অলিম্পিক টেনিস বলেই ফেদেরার-রডিক-উইলিয়ামস কেউ নেই
২০০৪ অলিম্পিক
উৎপল শুভ্র
২১ জুলাই ২০২১
অলিম্পিকের টেনিসে স্বর্ণ জেতা কত কঠিন? উত্তরটা রজার ফেডেরারেরই ভালো দেওয়ার কথা। বহু চেষ্টা-চরিত করেও এককে রুপার বেশি কিছু জিততে পারেননি, ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে বাদ পড়েছিলেন শেষ আটেই। এথেন্স অলিম্পিকে প্রায় কাছাকাছি সময়েই অ্যান্ডি রডিক, ভেনাস উইলিয়ামসদের মতো শীর্ষ বাছাইরা বাদ পড়াতে জেগেছিল প্রশ্নও, আজীবন ব্যক্তি লড়াই করে আসা টেনিস খেলোয়াড়েরা কি দেশ-টেশ ব্যাপারগুলো বোঝেন?
প্রথম প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০০৪। প্রথম আলো
স্পেনের রানী সপারিষদ এসে সারাক্ষণ উৎসাহ দিয়ে গেলেন বলেই হয়তো বেঁচে গেলেন কার্লোস ময়া। চারপাশে যেভাবে তারা খসে পড়ার ধুম লেগেছিল, তাতে রানীর অনুপ্রেরণাদায়ী উপস্থিতিটা জরুরিই ছিল। সেটি আরও বোঝা গেল ম্যাচের পর। ক্রোয়েশিয়ার আইভো কার্লোভিচকে ৭-৬, ৪-৬, ৬-৪ গেমে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেই রানীর সামনে ময়া এমন লাফালাফি শুরু করলেন যে, মনে হতেই পারত এই মাত্র একটা গ্র্যান্ড স্লাম জিতলেন!
তা লাফালাফি করতেই পারেন। অলিম্পিক টেনিসের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠাটাকে যে গ্র্যান্ড স্লাম জয়ের চেয়েও কঠিন বলে মনে হচ্ছে এখানে। বিশ্বাস না হলে রজার ফেডেরারকে জিজ্ঞেস করুন। পিট সাম্প্রাস-উত্তর ছেলেদের টেনিসে এই সুইসের নামটি বলার পর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পরের নামটি বলতে হয়। অথচ সেই ফেডেরার যাঁর কাছে হেরে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায় নিলেন, তাঁর নামের উচ্চারণ কী হবে, তা নিয়ে সাংবাদিকদের গবেষণা করতে হলো। এর আগে যে তা উচ্চারণ করার প্রয়োজনই হয়নি।
আগামী মাসে উনিশে পড়বেন, এর আগে কোনোদিন র্যাঙ্কিংয়ে ৮০-র ওপরে থাকা কাউকে হারাতে পারেননি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে টমাস বার্ডিচ জানালেন, এর আগে ফেডেরারের সঙ্গে খেলা দূরে থাক, তাঁকে চোখেও দেখেননি। টেলিভিশনে দেখেছেন, এই ম্যাচের সময়ই প্রথম দেখলেন সামনাসামনি। র্যাঙ্কিংয়ে এত নিচে যে, বড় টুর্নামেন্টগুলোতে খেলার সুযোগ পান না। তারপরও ফেডেরারকে হারিয়ে দিলেন, কারণ এটি অলিম্পিক টেনিস।
অলিম্পিক টেনিস বলেই টমাস বার্ডিচ, টেলর ডেন্ট, নিকোলাস মাসু, মার্ডি ফিশ, মিখাইল ইউজনি, সেবাস্টিয়ান গ্রঁসা, ফার্নান্দো গঞ্জালেস— এই নামগুলো পড়তে হচ্ছে আপনাকে। কার্লোস ময়া ছাড়া এই সাতজনই ছেলেদের বিভাগে বাকি সাত কোয়ার্টার ফাইনালিস্ট। সেবাস্টিয়ান গ্রঁসার এটিপি ট্যুরে টুকটাক সাফল্য আছে, কিন্তু বাকি নামগুলো? কটি শুনেছেন এর আগে?
