নিজের লক্ষ্যই ছুঁতে পারলেন না আসিফ
২০০৪ অলিম্পিক
উৎপল শুভ্র
২১ জুলাই ২০২১
৬০০'র মধ্যে করতে পেরেছিলেন ৫৮৭ স্কোর, ৪৭ জন প্রতিযোগীর মধ্যে হয়েছিলেন ৩৩তম। মাত্র ৫০ দিনের এক ক্যাম্প করে ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে গিয়ে শ্যুটার আসিফ হোসেন খান জেনেছিলেন পুরনো সত্যিটাই, 'এত কম দিনের প্রস্তুতিতে কিছু হয় না।'
প্রথম প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০০৪। প্রথম আলো।
শহর থেকে অনেক দূরে পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা গোলকধাঁধার মতো আঁকাবাকা রাস্তার মাথায় মার্কোপোলো শ্যুটিং সেন্টার। সাতসকালেই সেই পাহাড়ের মাথায় ঝোড়ো হাওয়ায় দুলতে দেখলাম লাল-সবুজ পতাকার ছোট্ট ছোট্ট সংস্করণ। ৩৩টি দেশের ৪৭ জন শ্যুটার যখন ১০ মিটার দূর থেকে এয়ার রাইফেল দিয়ে লক্ষ্যভেদের প্রতিযোগিতায় নামলেন, তখনো আসিফ হোসেন খানের ঠিক পেছনের গ্যালারিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বেশ বড়সড় একটা ভিড়।
বেশির ভাগ এর আগে শ্যুটিংই দেখেননি, নিয়ম-কানুনও জানেন না। শুধু জানেন, ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে আছেন আসিফ হোসেন খান, তাঁর মাধ্যমেই শুরু হচ্ছে বাংলাদেশের এথেন্স অলিম্পিক। এই একদিন কাজ না করলে কী আসে-যায়?
স্কোরবোর্ডে ফুটে ওঠা সংখ্যাগুলোর তাৎপর্যও তাদের বোধগম্যতার সীমানায় এল না। আসিফের ৫৮৭ স্কোর ভালো কি খারাপ, সেটিও নয়। তবে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের কাছ থেকে যখন জানলেন যে, ৪৭ জনের মধ্যে আসিফের স্থান ৩৫তম, তখন একজনের মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, ‘তাহলে তো খুব ভালো নয়!’
আসলেই ভালো নয়। গত মার্চে ইসলামাবাদ সাফ গেমসে ৫৯০ স্কোর করে এই ইভেন্টের সোনা জিতেছিলেন, প্র্যাকটিসেও অনেকবার এই স্কোর করেছেন। সেই ক্যারিয়ার-সেরা স্কোর করার লক্ষ্য নিয়েই এসেছিলেন জীবনের প্রথম অলিম্পিকে। হলো না।
শেষ পর্যন্ত আসিফের স্কোর ৫৮৭, দু বছর আগে ম্যানচেস্টারে কমনওয়েলথ গেমসে এই স্কোর করেই সোনা জিতেছিলেন। কিন্তু কমনওয়েলথ গেমস যদি নদী হয়, অলিম্পিক তাহলে সাগর। এমনই সাগর যে, নিজের সেরা স্কোর (৫৯০) করলেও আসিফের স্থান হতো ২৪তম। প্রাথমিক পর্ব শেষে ফাইনালে উঠেছেন যে আটজন, তাঁদের প্রথমজনের স্কোর ৫৯৯ (৬০টি শটের মাত্র ১টি মিস), অষ্টমজনের ৫৯৪। মেয়েদের এই ইভেন্টেই এবারের অলিম্পিকের প্রথম সোনাটি জিতেছিলেন চীনের লি ডুন। ছেলেদের বিভাগে সোনা-রুপা দুটোই চীনের। কিনান ঝু সোনা জিতেছেন নতুন রেকর্ড করে। প্রাথমিক পর্ব শেষে তৃতীয় স্থানে থাকা ভারতের অভিনব বিন্দ্রা শেষ পর্যন্ত হয়ে গেছেন সপ্তম।
অভিনব বিন্দ্রার সঙ্গে আসিফের খুব বন্ধুত্ব। তারপরও ফাইনাল না দেখেই ভিলেজে ফিরে গেলেন তিনি। অলিম্পিক গেমসে অংশ নেওয়ার সুখস্মৃতি নিয়ে (‘অলিম্পিক বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা, এতে অংশ নেওয়াটাও আনন্দের ব্যাপার’), নিজের সেরাটুকুও দেখাতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে (‘৫৯০ স্কোর করতে পারলেই আমি খুশি থাকতাম’)।
