‘কেদেরিস কেলেঙ্কারি’তে অন্ধকার গ্রিস

২০০৪ অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

‘কেদেরিস কেলেঙ্কারি’তে অন্ধকার গ্রিস

পুরো নাম কোস্তাদিনোস কেদেরিস। সিডনি অলিম্পিক ২০০ মিটারে সোনাজয়ী, ২০০০ থেকে ২০০২ পর্যন্ত টানা তিন বছর গ্রিসের ‘অ্যাথলেট অব দ্য ইয়ার’। সন্দেহাতীতভাবে গ্রিসের ইতিহাসে সবচেয়ে নামী অ্যাথলেট, তবে ২০০৪ অলিম্পিকে এসে সবচেয়ে কলঙ্কিত হিসেবেও লেখা হয়ে গেছে তাঁর নাম।

প্রথম প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০০৪। প্রথম আলো

অলিম্পিক স্টেডিয়ামের ঠিক পাশে ইনডোর হল, জিমন্যাস্টিকসে মেয়েদের দলগত ইভেন্টের প্রাথমিক পর্ব নিয়ে তুমুল হইচই। কিন্তু প্রেস গ্যালারির ঠিক পাশে এথেন্স অলিম্পিকের হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবককে আলাদা করে চিনিয়ে দেওয়া টি-শার্টের জটলাটির সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। হাত নেড়ে উচ্চঃস্বরে কথা বলছে পাঁচ-ছয়জন ছেলেমেয়ে। চোখমুখ থেকে পরিষ্কার, কোনো একটা বিষয় নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ তারা। কথাবার্তা যা হচ্ছে, তা স্বাভাবিকভাবেই ‘অল গ্রিক’। তবে বারবার উচ্চারিত একটা শব্দ বুঝতে কোনো সমস্যা হলো না—‘কেদেরিস’।

জটলায় সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ কলেজ ছাত্র ভারাভারিটিস ভাগফ্লিস পাশে দাঁড়ানো উৎসুক দর্শককে বিষণ্ন মুখে জানালেন, ‘এই অলিম্পিকটি আমাদের কাছে অন্য রকম। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি এত ভালো হয়েছে যে, গ্রিক হিসেবে আমাদের খুব গর্ব হচ্ছিল। কিন্তু কেদেরিস আমাদের মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছে।’

পুরো নাম কোস্তাদিনোস কেদেরিস। সিডনি অলিম্পিক ২০০ মিটারে সোনাজয়ী, ২০০০ থেকে ২০০২ পর্যন্ত টানা তিন বছর গ্রিসের ‘অ্যাথলেট অব দ্য ইয়ার’। সন্দেহাতীতভাবে গ্রিসের ইতিহাসে সবচেয়ে নামী অ্যাথলেট, সবচেয়ে কলঙ্কিত হিসেবেও কি এখন লেখা হতে যাচ্ছে তার নাম?

গত কিছুদিন অ্যাথলেটিকসের ওপর ডোপিংয়ের কালো ছায়াটা এমন বড় হচ্ছিল যে, এথেন্সে বড় কোনো কেলেঙ্কারি একরকম অবধারিতই ছিল। তাই বলে এমন! স্বাগতিক দেশের সবচেয়ে নামী অ্যাথলেট গেমস শুরুর আগেই জড়িয়ে পড়বেন ডোপিং কেলেঙ্কারিতে? বেন জনসনও যে এখানে হেরে যাচ্ছেন!

এথেন্স ২০০৪ এখন ‘কেদেরিস কেলেঙ্কারি’ নিয়েই উন্মাতাল। সব শঙ্কা মিথ্যে প্রমাণ করে সময়কে হার মানিয়ে প্রস্তুত হয়ে গেছে সব ক'টি ভেন্যু। ঝাঁ চকচকে সেসব ভেন্যুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। নতুন রাস্তাঘাট, নতুন ট্রামলাইন নিয়ে এথেন্স এমনভাবে সেজেছে যে, এক বছর আগেও ‘ঘিঞ্জি’ এথেন্সকে দেখে যাওয়া পর্যটক রীতিমতো অবাক! মেইন প্রেস সেন্টারে একটু কান পাতলেই ১৩ তারিখের ওপেনিং সেরিমনি নিয়ে বিদেশি সাংবাদিকদের উচ্ছ্বাস শোনা যাচ্ছে দু'দিন পরও। এই এক রাশ আলোর মধ্যে অন্ধকার হয়ে এলেন কোস্তাদিনোস কেদেরিস। এমনই অন্ধকার যে, গ্রিসের সব আলো তাতে মুছে যাওয়ার উপক্রম। 

এই অলিম্পিকের আগে বিশ্বের ২০২টি দেশ আর সব কটি ফেডারেশন ওয়ার্ল্ড অ্যান্টি ডোপিং অথরিটির (ওয়াডা) সঙ্গে যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তাতে যেকোনো সময় যেকোনো অ্যাথলেটকে পরীক্ষা করার অধিকার তো আছেই, ডোপ টেস্টে ধরা পড়লে কমপক্ষে দু'বছরের শাস্তিও তাতে অবধারিত। অলিম্পিক শুরুর আগে থেকেই ডোপ-পাপীদের এথেন্স থেকে বের করে দেওয়ার কাজে নেমে পড়েছে ওয়াডা।