ফেডেরার খসে পড়েছিলেন গত মঙ্গলবার। পঞ্চম বাছাই কার্লোস ফেরেরোও সেদিনই। ‘ব্যতিক্রম’-এর পরিবর্তে এটিই যে ‘নিয়ম’, তা প্রমাণ করতে পরদিন তাদের আরও অনেক সঙ্গী। সেন্টার কোর্টে ওয়ার্ল্ড নাম্বার টু অ্যান্ডি রডিকের পরাজয় দেখার পর প্রায় ছুটতে ছুটতে পাশের কোর্টে গিয়েও ভেনাস উইলিয়ামসের ম্যাচটি ধরা গেল না। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে তখন দর্শকদের বিদায় জানাচ্ছেন সিডনির সোনাজয়ী। শুধু দর্শকদের নয়, এথেন্স অলিম্পিককেও।
ভেনাসের তা-ও সান্ত্বনা আছে, মেরি পিয়ার্সের কাছে হেরেছেন। র্যাঙ্কিংয়ে ২৮ নম্বরে নেমে গেছেন বলে এখানে অবাছাই, তবে ফ্রেঞ্চ আর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জয়ের কৃতিত্ব আছে পিয়ার্সের। কিন্তু ফেডেরার-রডিকের পরাজয়ের ব্যাখ্যা কী? খেলায় অঘটন হয়ই, এটাই বলবেন তো? এর চেয়েও বেশি বাজার পাচ্ছে অন্য একটি ব্যাখ্যা। সেই ব্যাখ্যা হলো, টেনিস এত বেশি ব্যক্তি কেন্দ্রিক খেলা যে, দেশ-টেশ অনুভূতি ফেডেরার-রডিকদের উদ্দীপ্ত করতে পারে না। এখানে টাকা নেই, র্যাঙ্কিংয়ে এর কোনো প্রভাব নেই... একটা পদকের জন্য মনপ্রাণ ঢেলে দেওয়ার মানসিকতাটাই তো টেনিস খেলোয়াড়দের অজানা।
এটা তো আর মুখের ওপর বলে ফেলা যায় না। তবে সংবাদ সম্মেলনে একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এই প্রশ্নটার সামনে পড়তে হয়েছে ফেডেরার-রডিক-উইলিয়ামস সবাইকেই। প্রত্যেকেই জানালেন, অলিম্পিকে খেলাটা তাঁদের কাছে বিশেষ কিছু এবং এতে হেরে খুব মন খারাপ হয়েছে। যাঁরা শুনলেন, মুখ দেখে মনে হলো তাঁদের বেশির ভাগই বিশ্বাস করছেন না। যাঁরা বলছেন, তাঁরা নিজেরাও যে নয়, তার প্রমাণ ক'দিন পরের গ্র্যান্ড স্লাম ইউএস ওপেন নিয়ে কথা বলার সময় যখন তাঁদের অনেক বেশি উজ্জ্বল দেখাল।
রডিক-উইলিয়ামসের বিদায়ের ঘণ্টাতিনেক পর ৪ নম্বর কোর্টে যে ডাবলস ম্যাচটি হচ্ছিল, তার একটি জুটি অবশ্য সব সময়ই এই সংশয়ের ঊর্ধ্বে ছিল এবং এখনো আছে। লিয়েন্ডার পেজ প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও পেশাদার টেনিসে দাঁড়াতে পারেননি, কিন্তু দেশের হয়ে খেলার সময় সেই পেজই অন্য খেলোয়াড়। মহেশ ভূপতির সঙ্গে তাঁর জুটি ডাবলসে বিশ্বসেরা হয়ে উঠেছিল এক সময়। টেনিসের ডাবলস জুটির সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর সংসারের অনেক মিল। মনের মিল না থাকলে ঠোকাঠুকি অনিবার্য। লি-হেশের রূপকথাও তাই শেষ হয়ে গেছে। শুধু দেশের কথা ভেবেই অলিম্পিকে আবারও একসঙ্গে তাঁরা।