আক্ষেপ শুধু এটুকুই নয়। অলিম্পিকে এসে বিশ্বমানের সব শ্যুটারের সঙ্গে কথা হয়েছে, পুরনো সত্যিটাই আবারও নতুন করে জেনেছেন। পুরনো সত্যিই, তারপরও আক্ষেপ যে থাকেই! চীনের যে ছেলেটা ৫৯৯ স্কোর করল, তাঁর সঙ্গে আপনার পার্থক্য কিসের? প্রতিভার, আত্মবিশ্বাসের বা মানসিক শক্তির? আসিফের উত্তর জানাল, এর কোনোটাই নয়। আসল পার্থক্য প্র্যাকটিসের সুযোগ-সুবিধা, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং এই পার্থক্য ঘোচানোর ক্ষমতা আসিফের নেই। ‘আমি যতটা সুযোগ-সুবিধা পেয়েছি, বাংলাদেশের আর কোনো শ্যুটার তা পায়নি’— এই কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন, তবে সেই ‘সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা’ও যে কতটা অপর্যাপ্ত, তা বুঝিয়ে দিচ্ছে প্রতিবেশী দেশের অভিনব বিন্দ্রার সঙ্গে তুলনা। এই অলিম্পিকের আগে জার্মানির যে শ্যুটিং স্কুলে আসিফ ৫০ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে এলেন, বিন্দ্রা গত সাত বছর ধরে সেই স্কুলের ছাত্র। গত কয়েক বছরে সব বড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন, এই অলিম্পিকের প্রস্তুতির জন্য গত সাফ গেমসেও যাননি। তাঁর জন্য দেশী-বিদেশী মিলিয়ে পাঁচজন কোচের একটি সেলের মতো আছে, তাঁরা আলাপ-আলোচনা করে একমত হওয়ার পরই সেই পরামর্শটা বিন্দ্রার কাছে পৌঁছায়।
এর পাশে বাংলাদেশের ‘সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা’ পাওয়া শ্যুটারকে রাখুন। অলিম্পিক শুরুর ঠিক আগে জার্মানিতে পাঠানো হলো, সেখানে তাঁর অনেক কিছু বদলে দিয়েছেন কোচেরা, একই সঙ্গে বলে দিয়েছেন, ‘যা করা হলো, তার ফল তুমি অলিম্পিকে পাবে না। এত তাড়াতাড়ি কিছু হয় না।’ অলিম্পিকে আসা প্রায় সব শ্যুটারের সঙ্গেই কোচ আছেন। এত বড় প্রতিযোগিতা, নতুন জায়গা...সব মিলিয়ে কঠিন এক চাপ, কোচ এখানে বড় এক সহায়। কিন্তু কর্মকর্তায় গিজগিজ করতে থাকা বাংলাদেশ দলে কোচের জন্য জায়গা কই?
পৌনে ২ ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে বাকি বিশ্ব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে মনঃসংযোগের কঠিন এক পরীক্ষা এই ইভেন্ট। মনোবিদের সাহায্য নেওয়াটা শ্যুটারদের জন্য তাই আবশ্যিক বিষয়। অথচ আসিফের জন্য তা ফোর্থ সাবজেক্টও নয়। মনোবিদ কী বস্তু, আজ পর্যন্ত তা জানতেই পারেননি। তারপরও আসিফ স্বপ্ন দেখেন। চার বছর পর বেইজিং অলিম্পিকে চমকে দেওয়ার স্বপ্ন, ‘মাঝের সময়টায় যদি প্রস্তুতি ভালো হয়, যদি বড় বড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারি, তাহলে বেইজিংয়ে ভালো করতে পারব বলে বিশ্বাস করি।’
পাসপোর্টের জন্মতারিখ অনুযায়ী গত ফেব্রুয়ারিতে আঠারো হলো। আসল জন্ম তারিখটা আরও এক বছর আগে। তারপরও দেখা গেল, ১৯ বছরের আসিফই ৪৭ জন প্রতিযোগীর মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী। স্বপ্ন তো দেখবেনই, এটা তো স্বপ্ন দেখারই বয়স। কিন্তু সেই স্বপ্নে কাঁটার মতো বিঁধে থাকা ‘যদি’গুলোকে আসিফের পথ থেকে সরিয়ে দেবে কে?