কেম্বাইয়ের জন্য মন খারাপ, কেম্বাই কে?

রিও ২০১৬ অলিম্পিকের দিন–রাত

উৎপল শুভ্র

২০ জুলাই ২০২১

কেম্বাইয়ের জন্য মন খারাপ, কেম্বাই কে?

স্টিপলচেজ খেলায় এমন বাধাই ডিঙাতে হয় অ্যাথলেটদের। ছবি: গেটি ইমেজেস

অ্যাথলেটিকস বলতে স্প্রিন্টই বোঝেন সবাই, সঙ্গে কিছুটা লং জাম্প-হাই জাম্পও। তবে স্টিপলচেজ বলে একটা খেলাও যে অ্যাথলেটিকসের ভেতরে পড়ে, তা কি জানেন? কেম্বাই সে খেলারই জীবন্ত কিংবদন্তি। ৩০০০ মিটার স্টিপলচেজে তাঁকে উসাইন বোল্ট বললেও ভুল হবে না।

প্রথম প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো

ব্রাজিলের ফুটবল ম্যাচ দেখতে যাব নাকি অ্যাথলেটিকস!

ফুটবল সেমিফাইনাল মারাকানায়। অ্যাথলেটিকস অলিম্পিক স্টেডিয়ামে। বাস বা ট্যাক্সিতে আধঘণ্টার মতো দূরত্ব। একটা দেখলে আরেকটা দেখা হবে না।

অ্যাথলেটিকস মানে উসাইন বোল্ট নয়। তাহলে তো সিদ্ধান্ত নেওয়াটা একদম সহজ ছিল। বোল্টের ২০০ মিটারের হিট রাতে। সেটি তো দেখবই। জেনে অবাক হবেন, পরশু দুপুরে আমার দ্বিধান্বিত মনে নেইমারের প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম এজেকিয়েল কেম্বাই!

অচেনা লাগছে নামটা? লাগতেই পারে। অথচ মজাটা কি জানেন, উসাইন বোল্টের মতো কেম্বাইও কিন্তু অ্যাথলেটিকসের কিংবদন্তি। সমস্যা একটাই, কেম্বাই যে খেলাটা খেলেন, সেটি ১০০ মিটার স্প্রিন্টের মতো ভুবনমোহিনী নয়। আমাদের দেশে তো এটির চলই নেই। স্টিপলচেজ!

৩০০০ মিটার স্টিপলচেজে সর্বকালের সেরা বলে এই কেনিয়ানকে মেনে নিয়েছেন মোটামুটি সবাই। ২০০৪ থেকে শুরু করে অলিম্পিক ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ মানেই যেন কেম্বাইয়ের গলায় সোনা। দুবার কীভাবে যেন তা রুপা হয়ে গিয়েছিল। ২০০৮ অলিম্পিকই শুধু ব্যতিক্রম।

তা কেম্বাই না হয় কিংবদন্তিই হলেন, স্টিপলচেজ দেখতেও মজাই লাগে। এই ইভেন্টের সময় খটখটে ট্র্যাকে হঠাৎ কীভাবে ছোট ছোট ‘পুকুর’ তৈরি হয়ে যায়, এটা আমার কাছে এখনো বিস্ময় হয়েই আছে। তাই বলে স্টিপলচেজের কেম্বাইকে দেখব না মারাকানায় নেইমারদের সেমিফাইনাল, এ নিয়ে দ্বিধাটা একটু বাড়াবাড়ি মনে হওয়াই স্বাভাবিক। আসলে যত না কেম্বাইয়ের দৌড়, তার চেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল তাঁর সংবাদ সম্মেলন নিয়ে। রিওতে আমার চতুর্থ অলিম্পিক। কত খেলার কত অ্যাথলেটের সংবাদ সম্মেলনেই না ছিলাম! কিন্তু লন্ডন অলিম্পিকে এজেকিয়েল কেম্বাইয়ের সংবাদ সম্মেলনের মতো বিনোদন আর কিছুতে পাইনি। রীতিমতো কমেডি শো!

সোনা জেতার পর মাঠে অদ্ভুতভাবে নেচে নেচে তা উদ্যাপন করেছিলেন। বোল্টের উদ্যাপন দেখে প্রভাবিত কি না প্রশ্ন করায় বলেছিলেন, বোল্ট অমন দর্শক মাতানোর পরই তিনি নতুন কিছু করবেন বলে ভেবেছেন সত্যি, তবে বোল্টের চেয়ে তিনিই এগিয়ে। বোল্ট তো আর নাচেন না।

ন্যাড়া মাথার মাঝখানে বৃত্তাকার কিছু চুল। যেটি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘সাইজটা দেখেছেন—গোল! ঠিক পদকের মতো। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ বা অলিম্পিকে আমি চুলটা এমন করে সোনার পদক জেতার ঘোষণা দিয়ে দিই। আমি চুল কাটানো মানেই প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি ঘোষণা—সাবধান, আমি আসছি।’