ভারতীয়দের ভিড় তো থাকবেই। লি-হেশের প্রতিপক্ষ জিম্বাবুইয়ান জুটিরও কিছু সমর্থক থাকল। পয়েন্ট জিতলেই পেজ আর ভূপতির বাতাসে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুড়ে দেওয়া আর বুকে ঠোকাঠুকি কোর্ট থেকে কোর্টে ঘুরতে থাকা কিছু দর্শককেও আটকে ফেলল এই কোর্টের পাশে। আটকে ফেলল ভারতীয়দের অভিনব ট্যাকটিকসটাও। নিজেদের ভলির ওপর এমন বিশ্বাস যে, সার্ভিস করেই পেজ আর ভূপতি দুজনই নেটের সামনে। কাজেও দিল এই কৌশল, সেমিফাইনালে উঠে ভারতকে আরেকটি পদক জয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন পেজ-ভূপতি।
গত পরশু সন্ধ্যায় ১১ কোর্টের টেনিস কমপ্লেক্স কেঁপে উঠছিল একটি কোর্ট থেকে ভেসে আসা চিৎকারেই। সেন্টার কোর্টে আনাস্তাসিয়া মিসকিনার সঙ্গে খেলছিলেন গ্রিসের ইলেনা দানিলিজু। গ্যালারিতে যেদিকে চোখ যায়, শুধুই গ্রিসের পতাকা, তা দোলাতে দোলাতে ৮ হাজার দর্শকের ‘ইলেনা’ ‘ইলেনা’ চিৎকার। সেই চিৎকারের এমনই জোর যে, বিশ্বের ৩ নম্বর মিসকিনা আনফোর্সড এররের বন্যা বইয়ে দিলেন। মনে হচ্ছিল গ্রিক দেব-দেবীরাও ইলেনার পক্ষে কাজ করতে শুরু করেছেন। তাঁর শট নেটের কর্ডে লেগে মিসকিনার কোর্টে পড়ে আর মিসকিনারটি পড়ে নিজের কোর্টেই। একবার এমন ঘটনার পর যখন ইলেনা নেটের কর্ডে চুমু খেলেন, আর রাগ সামলাতে পারলেন না মিসকিনা। যত জোরে পারেন মেরে বল পাঠিয়ে দিলেন গ্যালারির দোতলায়। যেন বলেরই দোষ!
লাভের মধ্যে লাভ তো নেই-ই, মিসকিনার বরং ক্ষতিই হলো। দর্শকদের চিৎকারটা আরও বাড়ল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ইলেনা এবং চিৎকার দুটোকেই হারাতে পারলেন মিসকিনা।
মেয়েদের কোয়ার্টার ফাইনালে মিসকিনা ছাড়াও রুশ আছেন আরেকজন, অথচ টেনিসে যাদের এত আধিপত্য, সেই আমেরিকানদের একজনও নেই। উইলিয়ামসের সঙ্গে চান্দা রুবিনও হেরেছেন এদিন, ফেডেরারের বিদায় যার শিরোপা জয়ের পথ নিষ্কণ্টক করে দিয়েছে বলে মনে হয়েছিল, একই দিন সেই অ্যান্ডি রডিকও। এই যে একই দিনে প্রায় একই সময়ে তিন আমেরিকানের পরাজয়, এর কারণ কি এই যে, অন্য দেশের খেলোয়াড়রা ‘আমেরিকানদের হারাতেই হবে’ এমন একটা বাড়তি প্রতিজ্ঞা নিয়ে নামছেন? অ্যান্ডি রডিককে প্রশ্নটা করা হলো সংবাদ সম্মেলনে। জর্জ বুশের আমেরিকার প্রতি বাকি বিশ্বের যে একটা বিরাগ, ইঙ্গিতটা সেদিকেই। হয় রডিক সেটা বুঝলেন না অথবা ইচ্ছে করেই বুঝতে চাইলেন না। তাঁর উত্তরটা টেনিসেই সীমাবদ্ধ থাকল।
মাথা-গরম বলে কুখ্যাতি আছে, তবে রডিকের ভালোই জানা যে, কখনো কখনো বুঝেও না বোঝার ভান করাটাই ভালো।