এদিকে থর্প ডাকে তো ওদিকে উইলিয়ামস
২০০৪ অলিম্পিক
উৎপল শুভ্র
২১ জুলাই ২০২১
আপনি যদি ক্রীড়াপ্রেমী হন, অলিম্পিক আপনার জন্য তীর্থ। একই সঙ্গে যন্ত্রণাও। সব খেলারই বিশ্বসেরারা তাদের ঐশ্বর্য দেখাতে হাজির এখানে, কোনটা ছেড়ে আপনি কোনটা দেখবেন? আপনার তো তাই রবার্ট পিরেস হওয়াই ভালো! অলিম্পিক কাভার করতে এসে প্রশ্ন করবেন, 'অলিম্পিক রেকর্ড না বিশ্ব রেকর্ড, কোনটা ভালো?'
প্রথম প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০০৪। প্রথম আলো
মাইকেল ফেলপস আর ইয়ান থর্প যখন সুইমিং পুলে নামছেন, টেনিস কোর্টে তখন ভেনাস উইলিয়ামস। একই সময় ফ্লোর এক্সারসাইজে ফুল ফোটাচ্ছেন সভেত্লানা খরকিনা।
‘সানডে টাইমস’-এর ওই সাংবাদিকটির মতো হলে ভিন্ন কথা। নইলে অলিম্পিক গেমসে এলে ‘কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখি’র সমস্যায় আপনাকে আক্রান্ত হতেই হবে। অলিম্পিক কাভার করতে ৫ জন স্পোর্টস রিপোর্টার পাঠিয়েছে সানডে টাইমস। এত বড় একটা আয়োজন, হাজার হাজার লোক... অন্য খবরও তো হবে, সেগুলো কাভার করতে ওই ষষ্ঠজন। যুদ্ধ আর রাজনীতি নিয়েই রবার্ট পিরেসের যত আগ্রহ, লেখার বিষয়ও তা-ই। মেইন প্রেস সেন্টারের বিশাল টিভি স্ক্রিনে অলিম্পিক আর বিশ্ব রেকর্ড পাশাপাশি দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোনটা বেশি ভালো? বিশ্ব রেকর্ড না অলিম্পিক রেকর্ড?’
স্পোর্টস রিপোর্টারের প্রশ্ন হতে পারে না এটা। চোখেমুখে বিস্ময় ফুটে উঠতে দেখে পিরেস ব্যাখ্যা করলেন, ‘আমি আসলে খেলার লোক নই। কোনো খেলা নিয়েই আমার আগ্রহ নেই। এখানে আসার পর ইয়ান থর্প আর মাইকেল ফেলপসকে নিয়ে এত মাতামাতি দেখে ওদের সম্পর্কে একটু জেনেছি।’
ভালোই আছেন রবার্ট পিরেস! আপনি যদি ক্রীড়াপ্রেমী হন, অলিম্পিক আপনার জন্য তীর্থ। একই সঙ্গে যন্ত্রণাও। সব খেলারই বিশ্বসেরারা তাদের ঐশ্বর্য দেখাতে হাজির এখানে, কোনটা ছেড়ে আপনি কোনটা দেখবেন?
সাঁতারে গেলে টেনিস ডাকবে, টেনিসে গেলে হকি, হকিতে গেলে ভলিবল। তা-ও রক্ষা, ফুটবলটা এখনো এথেন্সের বাইরেই ঘোরাঘুরি করছে। শ্যুটিং-জুডো-আর্চারি-ফেন্সিং-সাইক্লিংয়ে এখন সোনার লড়াই চলছে। তবে এগুলো এমনিতে খুব দর্শকপ্রিয় খেলা নয়, আপনিও না হয় বাদই দিলেন। কিন্তু সাঁতারে তো একবার যেতেই হবে। বলতে গেলে এথেন্স অলিম্পিকের চোখ তো এখন সাঁতার পুলের দিকেই। এমনিতেই জনপ্রিয়, সেই জনপ্রিয়তার আগুনে এবার ঘি ঢেলেছে থর্প-ফেলপস লড়াই। সাঁতারের সকালের পর্বে শুধুই হিট, ফাইনাল সব সন্ধ্যায়। সকাল ৯টার পর থেকেই গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দেওয়ার মতো রোদ, তারপরও হিট দেখতেই একোয়াটিক সেন্টারের গ্যালারিতে উপচে পড়ার মতো ভিড়। না হয় আপনিও তাদের সঙ্গী হলেন। কি দেখলেন সেখানে? কি দেখলেন না, তাই বলুন!