ক্যারিয়ার নিয়ে কী একটা প্রশ্নের জবাবে ২০০৩ সাল থেকে কোথায় কী জিতেছেন, নির্বিকার মুখে তা মুখস্থ বলে গিয়েছিলেন, ২০০৩ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ—নাম্বার টু, ২০০৪ অলিম্পিক—নাম্বার ওয়ান, ২০০৯ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ—নাম্বার ওয়ান...।

আরও কী কী বলেছিলেন সব মনে নেই। তবে এটা মনে আছে, কেম্বাই ফিচকে হাসি দিয়ে একেকটা উত্তর দিচ্ছিলেন আর সংবাদ সম্মেলনে বয়ে যাচ্ছিল হাসির ফোয়ারা। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা মনে পড়েছে। লন্ডনেই বয়স ৩০, কেম্বাই ঘোষণা দিয়েছিলেন আরও ১০ বছর দৌড়াবেন। উদ্দেশ্য একটাই, নিজেকে অতিপ্রাকৃত প্রমাণ করা।

প্রথমে বিজয়োৎসব করলেও কেম্বাইয়ের পদকটা আর থাকেনি পরে। ছবি: গেটি ইমেজেস

মারাকানায় ফুটবল দেখতে দেখতেই জানলাম, সেই মিশন থেকে সরে এসেছেন কেম্বাই। ব্রোঞ্জ জেতার পর ঘোষণা দিয়েছেন, চারটা অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন, অনেক হয়েছে। এবার বিদায়। ব্রোঞ্জ জিতে অলিম্পিক ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ মিলিয়ে এক ইভেন্টে ১০টি পদক জয়ের কীর্তি গড়েছেন। ২০০ মিটারে মারলিন ওটি ছাড়া আর কেউ যা করতে পারেননি। 

রাতে জানলাম, রেকর্ডটি শুধু ওটিরই থাকছে। দৌড়ানোর সময় কেম্বাই ট্র্যাকের একটু বাইরে চলে গিয়েছিলেন দাবি করে প্রতিবাদ করেছিল ফ্রান্স। ভিডিও দেখে সেটির সত্যতা মেলায় কেম্বাইয়ের ব্রোঞ্জ কেড়ে নিয়ে তা দিয়ে দেওয়া হয়েছে ফ্রান্সের প্রতিযোগীকে। জেনে একটু খারাপই লাগল। কেম্বাইয়ের এমন বিদায় প্রাপ্য ছিল না।

কেম্বাই না পারলেও সোনা জিতেছেন যথারীতি কেনিয়ারই একজন। বাধা আর জল পেরিয়ে দৌড়ের এই ইভেন্টটি আসলে কেনিয়ারই সম্পত্তি। এই নিয়ে টানা নয়বার তা জিতলেন কোনো কেনিয়ান। লন্ডনেও প্রসঙ্গটা উঠেছিল। পুরো সংবাদ সম্মেলনে এই একটা প্রশ্নেরই বোধ হয় সিরিয়াস উত্তর দিয়েছিলেন কেম্বাই, ‘এটা আমাদের ইভেন্ট। অনেক দেশে নির্দিষ্ট কোনো খেলা খুব জনপ্রিয়। শ্রীলঙ্কায় যেমন ক্রিকেট, অনেক দেশে ফুটবল, কেনিয়ায় তেমনি স্টিপলচেজ। এটি কেনিয়ানদের ইভেন্ট, কেনিয়ানদেরই থাকবে।’ 

অলিম্পিকে নির্দিষ্ট কোনো ইভেন্টে কোনো দেশের এমন রাজত্ব করার ঘটনা খুব বেশি নেই। রেকর্ড ঘেঁটে দুটি পেলাম। পুরুষদের পোল ভল্টে টানা ১৩ বার সোনা জিতেছে যুক্তরাষ্ট্র, ৩ মিটার স্প্রিং বোর্ড ডাইভিংয়ে টানা ১১ বার।

কেম্বাই পেশায় পুলিশ অফিসার। কেনিয়ার প্রেসিডেন্টের বিশেষ নিরাপত্তা দলেও আছেন বলে শুনেছি। এখন কি তাহলে সেটি নিয়েই থাকবেন! নাকি স্টিপলচেজ ছাড়ার পর ম্যারাথনে দৌড়ানোর যে পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন, সেটি এখনো তাঁর মাথায় আছে। সংবাদ সম্মেলনে থাকতে না পারায় নিশ্চিত হওয়া গেল না। তবে একটা ব্যাপারে তো নিশ্চিতই। আমুদে এই কেনিয়ান কোনো দিনই জানবেন না, শেষ অলিম্পিক থেকে তাঁর শূন্য হাতে ফিরে যাওয়ায় বাংলাদেশের এক সাংবাদিকের কেমন মন খারাপ হয়েছে!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×