু নোজ!’ 

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×