ফেলপসও তাহলে মানুষ!
২০১২ লন্ডন অলিম্পিক
উৎপল শুভ্র
২১ জুলাই ২০২১
বেইজিংয়ে যে ইভেন্টে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে সোনা জিতে শুরু হয়েছিল ফেলপসের অবিশ্বাস্য জয়যাত্রার, লন্ডনে সেই ৪০০ মিটার মিডলেই তাকে ‘সাধারণ’ বানিয়ে ছেড়েছিল। বিজয়মঞ্চে দাঁড়িয়ে লোকটির বোধ হয় একটু অদ্ভুতই লাগছিল। ডানে কিংবা বাঁয়ে, কোনো পাশেই যে ফেলপস নেই!
প্রথম প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০১২। প্রথম আলো
‘অনেকে ফেলপসকে অতিমানব মনে করে। তবে ও তো আমাদের মতোই একজন।’
রায়ান লোকটির আর মুখে এ কথা বলার প্রয়োজন ছিল না। মাইকেল ফেলপসও যে রক্তমাংসেরই মানুষ, একটু আগে পুলেই তো তা প্রমাণ করে দিয়েছেন।
‘অতিমানব’ ভাবার কারণ ছিল। পুলে নামবেন আর সোনা জিতবেন—এটাই যে ‘নিয়ম’ বানিয়ে ফেলেছিলেন ফেলপস। আট বছর আগে এথেন্সে ৬টি সোনা জিতেছিলেন, চার বছর আগে বেইজিংয়ে ৮টি। এক অলিম্পিকে সবচেয়ে বেশি সোনা জয়ের এই রেকর্ড আদৌ কোনো দিন ভাঙবে কি না, বড় প্রশ্ন আছে এটা নিয়েই।
বেইজিংয়ে যে ইভেন্টে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে সোনা জিতে শুরু হয়েছিল ফেলপসের অবিশ্বাস্য জয়যাত্রার, গত পরশু সেই ৪০০ মিটার মিডলেই তাঁকে ‘সাধারণ’ বানিয়ে ছাড়ল। বিজয়মঞ্চে দাঁড়িয়ে লোকটির একটু অদ্ভুতই লাগছিল। পাশে যে ফেলপস নেই!
জিতলে টানা তিনটি অলিম্পিকে একই ইভেন্টে সোনাজয়ী প্রথম পুরুষ সাঁতারু হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখা হয়ে যেত। সোনা দূরে থাক, রুপা-ব্রোঞ্জও জুটল না। লোকটির চেয়ে প্রায় ৪ সেকেন্ড পরে সাঁতার শেষ করে ফেলপস হয়েছেন চতুর্থ। অলিম্পিকে পুলে নেমে পদকহীন থাকলেন মাত্র দ্বিতীয়বার। সর্বশেষ এই অভিজ্ঞতা ১২ বছর আগে সিডনিতে। ২০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে পঞ্চম হয়েছিলেন সেবার।
ফেলপস-লোকটি দ্বৈরথের কারণে এই অলিম্পিকে সাঁতারের সোনা নির্ধারণী প্রথম ইভেন্টটি নিয়ে তুমুল আগ্রহ ছিল সবার। কিসের দ্বৈরথ? লোকটি আর ফেলপসের মাঝখানে ঢুকে গেলেন ব্রাজিলের থিয়াগো পেরেইরা ও জাপানের কোসুকে হাগিনো। নাতি-নাতনিদের কাছে গল্প করার রসদও পেয়ে গেলেন তাঁরা—‘জানিস্, আমি ফেলপসকে হারিয়েছিলাম!’
