আজ ভাঙছে মিলনমেলা

২০১২ লন্ডন অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

আজ ভাঙছে মিলনমেলা

ছবি: গেটি ইমেজেস

অলিম্পিকের সায়াহ্নে এই প্রশ্নটা খুবই স্বাভাবিক, 'এবারের আসর কি ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে আগের আসরগুলোকে?' লন্ডন অলিম্পিকেও এই প্রশ্ন উঠেছিল। আইওসির তখনকার সভাপতি প্রশ্নের উত্তরটা দিয়েছিলেন খুব সুন্দর, 'আধুনিক খেলাধুলার জন্ম যে দেশে, তারাই ফেয়ার প্লে ও প্রতিযোগিতার চেতনাকে নবজন্ম দিয়েছে।'

প্রথম প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০১২। প্রথম আলো

সমাপনী বক্তৃতায় জ্যাক রগ কী বলবেন, এখনই তা অনুমান করা যাচ্ছে। অমনই যে বলার ‘নিয়ম’! গেমসের শেষ দিনে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করবেন ‘এটিই ইতিহাসের সেরা গেমস’, এটা শুনতে অভ্যস্তই হয়ে গেছে সবাই।

সব সময় যে বলার জন্যই বলা হয়, তা কিন্তু নয়। গেমসে রেকর্ডের পর রেকর্ড ভেঙে যায়, আয়োজনের দিক থেকেও তো আগের সবকিছুকে ছাড়িয়ে যাওয়ার তাড়না থাকে। ইতিহাসের সেরা গেমসের মুকুট তাই চার বছর পরপর মাথা (নাকি শহর) বদল করতেই পারে!

এবারও কি তা করল? লন্ডন কি ছাড়িয়ে যেতে পারল সিডনি-এথেন্স-বেইজিংকে? গেমসের শেষ দিনে এই হিসাব-নিকাশ তো হবেই। জ্যাক রগ অবশ্য এরই মধ্যে তাঁর মুগ্ধতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। ইংল্যান্ডের এক পত্রিকাকে বলেছেন, ‘আধুনিক খেলাধুলার জন্ম যে দেশে, তারাই ফেয়ার প্লে ও প্রতিযোগিতার চেতনাকে নবজন্ম দিয়েছে।’ পরের কথাটা খুব সুন্দর, ‘দুই সপ্তাহ অলিম্পিক পার্ক এই বিশ্বের হৃদস্পন্দন হয়ে ছিল।’

সেই হৃদস্পন্দন থেমে যাচ্ছে আজ। নিভে যাচ্ছে অনির্বাণ অলিম্পিক চেতনার প্রতীক ওই মশালও। ২৭ জুলাই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ওই মশাল জ্বালানো হয়েছিল ঠিক মাঠের মাঝখানে। প্রযুক্তি এখন এমন জাদুমন্ত্রের মতো হয়ে গেছে, পরদিনই আবার তা সরে এসেছে অলিম্পিক স্টেডিয়ামের এক পাশে। আজ সমাপনী অনুষ্ঠানে নেভার আগে সেটি আবার মধ্যমণি হয়ে যায় কি না কে জানে!

অলিম্পিকের সমাপনী অনুষ্ঠানে। ছবি: গেটি ইমেজেস

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মতো সমাপনী অনুষ্ঠান নিয়েও স্বাভাবিকভাবেই চরম গোপনীয়তা। তবে টুকটাক কিছু যে জানা যাচ্ছে না, তা নয়। পত্রিকায় ছবি মহড়ার ছবি ছাপা হয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত, ব্রিটেনের বিখ্যাত সেই ট্যাক্সির ওপর দাঁড়িয়ে গান গাইছেন স্পাইস গার্লরা। সমাপনী অনুষ্ঠান নাকি মূলত ব্রিটিশ মিউজিকের একটা উদযাপনই হবে। জর্জ মাইকেল থাকবেন বড় আকর্ষণ হয়ে। ২০১৬ অলিম্পিকের আয়োজক রিও ডি জেনিরোর হাতে পতাকা তুলে দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতার জন্যও বরাদ্দ থাকবে কিছুটা সময়।

