মারাকানার শব্দকল্লোলে
রিও ২০১৬ অলিম্পিকের দিন–রাত
উৎপল শুভ্র
২০ জুলাই ২০২১
৭-১ গোলের পরাজয়ের পর ব্রাজিলিয়ান সমাজে এটা অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমই হয়ে গেছে। কারও একটু মুখ গোমড়া দেখলেই নাকি বলা হয়, 'কী রে, মুখটা অমন ৭-১ এর মতো করে রেখেছিস কেন?' ২০১৬ রিও অলিম্পিকে ফুটবলের ফাইনালে মারাকানার গগনবিদারী চিৎকার শুনতে শুনতে উৎপল শুভ্র পেয়েছেন একটা নতুন উপমা, 'এ তো দেখছি ২০ আগস্টের মারাকানা।'
প্রথম প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো
গগনবিদারী আওয়াজ মানে কী? যে আওয়াজে আকাশেও চিড় ধরে, তাই তো! আসলে তো আর ধরে না। উপমা আরকি! অনেক লেখায় যা ব্যবহারও করেছি। এখন বুঝতে পারছি, সেসব বেশি বলা হয়ে গেছে!
‘গগনবিদারী আওয়াজ’ বলতে আসলে কী বোঝায়, সেটি জানিয়ে দিল ফুটবল ফাইনালের মারাকানা। এমন ভাবেই যে, ভবিষ্যতে কথাটা ব্যবহার করার আগে দুবার ভাবব।
ফুটবল ম্যাচের আবহ এমনিতেই শব্দমুখর। সারাক্ষণই সমর্থকদের গান, হইচই, চিৎকার-চেঁচামেচি। দুটি বিশ্বকাপ কাভার করেছি বলে এর সঙ্গে ভালোই পরিচয় আছে। তবে পরশু মারাকানায় যে অভিজ্ঞতা হলো, সেটির কোনো তুলনা নেই। ৮০ হাজার দর্শক প্রায় পাঁচ ঘণ্টা যে আওয়াজ তুলে গেলেন, মনে হলো যেন শব্দের জলপ্রপাতে বসে আছি!
ম্যাচ হয়েছে পৌনে তিন ঘণ্টার মতো। তবে ম্যাচের আগে-পরের সময়টা মিলিয়ে প্রেস ট্রিবিউনে পাঁচ ঘণ্টা তো ছিলামই। পুরোটা সময় একটা ঘোরের মধ্যে কাটল। কোনো স্টেডিয়ামে এমন আওয়াজও উঠতে পারে!
স্টেডিয়ামের নাম মারাকানা, এলাকাটার নামও। পাতালরেলের স্টেশনটার নামও তা-ই। পরশু বিকেলে সেটিতে নামতেই হারিয়ে গেলাম হলুদ জনস্রোতে। গান গাইতে গাইতে সব চলেছেন স্টেডিয়ামে। একসময় ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে অন্য গান ছিল। তবে ২০১৪ বিশ্বকাপ থেকে গান একটাই। যেটি বাংলা করলে এমন হয়—
এক হাজার গোল
এক হাজার গোল
শুধুই পেলে
শুধুই পেলে
ম্যারাডোনা তো কোকেন টানে।
এই ম্যাচে পেলে-ম্যারাডোনাকে নিয়ে টানাটানি কেন? প্রতিপক্ষ তো আর্জেন্টিনা নয়। ব্রাজিলিয়ানদের আনন্দে ভাসিয়ে তারা তো এই অলিম্পিকে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিয়েছে। কারণটা জানতে ফিরে যেতে হবে সেই ২০১৪ বিশ্বকাপে। ওই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের শহর থেকে শহরে দাপিয়ে বেড়িয়েছে হাজার হাজার আর্জেন্টাইন সমর্থক। নিজেদের দলকে উৎসাহ দেওয়ার চেয়ে ব্রাজিলিয়ানদের উত্ত্যক্ত করাটাকেই যারা জীবনের মহান ব্রত বলে ঠিক করে নিয়েছিল। সেই উত্ত্যক্ত করার ভাষা সর্বজনীন করতে বেঁধে নিয়ে এসেছিল একটা গানও। সেটি ছিল এ রকম—
ব্রাজিল আমাকে বলো নিজের ঘরে
এমন নতজানু হয়ে থাকতে কেমন লাগছে
অনেক বছর চলে যাওয়ার পরও শপথ করে বলতে পারি
ম্যারাডোনা তোমাদের কেমন বোকা বানিয়েছিল
ক্যানি (ক্যানিজিয়া) কেমন চমকে দিয়েছিল