এই কীর্তি তো খুব বেশি সাঁতারুর নেই। লোকটি এই জায়গাতেও অনন্য হয়ে গেলেন। এই অলিম্পিকের আগে সাঁতারের তিন মোক্ষধাম অলিম্পিক, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ও প্যান প্যাসিফিকে ফেলপসতে দুবার হারাতে পেরেছেন মাত্র তিনজন। তিনজনই যুক্তরাষ্ট্রের—টম মালচো, ইয়ান ক্রকার ও রায়ান লোকটি। ফেলপসকে তিনবার হারানোর একমাত্র কীর্তিটি লোকটির কাছে সোনার চেয়েও কম দামি মনে হওয়ার কথা নয়।
ইঙ্গিতটা অবশ্য হিটেই পাওয়া গিয়েছিল। কোনোমতে অষ্টম হয়ে ফাইনালে উঠেছেন ফেলপস। আর লোকটি তো ফেলপসের অপরাজেয় ভাবমূর্তিতে কালি ছিটাতে শুরু করেছেন ২০১০ প্যান প্যাসিফিক সাঁতার থেকেই। গত বছর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেও ২০০ মিটার মিডলে ও ২০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে হারিয়েছেন ফেলপসকে। মার্কিন অলিম্পিক ট্রায়ালে হারিয়েছেন ৪০০ মিটার মিডলেতে।
তার পরও ফেলপস বলে কথা! অলিম্পিক-সোনা কীভাবে জিততে হয়, সেটি তাঁর চেয়ে ভালো যে আর কেউ জানে না। অলিম্পিক ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সোনাজয়ী তাঁর চেয়ে ৫টি সোনা কম জিতেছেন। লন্ডনে আসার পর থেকে লোকটিকেও তাই ফেলপস নিয়েই বেশি কথা বলতে হচ্ছিল। ৪০০ মিটার মিডলের আগে ফেলপস-ফেলপস শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমার কাছে মাইকেল শুধুই আরেকজন সাঁতারু। আরও অনেকে আছে, যাদের নিয়ে ভাবতে হবে।’
পুলে দুজনের লড়াইয়ের ইতিহাস আট বছরের পুরোনো। যেটিকে লোকটি বলছেন ‘সাঁতারে সর্বকালের সেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা’। বেশির ভাগ সময় দ্বিতীয় সেরা হয়েই থাকতে হয়েছে লোকটিকে। সব আলো কেড়ে নিয়েছেন ফেলপস। এই অলিম্পিকে এসেও যুক্তরাষ্ট্রের বাকি সব সাঁতারু একসঙ্গে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। কোচ বব বাওম্যানকে নিয়ে ফেলপস করেছেন আলাদা। লোকটির ওই ‘ফেলপস আর দশজনের মতোই’ মন্তব্য দুজনের সম্পর্ক নিয়ে ফিসফাসটাকে আরও জোরালো করে তুলেছে। ফেলপসের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্রচুর প্রশ্নও করা হচ্ছে লোকটিকে। লোকটি দাবি করছেন, পুলে যতই প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকুক, পুল থেকে ওঠার পর তাঁরা বন্ধু। ফেলপসের আলাদা সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কেও দিয়েছেন কূটনৈতিক উত্তর, ‘ফেলপস যখন আমাদের সঙ্গে থাকে, ওদেরই একজন। তবে প্রচারটা ও বেশিই পায়। এথেন্স ও বেইজিংয়ে যা করেছে, তাতে তা স্বাভাবিকও।’
৪০০ মিটার মিডলে জেতার পর ফেলপসের কাছ থেকে অভিনন্দন পাওয়ার কথাও জানিয়েছেন লোকটি, ‘আমার বিশ্বাস, ও আমার জন্য গর্বিত। তবে একই সঙ্গে আপসেট তো অবশ্যই।’ সেটি গোপন করেননি ফেলপস। মিক্সড জোনে তাঁর প্রতিক্রিয়ায় ‘হতাশাজনক’ কথাটা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। ফেলপসের কোচ বাওম্যানের প্রতিক্রিয়াটা খুব সংক্ষিপ্ত, ‘আই অ্যাম সারপ্রাইজড। নট প্লিজেন্টলি।’
ফেলপসের এমনই একটা অপরাজেয় ভাবমূর্তি দাঁড়িয়ে গেছে, একটা ইভেন্টে হারার পরই ‘ফেলপস-যুগ’ শেষ বলে রব উঠে গেছে। লোকটি অবশ্য তাতে সুর মেলাচ্ছেন না, ‘আমি বলে দিচ্ছি, পরের ইভেন্টে ও ঠিকই জ্বলে উঠবে।’ ফেলপসের পরের ইভেন্ট আজই, ২০০ মিটার বাটারফ্লাই। যেটিতে ২০১১-এর আগে প্রায় এক দশক অপরাজেয় ছিলেন। লোকটির সঙ্গে আবার দেখা হতে হতে অবশ্য আগামী বৃহস্পতিবার ২০০ মিটার ব্যক্তিগত মিডলে। সেটি ঘিরে আগ্রহটা এখন আরও তুঙ্গে।
ফেলপসকে নিয়ে সবার আগ্রহটাও। ব্যর্থতার সঙ্গে প্রায় পরিচয়হীন সর্বকালের সেরা সাঁতারু কি আর বিনা যুদ্ধে ছেড়ে দেবেন সাম্রাজ্য!