ভলিবলে ওই দুজনের অন্য লড়াই
২০১২ লন্ডন অলিম্পিক
উৎপল শুভ্র
২১ জুলাই ২০২১
লন্ডন অলিম্পিকের ভলিবলে অংশ নেওয়া ১২ দলের ৬টিই নাকি স্বর্ণ জেতার দাবিদার ছিল। এর মধ্যে ব্রাজিল-যুক্তরাষ্ট্রের কথাই উচ্চারিত হচ্ছিল জোরেশোরে। দুই দলের অন্তরালে যে লড়াইটা দুই অধিনায়কেরও ছিল।
প্রথম প্রকাশ: ৪ আগস্ট ২০১২। প্রথম আলো
মিক্সড জোনে লিয়ান্দ্রো ভিসোত্তোর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ঘাড় ব্যথা হয়ে যায়! ৬ ফুট ১১ ইঞ্চি লম্বা। যেন তালগাছ দুই পায়ে দাঁড়িয়ে।
ভিসোত্তোকেই যদি এমন বলেন, তাহলে দিমিত্রি মুসারস্কিকে কী বলবেন? ওনার উচ্চতা মাত্র ৭ ফুট ২ ইঞ্চি!
মজাটা হলো, পরশু রাতে ব্রাজিল-যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচের পর ব্রাজিলিয়ান ভিসোত্তোকে যেমন আকাশছোঁয়া মনে হলো, গত মঙ্গলবার রাতে তা লাগেনি। তাঁর পাশেই যে তখন মুসারস্কি দাঁড়িয়ে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব আরকি!
অলিম্পিক ভলিবলে আপনি এমন প্রচুর ‘তালগাছ’ দেখতে পাবেন। চারটি দলে ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি বা তার বেশি উচ্চতার পাঁচের বেশি খেলোয়াড় আছে। এই চারটি দলই যে র্যাঙ্কিংয়ে সেরা পাঁচের মধ্যে আছে, এটা শুধুই একটা প্রাসঙ্গিক তথ্য। থাকারই কথা, ভলিবলে উচ্চতাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গুরুত্বপূর্ণ, তবে শেষ কথা অবশ্যই নয়। সেটিই হলে গিলবার্তো ফিলহো সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচিত হতেন না। ব্রাজিল ভলিবল দলের অধিনায়ক ‘গিবা’ নামেই বেশি পরিচিত। উচ্চতা মাত্র ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি। ব্রাজিলে ফুটবলের পরই সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ভলিবল আর গিবা সেই খেলার সবচেয়ে বড় তারকা। ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিকের মতে, এ মুহূর্তে ফুটবলার নেইমার আর ফ্রি-স্টাইল সাঁতারু সিয়েলো সিজারই শুধু জনপ্রিয়তায় গিবার চেয়ে এগিয়ে।
পরশু রাতে গিবার মনটা খুব খারাপ ছিল। মিক্সড জোনে বাকি খেলোয়াড়েরা যেখানে ডাকলেই কথা বলছিলেন, তিনি একটু দাঁড়ালেন কি দাঁড়ালেন না। লন্ডনে এসেই বলেছেন, যেভাবেই হোক অলিম্পিক সোনাটা ফিরে পেতে চান। সেই সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তবে গ্রুপ পর্বে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হেরে যাওয়াটা মানসিকভাবে বড় একটা ধাক্কাই। প্রথম সেটটা ব্রাজিলই জিতেছিল, কিন্তু হেরে গেল পরের তিন সেটেই।
বেইজিং অলিম্পিক ফাইনালের রি-ম্যাচ। সেই ফাইনালে যুক্তরাষ্ট্রই জিতেছিল। এথেন্সের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে হারিয়ে। গিবা সোনা ফিরে পাওয়ার কথা বলছেন এ কারণেই। বেইজিংয়ে পুরুষদের মতো মহিলা ভলিবলেও ফাইনাল ছিল যুক্তরাষ্ট্র-ব্রাজিল। অলিম্পিক এর আগে একবারই দেখেছে এমন। ১৯৬৮ মেক্সিকোতে দুটি ফাইনালই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন-জাপান।
ফুটবলের ব্রাজিলের মতো ভলিবলের ব্রাজিলেরও একটা রেকর্ড আছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের সব চূড়ান্ত পর্বে খেলেছে শুধুই ব্রাজিল। অলিম্পিক ভলিবলেও তা-ই। অলিম্পিকে ভলিবল অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৬৪ টোকিওতে। সেই থেকে শুরু করে ব্রাজিলের ছেলেদের এটি টানা ১৩তম অলিম্পিক। এবার ফাইনালে উঠতে পারলে আরেকটি রেকর্ডও হবে। অলিম্পিক ভলিবলে কোনো দলের টানা তিনটি ফাইনাল খেলার ঘটনা যে এর আগে ঘটেনি।
অলিম্পিক ভলিবলে ১২টি দেশ, এর মধ্যে ৬টিই নাকি ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে আছে। ব্রাজিল অলিম্পিক শিরোপা হারালেও বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। র্যাঙ্কিংয়েও এক নম্বর। যুক্তরাষ্ট্রকে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ধরলে এরপরই আছে পোল্যান্ড। ১৯৭৬ অলিম্পিকে সোনাজয়ীরা অনেক দিন পর আবার ফিরে এসেছে প্রবল প্রতাপে। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য র্যাঙ্কিংয়ে ৫ নম্বরে। পোল্যান্ড তিন, রাশিয়া দুই। গত মঙ্গলবার রাতে এক আর দুইয়ের লড়াইয়ে ব্রাজিল জিতেছে সরাসরি সেটে। এরপর হেরে গেল পাঁচের কাছে। র্যাঙ্কিঙ দিয়ে যে অলিম্পিক পদক নির্ধারিত হবে না, এ তো জানা কথাই।
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হেরে যাওয়াটা গিলবার্তো ফিলহো গিবার মনে খুব লাগার আরেকটা কারণ আছে। দলীয় লড়াইয়ের মধ্যে একটা ব্যক্তিগত লড়াই-ও ছিল, সেটিতেও যে হেরেছেন। দুই অধিনায়কের লড়াই। যেটিতে জয়-পরাজয়ের তাৎপর্য শুধুই এই একটা ম্যাচে সীমাবদ্ধ নয়। দুজনই যে লড়ছেন ইতিহাস হতে। অলিম্পিক ইতিহাসে কেউ দুবার ‘মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার’-এর স্বীকৃতি পায়নি। ফিলহোর মতো এবার সেই সুযোগ আছে যুক্তরাষ্ট্রের অধিনায়ক ক্লেটন স্ট্যানলিরও। ফিলহো ২০০৪ এথেন্সের সেরা, স্ট্যানলি ২০০৮ বেইজিংয়ের।
‘যুক্তরাষ্ট্র, না ব্রাজিল’ প্রশ্নটা তাই ‘ফিলহো, না স্ট্যানলি’র সমার্থকই হয়ে যাচ্ছে।