কোপাকাবানায় চে-মেসিকে পেলাম, কিন্তু ম্যারাডোনা?

উৎপল শুভ্র

১৬ জুলাই ২০২১

কোপাকাবানায় চে-মেসিকে পেলাম, কিন্তু ম্যারাডোনা?

কোপাকাবানা সৈকতে সেই ব্যানার। ছবি: উৎপল শুভ্র

আর্জেন্টিনিয়ানরা খুব ব্যানারপ্রিয় জাতি। আর্জেন্টিনার খেলায় দেখবেন, গ্যালারি ব্যানারে সয়লাব। বিশ্বকাপে যে শহরে আর্জেন্টিনার খেলা থাকে, সেই শহরও তা-ই। রিওতে ২০১৪ বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচের আগে যেমন ব্যানারে ব্যানারে কোপাকোবানা সৈকতের দখলই নিয়ে নিয়েছিল আর্জেন্টিনিয়ানরা। সেখানেই এক ব্যানারে ওটা কী লেখা?

ব্যানারের দুই পাশের দুজনকে তো স্কেচ দেখেই চিনে ফেলেছি। এটা অবশ্য ঘটা করে বলার কিছু নয়। লিওনেল মেসি আর চে গুয়েভারাকে কে না চেনে! স্প্যানিশ জানি না, তবে আর্জেন্টিনিয়ানদের ব্যানার বলে ব্যানারের লেখাটা যে স্প্যানিশ, তাও বুঝতে পারছি। আমি অবাক হলাম অন্য একটা কারণে। মেসি আর গুয়েভারা ছবিতে থাকলেন, ম্যারাডোনা নেই কেন? যেখানে বড় বড় অক্ষরে তাঁর নামটা লেখা আছে।

পর দিন রিও ডি জেনিরোর মারাকানায় বসনিয়া-হার্জেগোভিনার সঙ্গে ২০১৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার প্রথম ম্যাচ। দুদিন আগে থেকেই কোপাকাবানা সৈকতের একরকম দখল নিয়ে নিয়েছে আর্জেন্টিনিয়ানরা। ম্যাচের আগের দিন সৈকতে ব্যানার পুঁতে সগৌরবে ঘোষণা করছে নিজেদের কোলাহলময় উপস্থিতি।

কোপাকাবানা বিচে প্রায় সারা দিনই ফুটবল-ভলিবল খেলা চলে। ফুটবলের গোলপোস্টেও আর্জেন্টিনিয়ান ব্যানার। ভলিবলের নেটের পাশেও। যা দেখে আমি একটুও অবাক হইনি। কারণ অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই জানি, আর্জেন্টিনিয়ানরা খুব ব্যানারপ্রিয় জাতি।

কোপাকাবানা সৈকতে...

আর্জেন্টিনার ম্যাচে দেখবেন, সমর্থকদের হাতে অসংখ্য ব্যানার । ২০০৬ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো মাঠে বসে আর্জেন্টিনার খেলা দেখতে গিয়ে তা এমনই চোখে পড়েছিল যে, ভাবলাম, এটা নিয়েই তো আলাদা একটা স্টোরি করা যায়। কিন্তু তা করতে হলে তো ওই ব্যানারগুলোতে কী লেখা, তা জানতে হবে। হামবুর্গের গ্যালারি আকাশী-সাদা ব্যানারে সয়লাব, কিন্তু সবই তো স্প্যানিশে লেখা।

খুঁজে খুঁজে আর্জেন্টিনিয়ান সাংবাদিক বের করছি আর একই উত্তর পাচ্ছি, 'নো ইংলিশো, স্প্যানিশো।'  শেষ পর্যন্ত একজনকে পাওয়া গেল যিনি ভাঙা ভাঙা 'ইংলিশো' বলতে পারেন। ব্যানারগুলোতে না জানি কী লেখা আছে ভেবে আমার উত্তেজনায় জল ঢেলে দিয়ে তিনি জানালেন, ব্যানারে লেখা ‘সান লরেঞ্জো', 'রাফায়েলা', 'কর্দোসা’, ‘লা মারতোনা'–এসব বুয়েনস এইরেসের বিভিন্ন শহরতলির নাম। আর্জেন্টাইন লিগের বেশির ভাগ ক্লাবই বুয়েনস এইরেসের বিভিন্ন শহরতলির। তারা বিশ্বকাপে এসেও নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে।

আরেকটা কৌতুহলের উত্তরও পাওয়ার ছিল। স্টেডিয়ামে ঢোকার আগেই দেখেছি, আর্জেন্টিনিয়ান ফ্যানদের গায়ে বিভিন্ন খেলোয়াড়ের জার্সি। এটা বলার মতো কিছু নয়। সবচেয়ে বেশি দেখলাম যে রিকুয়েলমের জার্সি, এটাও না। সেই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দলের প্রাণভোমরা ছিলেন এই শিল্পী ফুটবলারই। তাঁর জার্সি তো বেশি থাকবেই। মেসি সেবারই প্রথম বিশ্বকাপে, তাঁর জার্সিও দেখলাম অনেকের গায়ে। আয়ালা-ক্রেসপোও পাওয়া গেল কয়েকজন। এমনকি বাতিস্তুতাও। কিন্তু ম্যারাডোনা কই? কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ওই উত্তরটাই পেয়েছি, 'নো ইংলিশো, স্প্যানিশো।'