‘শতাব্দীর সেরা ইভেন্ট’ বলা হচ্ছে যেটিকে, সেই ২০০ মিটার ফ্রি স্টাইলের হিট দেখে ফেলা মানে তো সাঁতারের প্রায় সবই দেখে ফেলা। এই ইভেন্টে বিশ্ব রেকর্ড ইয়ান থর্পের, সাম্প্রতিক রেকর্ড ভালো ফেলপসের, আবার অলিম্পিক সোনার মতো অলিম্পিক রেকর্ডটাও পিটার ফন হুগেনব্যান্ডের। কাকে ছেড়ে কাকে এগিয়ে রাখবেন? কাল সকালে নিজেদের হিট জিতলেন তিন জনই। জিতবেনই তো, এটা আবার বলতে হয় নাকি? পারলে বলুন, ফাইনালে কে জিতবে? মুখ শুকিয়ে গেল তো! আরেকটু অপেক্ষা করুন, উত্তর পেয়ে যাবেন। আজ সন্ধ্যায়ই সেই ‘স্বপ্নের ইভেন্ট’, ২০০ মিটার ফ্রি স্টাইল।
একের পর এক সুইমিং পুলে নামছেন ফেলপস-থর্প-হুগেনব্যান্ড, একোয়াটিক সেন্টার থেকে আপনার বেরুতে ইচ্ছে না করারই কথা। কিন্তু যখন জানবেন, আধ মাইলেরও কম দূরত্বের টেনিস কমপ্লেক্সে প্রথম ম্যাচ খেলছেন ভেনাস উইলিয়ামস, তখন একটু উসখুস শুরু হতে বাধ্য। সভেত্লানা খরকিনা তো এর চেয়েও কাছে। সুইমিং পুলের গা লাগানো ইনডোর হলে একই সময়ে চলছে জিমন্যাস্টিকস। মেয়েদের দলগত ইভেন্টের প্রাথমিক রাউন্ড, তাতে কি? ফ্লোরে-বিমে-প্যারালাল বারে ফুল তো ঠিকই ফুটছে। সভেত্লানা খরকিনা ফ্লোর এক্সারসাইজ মাতিয়ে দিচ্ছেন তো ব্যালান্স বিমে জবাব দিয়ে দিচ্ছেন অলরাউন্ড শিরোপার জন্য খরকিনার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কার্লি প্যাটারসন। একবার ঢুকে পড়লে এখান থেকে বেরোনোটাও একটু কঠিনই হবে।
যদি বেরিয়েই পড়েন, ঠিক সামনেই পেয়ে যাবেন ইনডোর পুল। ভেতরে ঢুকলেই দেখবেন, পুলের একপাশে ওয়াটারপোলো খেলা হচ্ছে। এটি যদি না টানে, উল্টো দিকে আপনার চোখ আটকে যেতে বাধ্য। শরীরে হাড়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয় জাগিয়ে ৩ মিটার, ১০ মিটার, ৩০ মিটার ওপর থেকে নিচে ডাইভ দিয়ে পুলে পড়ছেন জলপুত্র-জলকন্যারা। পড়ার পথে যা করছেন, সেটিই আপনাকে আটকে রাখতে চাইবে ওখানে। কিন্তু আটকে থাকলে চলবে কি করে? অলিম্পিক কমপ্লেক্সটাই তো এখনো শেষ হয়নি।
মূল অলিম্পিক স্টেডিয়ামের (অ্যাথলেটিকস ও ফুটবল ফাইনাল) পাশে একোয়াটিক সেন্টার (সাঁতার), ইনডোর সুইমিং পুল (ওয়াটারপোলো ও ডাইভিং), ইনডোর হল (জিমন্যাস্টিকস), টেনিস কমপ্লেক্স আর ভেলোড্রাম (সাইক্লিং) নিয়ে এই অলিম্পিক কমপ্লেক্স। চাইলেই আপনি থর্পকে ছেড়ে ভেনাস উইলিয়ামসের কাছে যেতে পারেন, ভেনাসকে ছেড়ে খরকিনার কাছে। সবই না হয় ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেলেন।
কিন্তু অলিম্পিক কমপ্লেক্সই তো সব নয়। এর বাইরেও তো কত আকর্ষণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এথেন্সের নানা কোণে। ঠিক আছে, বেসবল-সফটবল বাদ দিয়ে দিন, আমেরিকানরা এ নিয়ে যতই মাতামাতি করুক, আমাদের কিছু আসে যায় না। ইকুস্ট্রেরিয়ান আর ক্যানোয়িং-সেইলিং এ সবও না হয় বাদ। কুস্তি-ভঙ্গি ভালো লাগে না? ঠিক আছে, এগুলোও বাদ। ভারোত্তোলনেও না হয় না-ই গেলেন। কিন্তু তারপরও তো হকি, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, ভলিবল, বাস্কেটবল থাকছে। সেগুলো টানছেও, বাংলাদেশের কারও জন্য এ সব খেলার বিশ্বসেরাদের দেখার সুযোগ তো আর সচরাচর আসে না।
টিকেট কেটে দেখতে হলেও লোভ সামলানো কঠিন। আর আপনার গলায় যদি এমন একটি কার্ড থাকে, যে কার্ড আলীবাবার গল্পের চিচিং ফাঁকের মতো সব গেট খুলে দেয়, তখন অলিম্পিক আনন্দেরই থাকে, তবে অনেকখানি আক্ষেপও যোগ হয়ে যায় তার সঙ্গে।
চারদিক থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকা খেলাগুলোকে উপেক্ষা করে যদি সেই আক্ষেপের কথা লিখতেও হয়, তাহলে তো আরও ভালো!