ব্রিটেনে শুধুই ‘সোনালি ডাকবাক্স’

২০১২ লন্ডন অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

ব্রিটেনে শুধুই ‘সোনালি ডাকবাক্স’

স্বর্ণজয়ীদের সম্মানে এমনই সোনালি ডাকবাক্সর ব্যবস্থা করেছিল রয়্যাল মেইল কর্তৃপক্ষ। ছবি: ফ্লিকর

আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল, লন্ডন অলিম্পিকে কোনো ব্রিটিশ অ্যাথলেট স্বর্ণ জিতলেই তাঁকে নিয়ে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করা হবে। তবে ৪ আগস্ট দিনটি রয়্যাল মেইলের কর্তাদের বিপাকেই ফেলে দিয়েছিল। এক দিনে যে ছয়-ছয়জন ব্রিটিশ অ্যাথলেট সোনা জিতেছিলেন! ১৯০৮ অলিম্পিকের পর এক দিনে এর চেয়ে বেশি স্বর্ণ গ্রেট ব্রিটেন পায়নি কখনো।

প্রথম প্রকাশ: ৯ আগস্ট ২০১২। প্রথম আলো

লন্ডন অলিম্পিক এমন মধুর যন্ত্রণায় ফেলবে, রয়্যাল মেইলের কর্তাব্যক্তিরা তা কল্পনাও করেননি। অলিম্পিক শুরুর আগেই ঘোষণা ছিল, গ্রেট ব্রিটেনের কোনো অ্যাথলেট সোনা জিতলে সেদিনই তাঁকে নিয়ে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করা হবে। পরদিন ৫০০টি পোস্ট অফিসে তা চলে যাবে বিক্রির জন্য। সোনাজয়ীর শহরের একটি পোস্ট বক্সকে রাঙানো হবে সোনালি রঙে। 

রয়্যাল মেইলের ইতিহাসে সবচেয়ে কর্মব্যস্ত দিন কেটেছে গত শনিবার। এক দিনে ৬টি সোনা জিতেছে গ্রেট ব্রিটেন। এক দিনে ছয়টি স্মারক ডাকটিকিট! ‘সুপার স্যাটারডে’ কথাটাও ঢুকে গেছে ব্রিটেনের ক্রীড়া অভিধানে। অলিম্পিক ইতিহাসে এর চেয়ে বেশি স্বর্ণপ্রসবা দিন খুঁজতে যে ব্রিটিশদের ১০৪ বছর পেছনে ফিরে যেতে হয়।

গত পরশু মঙ্গলবার দিনটির আবার অন্য তাৎপর্য। শনিবারের চেয়ে সোনা দুটি কম, কিন্তু এ দিনটি ভাসিয়ে দিল স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার আনন্দ। এই ‘টুয়েসডে’কে তাই কী নাম দেওয়া যায়, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে।

লন্ডন অলিম্পিকের আগে ঘোষিত লক্ষ্য ছিল বেইজিংয়ের পুনরাবৃত্তি। মোট ৪৭টি পদক, যার ১৯টিই সোনা—বেইজিং অলিম্পিকের সাফল্যে ব্রিটিশরাই চমকে গিয়েছিল সবচেয়ে বেশি। সবকিছুরই একটা নাম দেওয়ার অভ্যাস আছে এদের। বেইজিং-সাফল্যের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘দ্য গ্রেট হল অব চায়না’।

গেমসের পাঁচ দিন বাকি থাকতেই সেই ‘গ্রেট হল’ পেছনে পড়ে গেল। মোট পদক একটি বেশি, সোনা বেশি ৩টি। এমনিতেই খেলাপাগল জাতি। গ্রিস অলিম্পিকের জন্ম দিতে পারে, কিন্তু আধুনিক খেলার ইতিহাস ব্রিটিশদের মতো আর কোনো জাতির অবদানে এতটা ভাস্বর নয়। ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন...এমন আরও কত খেলার জন্মই তো দিয়েছে ওরা। খেলা নিয়ে মাতামাতির জন্য কোনো পদক থাকলে সেটি ব্রিটেনই সবচেয়ে বেশি জিতত। স্বভূমে এই সাফল্যের পর অলিম্পিক নিয়ে ব্রিটিশদের উন্মাদনাটা স্বাভাবিকভাবেই চরমে পৌঁছেছে। 

কিছু ‘সমস্যা’ও দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়, ক্রিস হয়কে নতুন কী খেতাব দেওয়া যায়! বেইজিংয়ে তিনটি সোনা জেতার পর নাইটহুড দেওয়া হয়েছে। এথেন্সেও একটি সোনা ছিল। স্যার ক্রিস হয় গত পরশু আরেকটি সোনা জিতে পরিণত হয়েছেন ব্রিটেনের সফলতম অলিম্পিয়ানে। নিজে অবশ্য এখনো স্যার স্টিভ রেডগ্রেভকেই ‘গ্রেটেস্ট’ বলছেন। এখানে রোয়িংয়ে টানা পাঁচটি অলিম্পিকে সোনাজয়ী রেডগ্রেভকে এক নম্বরে রেখে তার পর কথা বলাই নিয়ম।

