শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতেই পারেন বোল্ট

২০১৬ রিও অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২০ জুলাই ২০২১

শ্রেষ্ঠত্বের দাবি  করতেই পারেন বোল্ট

ছবি: গেটি ইমেজেস

বোল্ট অলিম্পিকে নামবেন, দর্শকদের সঙ্গে খুনসুটি করবেন, স্বর্ণ জিতবেন--এটাই তো নিয়ম হয়ে ছিল রিও অলিম্পিক পর্যন্ত। ১০০ মিটারের পর অলিম্পিকে ২০০ মিটার স্প্রিন্টের স্বর্ণও টানা তৃতীয়বারের মতো জিতে বোল্ট তাই প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, 'গ্রেটেস্ট হতে হলে আমাকে আর কী করতে হবে?'

প্রথম প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো

বিশ্ব রেকর্ড হলো না, কিন্তু ইতিহাস হলো ঠিকই। নাকি তাতে শুধু যোগ হলো নতুন অধ্যায়! ইতিহাস? ইতিহাস তো আগেই গড়া হয়ে গেছে উসাইন বোল্টের।

অলিম্পিকে দুবার ‘স্প্রিন্ট ডাবল’-ই তো জিততে পারেননি আর কেউ। বোল্ট যা লন্ডনেই জিতেছেন। ১০০ মিটারের পর ২০০ মিটারও জিতলেন টানা তৃতীয়বার। যে অর্জনের মাহাত্ম্য বুঝতে একটা তথ্যই যথেষ্ট। অলিম্পিকে কেউ দুবারও ২০০ মিটার জিততে পারেননি।

লন্ডনে কিংবদন্তি হতে চেয়েছিলেন। এখানে পেতে চেয়েছিলেন অমরত্ব। সেটি নিশ্চিত করে ফেলার পর ঘোষণা দিলেন, ‘বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছি, আমিই গ্রেটেস্ট।’ কারও মনে যদি কোনো সন্দেহ থেকে থাকে, তাঁদের দিকে ছুড়ে দিলেন প্রশ্ন—‘গ্রেটেস্ট হতে আমাকে আর কী করতে হবে?’

ছবি: গেটি ইমেজেস

নিজেকে ‘গ্রেটেস্ট’ বলে ঘোষণা করাটা কি কারও কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে? উঁকি দিচ্ছে না মোহাম্মদ আলীর মুখ! আরেকটি জাদুকরি দৌড়ের পর উসাইন বোল্ট যেন মোহাম্মদ আলীই। বব মার্লে তাঁকে নিয়ে গান লিখলে সেটির শিরোনাম কী হতে পারে, প্রশ্নে যিনি নির্বিকার মুখে বলে দেন, ‘দ্য গ্রেটেস্ট অব অল টাইম।’ একটু আগেই দাবি করেছেন, ‘আমি মানুষকে খেলা দেখতে টেনে এনেছি। খেলাটাকে আমি নিয়ে গেছি অন্য পর্যায়ে।’

আলীর মুখে এমন কথা খুব মানাত। উসাইন বোল্টের মুখেও মানিয়ে যাচ্ছে। বোল্ট তো ‘আলী’-ই হতে চেয়েছেন। হতে চেয়েছেন ‘পেলে’। গ্রেটেস্টদের কাতারে দাঁড়ানোর সেই স্বপ্ন পূরণের জন্যই এত কষ্ট, এত ঘাম, হয়তো রক্তও। আলস্য তাঁর খুব প্রিয়। সেই ‘অলস’ বোল্ট ট্রেনিংয়ে কখনো কখনো রক্তবমিও নাকি করেছেন। ‘গ্রেটেস্ট’ বলতে বারবারই বলেছেন আলী আর পেলের কথা। তাঁদের পাশে কি এখন লেখা হয়ে গেল তাঁর নামও? বোল্ট এবার ঢুকে পড়ছেন বিনয়ের আবরণে। সেই বিচারের ভার ছেড়ে দিচ্ছেন সংবাদমাধ্যম আর ফ্যানদের ওপর। সঙ্গে সঙ্গেই আবার কৌতুক করে বলছেন, ‘দেখি, আজ আর আগামীকাল আপনারা কী লেখেন!’