অলিম্পিক শেষ হওয়ার ঠিক আগের দিনটিতেই সবচেয়ে বেশি পদকের হাতছানি থাকে। গতকাল নিষ্পত্তি হয়েছে ৩২টি সোনার। তবে তাতেও পদক তালিকার প্রথম তিনটি নামের পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ছিল না বললেই চলে। শীর্ষস্থান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের লড়াইটা প্রত্যাশিতই ছিল। বিস্ময় বললে গ্রেট ব্রিটেন। বেইজিংয়ের পুনরাবৃত্তি করতে পারলেই যেখানে খুশি, সেখানে বেইজিংকে অনেক পেছনে ফেলে সগৌরবে তিন নম্বরে। ১৯৯৬ আটলান্টা অলিম্পিকে এই গ্রেট ব্রিটেনই মাত্র একটি সোনা জিতেছিল। ওটাই হয়তো শাপেবর হয়েছে। আটলান্টা-ব্যর্থতার পরই টাকা ঢালা শুরু হয়েছে অলিম্পিকের খেলাগুলোয়।

পদক তালিকায় যা দৃশ্যমান, তার সঙ্গে অদৃশ্য আরেকটি সোনার পদকও বোধ হয় গ্রেট ব্রিটেনের প্রাপ্য। অলিম্পিকটা শহরকেন্দ্রিক হয় বলে সেটি অবশ্য লন্ডনকেই দেওয়া উচিত। দুই সপ্তাহ অলিম্পিক পার্কের বিশ্বের হৃদস্পন্দন হয়ে থাকার যে কথাটা বলেছেন জ্যাক রগ, সেটি আসলেই সত্যি। জায়গাটা যেন সব সময় গমগম করেছে। অলিম্পিক সব সময়ই উত্সবের নাম, কিন্তু সেই উৎবের রংটা এবার যেন একটু বেশিই রঙিন ছিল। আয়োজক কমিটির প্রধান সেবাস্টিয়ান কো খুব সুন্দর বলেছেন, ‘গেমস লন্ডনকে আলিঙ্গনে জড়িয়েছে, লন্ডনও গেমসকে।’

অলিম্পিকের শুরুতে বিভিন্ন ভেন্যুতে খালি আসন নিয়ে এত যে হইচই হলো, সেটিকে গুরুত্ব দেবেন না। ওসব আসন ছিল বিভিন্ন দেশের জাতীয় অলিম্পিক কমিটির কর্মকর্তা বা সংবাদমাধ্যমের জন্য সংরক্ষিত। নইলে টিকিটের জন্য কাড়াকাড়ি অলিম্পিকের আগেও ছিল, অলিম্পিক চলার সময়ও। শেষ দুই দিনের জন্য কিছু টিকিট ছাড়া হয়েছিল, এর জন্য সারা রাত লাইনে দাঁড়িয়েও রাত কেটেছে অসংখ্য মানুষের।

অলিম্পিকের চেতনা পুরোপুরিই সমুন্নত ছিল লন্ডনে। ছবি: গেটি ইমেজেস

সকালে অ্যাথলেটিকসের হিটের সময় অলিম্পিক স্টেডিয়াম সাধারণত একটু ফাঁকাই থাকে। আর এখানে হিটের সময়ও ৮০ হাজার দর্শক! সেই দর্শকদের চিন্তাভাবনাও মুগ্ধ করার মতো। ব্রিটিশ অ্যাথলেটরা স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে বেশি সমর্থন পেয়েছেন। তবে অন্য দেশের অ্যাথলেটরাও কম নয়। সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো ছিল, পিস্টোরিয়াস-সেমেনিয়ার মতো একটু ‘ব্যতিক্রমী’ অ্যাথলেটদের জন্য তুমুল সমর্থন। এঁদের লড়াইটা যে খেলার সীমানা ছাড়িয়ে অন্য মাত্রা পেয়েছে, দর্শকদের এই বোধটা আছে বলেই তো এমন হয়েছে।

এই গেমসকে এমন ঝলমলে করে তোলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি অবশ্য কোনো মানুষের হাতে ছিল না। এই রোদ-এই বৃষ্টির কুখ্যাত ইংলিশ আবহাওয়াও যেন বুঝতে পেরেছিল অলিম্পিকের মাহাত্ম্য। দু-এক দিন যা একটু বৃষ্টি হয়েছে, তা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। বেশির ভাগ দিনই সোনালি রোদে ভেসেছে চারপাশ, তাপমাত্রা মধ্য-বিশেই ঘোরাফেরা করেছে। 

আজ সমাপনী অনুষ্ঠানে নাকি বৃষ্টি হওয়ার ভালোই সম্ভাবনা আছে। তা একটু হলোই না হয়! বিশ্বমানবের এই মিলনমেলা ভেঙে যাওয়ার দিনে একটু কাঁদতেই পারে আকাশ!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×