লন্ডন অলিম্পিকে এই সাফল্যের দীর্ঘমেয়াদি তাৎপর্যও দেখছেন ক্রিস হয়, ‘আমরা ব্রিটিশরা এত দিন ধরেই নিতাম, আমরা গলা ফাটিয়ে সমর্থন করব, কিন্তু ব্রিটেন পারবে না। বিশ্বকাপ ফুটবল আমাদের দুঃখ দেবে, কখনো সেই দুঃখের নাম হবে পেনাল্টি শ্যুটআউট। আমাদের ক্রীড়া মানসিকতাটা এবার বদলাবে।’

ছবি: গ্রেট ব্রিটেন

গ্রেট ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় চমকটা ক্রিস হয়ের খেলা সাইক্লিংয়েই। সাইক্লিংয়ের ১০টি সোনার ৭টিই জিতেছে ব্রিটেন। বেইজিং আর লন্ডন মিলিয়ে সাইক্লিংয়ে মোট ১৪টি সোনা, অন্য কোনো দেশের একটির বেশি নেই। এটা সবচেয়ে বেশি বুকে লেগেছে ফ্রান্সের। সাইক্লিংটা বলতে গেলে তাদের জাতীয় খেলা, আর সেটিতে ব্রিটিশদের হাতে এমন অপদস্থ হওয়া! শুধু তো এই অলিম্পিকে নয়, কিছুদিন আগে নিজেদের দেশেও দেখতে হয়েছে ব্রিটিশ উল্লাস। প্রথম ব্রিটিশ হিসেবে গত ট্যুর ডি ফ্রান্স জিতেছেন ব্র্যাডলি উইগিনস। ফরাসিরা তাই ব্রিটিশদের এই সাফল্যের রহস্য খুঁজে খুঁজে হয়রান।

তা করতে গিয়ে মজার একটা ঘটনাও ঘটেছে। ব্রিটিশরা নাকি রেস শেষ হওয়ার পর ভেলোড্রামে তাদের সাইকেলগুলো লুকিয়ে রাখে। ফরাসি সাইক্লিস্টদের মনে এ নিয়ে ঘোর সন্দেহ। ব্রিটিশ সাইক্লিং দলের প্রধান কোচ ডেভিড ব্রেইলসফোর্ড এর মধ্যে ফরাসি এক পত্রিকাকে বললেন, ‘আমাদের সাইকেলের চাকাগুলো বিশেষভাবে গোল (স্পেশালি রাউন্ড)।’ এরপর থেকেই সাইকেলের চাকা কীভাবে ‘আরও গোল’ করা যায়, তা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়ে যায় ফ্রান্সে। ব্রেইলসফোর্ড তো হেসেই খুন, ‘আমি তো রসিকতা করে ও কথা বলেছিলাম। সাইকেলের চাকা তো গোলই, এটা আর বিশেষভাবে কী গোল হবে!’ ফরাসিদের এমন বোকা বানাতে পারাটাকে এই অলিম্পিকে বাড়তি একটা ‘পদক’ হিসেবেই দেখছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম!

বেইজিংয়ে পদক তালিকায় চতুর্থ হয়েছিল ব্রিটেন। এখানে শুধু চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পর, সেখানেই শেষ করার সম্ভাবনা যথেষ্টই উজ্জ্বল। লন্ডনে অনুষ্ঠিত তিন অলিম্পিকের প্রথমটির সাফল্য অবশ্য তাতে অম্লানই থাকবে। ১৯০৮ সালের সেই অলিম্পিকে ৫৬টি সোনা ও মোট ১৪৬টি পদক নিয়ে শীর্ষে ছিল ব্রিটেন। তবে তখন কি আর অলিম্পিক এমন ছিল! মোটর বোটিং, ডিয়ার হান্টিং, টাগ অব ওয়ার (রশি টানাটানি আর কি!) এমন বিচিত্র সব খেলা ছিল। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, মোট ২০২৩ জন অ্যাথলেটের ৬৭৬ জনই ছিল ব্রিটেনের।

আরেকটা বড় পার্থক্যও আছে। তখন এমন সোনার দামেই সোনার পদক কিনতে হতো না। লন্ডন অলিম্পিক সামনে রেখে গত চার বছরে টিম জিবির (গ্রেট ব্রিটেনের অলিম্পিক দলের এটাই নাম) জন্য অবকাঠামো ও প্রশিক্ষণ খাতে কত ব্যয় হয়েছে জানেন? মাত্র ২৬৪ মিলিয়ন পাউন্ড!

সোনার দামে সোনার পদক লিখেছিলাম, আসলে তা সোনার চেয়ে অনেক অনেক বেশি দামি!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×