এখনো আমরা তা ভুলিনি
সেই ইতালি (বিশ্বকাপ ১৯৯০) থেকে শুরু করে
তোমরা এখনো কেঁদেই যাচ্ছ
এবার তোমরা দেখবে মেসিকে
বিশ্বকাপ হবে আমাদের
পেলের চেয়ে ম্যারাডোনা বড়।
ওই গানের জবাব দিতেই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের নতুন ‘অফিশিয়াল সং’-এর জন্ম। প্রতিপক্ষ যে-ই হোক, যেটি গাওয়াটা এখন নিয়ম। ম্যাচ শুরু হওয়ার পরও গ্যালারিকে একটু পরপরই কোরাসে এই গান। ফাঁকে ফাঁকে ‘ব্রাজিল, ব্রাজিল’ চিৎকার। চিৎকার বলে আসলে বোঝানো যাচ্ছে না। গর্জন বললে কাছাকাছি হয়। সমস্বরে ‘ব্রাজিল, ব্রাজিল’ চিৎকারটা এমনিতেই একটা ধাতব ধ্বনির মতো লাগে। ৮০ হাজার দর্শক একসঙ্গে সেই আওয়াজ তুললে কেমন যেন একটা অশরীরী অনুভূতি হয়।
বিশ্বকাপের সময়ও ব্রাজিলের ম্যাচে তা শুনেছি। পার্থক্য হলো, বিশ্বকাপে ব্রাজিল মারাকানায় খেলেনি। ৮০ হাজার দর্শকের সামনেও না। এর চেয়েও বড় পার্থক্য, বিশ্বকাপে অতিথি দলেরও প্রচুর সমর্থক থাকে। গত বিশ্বকাপে ব্রাজিল-চিলি ম্যাচে তো গ্যালারির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই দখলে নিয়ে নিয়েছিল চিলিয়ানরা। আর্জেন্টিনার ম্যাচে অর্ধেকেরও বেশি থাকত আর্জেন্টাইন। এদিনও জার্মানির সাদা জার্সি গায়ে কিছু দর্শক ছিল। তবে হলুদের ভিড়ে তাদের অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজতে হয়। আওয়াজ-টাওয়াজ কিছু তুলে থাকলেও তা হারিয়ে গেছে ব্রাজিলিয়ানদের শব্দকল্লোলে।
এখানেই জার্মান ছেলেগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে। ওয়ার্মআপ শুরু করতে নামার সময় দুয়োধ্বনি শুনতে হয়েছে। মাঠে প্রতিপক্ষ ১১ জনই ছিল, আসলে তো খেলতে হয়েছে ৮০ হাজার ১১ জনের বিপক্ষে! অতিরিক্ত সময়ে জার্মানদের পায়ে বল গেলেই শিসের এমন তীব্র শব্দ উঠেছে যে, একবার কানে পর্যন্ত হাত দিতে হয়েছে। টাইব্রেকারে জার্মানদের শট নেওয়ার সময়ও যা আরও তীক্ষ্ণ। এর মধ্যে বাচ্চা ছেলেগুলো যেভাবে লড়াই করল, তা আসলেই মুগ্ধ হওয়ার মতো। ব্রাজিলিয়ানরা ফুটবল বোঝে। ম্যাচ শেষ হওয়ার পর জার্মানরা তাই ঠিকই অভিবাদন পেল তাদের কাছ থেকে।
এই জার্মানরাই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে সবচেয়ে লজ্জার অধ্যায়টা লিখেছে। প্রেস ট্রিবিউনে আমার পাশে বসে ছিলেন এক ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিক। তাঁর কাছ থেকেই জানলাম, বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ৭-১ গোলের পরাজয় ব্রাজিলিয়ান সমাজে কেমন অনুভূতি প্রকাশের একটা মাধ্যম হয়ে গেছে। কাউকে বিপর্যস্ত দেখলেই নাকি বলা হয়, ‘কী রে, মুখটা অমন ৭-১-এর মতো করে রেখেছিস কেন?’
নতুন একটা কথাও যোগ হবে নাকি এখন? কাউকে আনন্দে ভেসে যেতে দেখলে বলা হবে, ‘কী রে, তুই তো দেখছি মারাকানার মতো খুশি!’
আমি অবশ্য নতুন একটা উপমা পেয়ে গেছি। ভবিষ্যতে কোথাও মানবকণ্ঠের তুমুল গর্জন শুনলে বলব, ‘এ তো দেখছি ২০ আগস্টের মারাকানা!’