২০০০ অলিম্পিক থেকে গ্রিসে ফেরার পর কোচ, বান্ধবীর সঙ্গে কেদেরিস। এই ছবিটাই বদলে গিয়েছিল চার বছর পর। ছবি: রয়টার্স

কোস্তাদিনোস কেদেরিসকে যেদিন পরীক্ষা করার কথা, সেদিনই বান্ধবী ইকাতেরিনি থানুকে নিয়ে অলিম্পিক ভিলেজ থেকে তিনি লাপাত্তা। বান্ধবীও অ্যাথলেট, যেন-তেন অ্যাথলেট নন, প্রথম গ্রিক মেয়ে হিসেবে ইউরোপিয়ান ইনডোর চ্যাম্পিয়ন আর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে পদকজয়ী। এই অলিম্পিকেও ১০০ মিটার স্প্রিন্টে গ্রিসের আশা-ভরসা। 

অলিম্পিক ভিলেজে খুঁজে না পাওয়ার একটাই অর্থ, ২ ঘণ্টা পর বান্ধবীকে নিয়ে কোস্তাদিনোস কেদেরিস হাসপাতালে হাজির হওয়ায় ঘটনায় যোগ হয়েছে আরও নাটকীয়তা। যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কথা বলছেন তারা, তা রহস্যের সমাধান না করে রহস্য আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওই দুর্ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী তো নেই-ই, কথিত দুর্ঘটনা স্থলের কাছেই একটি হাসপাতাল থাকতে কেদেরিসরা কেন দূরের এক হাসপাতালে গেলেন, উত্তর নেই এ প্রশ্নেরও। 

আজ সেই উত্তর খোঁজার একটা চেষ্টা হবে। আইওসির বিশেষ কমিশনের সামনে দাঁড়াতে হবে কোস্তাদিনোস কেদেরিস ও ইকতেরিনি থানুকে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ছিল গ্রিস অ্যাথলেটিক ফেডারেশনেরই। তারা বন্দুকটা তুলে দিয়েছে আইওসির হাতে। এখন গুলি করা হবে কি হবে না, তা আইওসির ব্যাপার। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত ‘অলিম্পিক পরিবারে শান্তি বজায় রাখতে’ দুই অ্যাথলেট আর তাদের কোচ ক্রিস্টিস জেকোসকে অলিম্পিক দল থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে গ্রিস। 

আজ আইওসির কমিশনের সামনে অলিম্পিক ভিলেজ থেকে উধাও হওয়ার জন্য যে ব্যাখ্যাই (কাপড়-চোপড় আনতে বাসায় যাওয়ার কথা বলা হয়েছে এরই মধ্যে) দিন না কেন কেদেরিস, তাকে নিয়ে আগে থেকেই চলে আসা ফিসফিসানিটা সেটিকে সন্দেহের চোখেই দেখাবে। সিডনিতে অভাবিতভাবে সোনা জয়ের পরই ফিসফিসানিটার জন্ম, মাঝের চার বছরে কোনো না কোনো কারণ দেখিয়ে বড় সব ইভেন্ট থেকে সরে থাকায় সেটি আরও জোরালো হয়েছে। আগে থেকেই কেদেরিসের দিকে সতীর্থ অ্যাথলেটদের সন্দেহের চোখ। ডোপ টেস্টের সময় স্মৃতি বিস্মরণে আক্রান্ত হওয়াটাও এই প্রথম নয়। এর আগেও একটি মিটে নির্ধারিত ডোপ টেস্টের সময় খুঁজে পাওয়া যায়নি কেদেরিসকে। 

কোচ ক্রিস্টিস জেকোসের অতীতও কম ‘উজ্জ্বল’ নয়। সাত বছর আগের একটি ঘটনা এখন ফলাও করে আবার ছাপা হচ্ছে পত্র-পত্রিকায়। ডোপ টেস্টের ভয়ে ট্রেনিং গ্রাউন্ড থেকে পালিয়ে গিয়েছিল তাঁর ছাত্ররা আর জেকোস গিয়ে চড়াও হয়েছিলেন ডোপিং কর্মকর্তাদের ওপর।

সিডনিতে কেদেরিসের সোনা ১৯১২ সালের পর অলিম্পিকে গ্রিসের প্রথম কোনো পুরুষ অ্যাথলেটের এমন কৃতিত্বের উদাহরণ। শুধু দৌড়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে সর্বশেষ উদাহরণটির জন্য যেতে হয় সেই ১৮৯৬ সালে প্রথম অলিম্পিকের কাছে। কোস্তাদিনোস কেদেরিসকে নিয়ে গ্রিসে যে মাতামাতিটা হয়েছিল, সেটি তাই মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। না, ইউরো ২০০৪-এ ‘গ্রিক রূপকথা’ও চ্যারিস্টিয়াস-জাগোরাকিসকে গ্রিসের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রীড়াবিদের জায়গাটি পেতে দেয়নি, সেটি যেন ছিল কেদেরিসেরই সম্পত্তি।

‘ছিল’ই, এখন যা আছে তা হলো ক্ষোভ, হতাশা, হয়তো ঘৃণাও। সিডনি থেকে ফেরার পর পরই কেদেরিসের নামে যে রাস্তাটির নাম দেওয়া হয়েছিল, সেটির যে এখন কী হবে!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×