কানাডিয়ান তরুণ আন্দ্রে দে গ্রাস চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন সেমিফাইনালে। ফাইনালেও গ্রাসই নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী। সেই ‘নিকটতম’ এমনই যে মুহূর্তের জন্যও বোল্টকে হারিয়ে দেবেন বলে সম্ভাবনা জাগেনি। বোল্টের লড়াই ছিল নিজের সঙ্গেই। দুপাশের লেনের বাকি সাতজন নয়, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল স্টপওয়াচ। নিজের ১৯.১৯ সেকেন্ডের বিশ্ব রেকর্ড।

সেটি ভাঙতে পারেননি। যেতে পারেননি কাছাকাছিও। সময় নিয়েছেন ১৯.৭৮ সেকেন্ড। এ নিয়ে দুঃখ আছে। আছে বুড়িয়ে যাওয়ার উপলব্ধিও, ‘শেষ দিকে পা দুটি আর আমার ডাকে সাড়া দিচ্ছিল না। বয়স হয়েছে না! আমি তো আর এখন ২৬ বছরের নই, ২১ বছরের নই।’

বয়স তো হয়েছেই। এই অলিম্পিকের সমাপনীর দিন যা ত্রিশ হবে। আতশবাজির ছটায় যেন পালিত হবে সর্বকালের সেরা স্প্রিন্টারের জন্মদিন। এত বয়সে এর আগে কেউ অলিম্পিকে ২০০ মিটার জেতেননি। বোল্ট-মহিমা বোঝাতে এমন কিছু তথ্যের পর তথ্য সাজিয়ে গেলেই হয়। অলিম্পিক বা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে একবারের বেশি কেউ ‘স্প্রিন্ট ডাবল’ জিততে পারেননি। বোল্ট জিতেছেন ছয়বার। ২০১১ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ফলস স্টার্ট করে ১০০ মিটারে ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে গিয়েছিলেন। নইলে সেই ২০০৮ বেইজিং থেকে শুরু করে অলিম্পিক বা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে তাঁকে হারাতে পারেনি কেউ।

নিজের সেরা সময়ের ধারেকাছেও না, কিন্তু বাকিরা তো তাঁর ধারেকাছেও না। ছবি: গেটি ইমেজেস

৯.৮০ সেকেন্ডের কম সময়ে সবচেয়ে বেশিবার ১০০ মিটার দৌড়ানোর রেকর্ড তাঁর। তবে প্রিয় ইভেন্ট হিসাবে ২০০ মিটারকেই এগিয়ে রেখেছেন সব সময়। হয়তো এটি দিয়েই বিশ্ব মঞ্চে নিজের আবির্ভাব ঘোষণা করেছিলেন বলে। ২০০২ সালে বিশ্ব জুনিয়র অ্যাথলেটিকসে যখন ২০০ মিটার জেতেন, বোল্টের বয়স তখন মাত্র ১৫। সেই ২০০ মিটারই হয়ে থাকল অলিম্পিকে বোল্টের শেষ একক দৌড়। সমাপ্তিরেখা পেরোনোর পর তাই ছুঁয়ে গেছে একটু আবেগও।

২০০৪ সালে এথেন্সে ২০০ মিটারের হিটেই বাদ পড়ার পর অলিম্পিক থেকে তাঁর সর্বোচ্চ চাওয়া ছিল, ২০০ মিটারের ফাইনালে ওঠা। আর একটি সোনা জিততে পারলে তো ভালোই। সেখানে অলিম্পিকে বোল্টের এখন ৮টি সোনা। গত দুবারের মতো এবারও রিলের সোনাটা যোগ হয়ে সংখ্যাটা ‘৯’ হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা।

কিন্তু শুধু সোনার পদকেই কি বোল্টকে ব্যাখ্যা করা যায়! খেলাটিকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার যে দাবি করেছেন, সেটি পুরোপুরিই সত্যি। মানুষকে খেলা দেখতে টেনে আনার দাবিও। বিশ্বের প্রতিটি কোণে কত কোটি মানুষ সেই দেশের সময়-অসময়ে বোল্টের দৌড় দেখতে টেলিভিশনের সামনে বসে ছিল, সেই হিসাবটা পেলেই যা বোঝা যাবে পরিষ্কার।

সর্বকালের সেরা স্প্রিন্টার, অ্যাথলেটিকসে সর্বকালের সেরা ‘শো ম্যান’ও হয়তো। স্টেডিয়ামে ঢুকেই যিনি বিনি সুতোর মালা গেঁথে ফেলেন দর্শকের সঙ্গে। বোল্ট মানে ডোপ-বিতর্কে জর্জরিত অ্যাথলেটিকসে সত্য আর সুন্দরের জয়গানও। তরুণ প্রজন্মের মনে ছড়িয়ে দেওয়া বিশ্বাস, বাঁকা পথ নয়, প্রতিভা আর পরিশ্রমে ভর করেই সাফল্য পাওয়া সম্ভব। অলিম্পিকের আগে বলেছিলেন, খেলাটির ভালোর জন্যই তাঁকে সফল হতে হবে।

এমনভাবেই তা হয়েছেন যে বোল্ট চলে যাওয়ার পর অ্যাথলেটিকস আর আগের মতো থাকবে না। আলী আর পেলের পাশে নাম? সেটি বোধ হয় থাকবে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×