একটু 'ইংলিশো' জানা ওই সাংবাদিককে তাই জিজ্ঞেস করলাম,  কারও গায়ে ম্যারাডোনার জার্সি নেই কেন? প্রশ্নটা শুনেই গ্যালারির দিকে আঙুল দেখিয়ে তিনি বললেন, 'ম্যারাডোনা আছে তো! ওই তো ম্যারাডোনা।' ম্যারাডোনা মাঠে আসতে পারেন শুনেছি, কিন্তু তিনি কি আর সাধারণ গ্যালারিতে বসবেন? অবাক হয়ে এই প্রশ্ন করতে যাচ্ছি, প্লাসিদো নামের ওই আর্জেন্টাইন সাংবাদিক বললেন, 'ওই ব্যানারটা দেখো।'

প্লাসিদো যে ব্যানারটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন, তাতে লেখা, 'লা মানো দে দিওস।' ম্যারাডোনার আবার এই নাম হলো কবে! প্লাসিদো হেসে জানালেন, এ কথার ইংরেজি : ‘হ্যান্ড অব গড!' আমিও হাসিতে একমত হলাম। 'হ্যান্ড অব গড' মানেই তো ম্যারাডোনা! এই শব্দবন্ধকে ফুটবলের পরিভাষা বানিয়ে ফেলাও ম্যারাডোনার অনেক কীর্তির একটি।

২০১৪ সালের ১৫ জুন দুপুরে কোপাকাপানায় হাঁটতে হাঁটতে যে ব্যানারগুলো দেখছি, সে সবেরও প্রায় একই কাহিনি। বিভিন্ন শহরতলীর নাম লেখা। এর মধ্যে একটু দূরের এই ব্যানারটা একটু অন্যরকম দেখে হাঁটতে হাঁটতে কাছে গেলাম। বিশ্বকাপ দেখতে আসা দলটার সঙ্গে পরিচয় হলো। ছোট্ট মেয়েটার সঙ্গে একটু বন্ধুত্বও। 

বন্ধুত্বই হয়ে গিয়েছিল ছোট্ট মেয়েটার সঙ্গে

সবাইকে ব্যানারটার সামনে বসিয়ে ছবি তুললাম। ছোট্ট মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে আমারও একটা ছবি তুলে দিতে দিলাম। ফটো সেশন পর্ব শেষ হওয়ার পর ওই প্রশ্নটা করব বলে ব্যানারটার দিকে আবার তাকিয়ে একটু বোকাই বনে গেলাম। এখানে ম্যারাডোনা আমি কোথায় পেলাম? আর্জেন্টিনিয়ানদের ব্যানার, মেসি আর গুয়েভারার ছবি আর নিচের লেখার শেষে "DONA' দেখে দূর থেকে ওটা "ম্যারাডোনা' পড়ে নিয়েছি। কাছে আসার পর দু'একটা ইংরেজি শব্দ আর ইশারা-ইঙ্গিতে পরিচয়পর্বটায় এত মনোযোগ দিতে হয়েছে যে, ব্যানারটায় কী লেখা দ্বিতীয়বার আর দেখা হয়নি। এখন দেখি, ম্যারাডোনা নয়, লেখা আসলে '"অ্যাবানডোনা।"

ম্যারাডোনার ছবি নেই কেন---এই প্রশ্নটা বদলে তাই হয়ে গেল, এই LA QUE NUNCA ABANDONA কথাটার অর্থ কী? প্রশ্নটা বোঝাতেই পানিপথের যুদ্ধ করতে হলো, উত্তর বুঝতে তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ! শেষ পর্যন্ত ভালোমতো না বুঝেই 'বুঝেছি, বুঝেছি' বলে মাথা ঝুঁকিয়ে এই কষ্টকর পর্বের সমাপ্তি টানতে হলো। থাক বাবা, পরে বুঝে নিলেই হবে। গুগল বাবাজি আছে না! তিনি তো সব কিছু জানেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেই হবে।

পরের দিন প্রেসবক্সে গিয়ে অবশ্য এক আর্জেন্টিনিয়ান সাংবাদিকের কাছ থেকেই অর্থটা জেনেছিলাম। তাতে 'লা কে নুনকা অ্যাবানডোনা'র যে অর্থ দাঁড়িয়েছিল, তা হলো, 'যা কখনো ছেড়ে যায় না।' লিখতে গিয়ে অবশ্য সংশয় জাগছে, 'যা কখনো ছেড়ে যায় না' হবে, নাকি 'যে কখনো ছেড়ে যায় না'? স্প্যানিশ জানেন, এমন কেউ লেখাটা যদি পড়েন, প্লিজ আসল অর্থটা জানিয়ে দেবেন। 

ছেড়ে যাওয়ার বা পরিত্যাগ করা না-করার একটা ব্যাপার যে এখানে আছে, তা অবশ্য নিশ্চিত। এই ব্যানারে কে কাকে ছেড়ে যাবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, সেটাও কি পরিষ্কার? জীবিত মেসি আর মৃত চে-কে কখনো ছেড়ে না যাওয়ার ঘোষণাই হয়তো। প্রথম দুটি ছবি একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, বড় ব্যানারটার নিচে আরও দুটি ছোট ব্যানার আছে। যার একটিতে চে'র আরেকটি স্কেচ। পাশে কিছু একটা লেখা। যেটির মর্মার্থ কোপাকাবানাতেই উদ্ধার করতে পেরেছিলাম: চে, সবচেয়ে বড়। বাঁ দিকের ছোট ব্যানারটাতে লেখা হয়েছে বিশ্বকাপ দেখতে আসা দলটার সবার নাম, যাঁদের সবাই এই ছবিতে নেই।

ম্যারাডোনা কেন নেই, চে আর মেসি কেন আছেন? তাদেরকে কখনো পরিত্যাগ না করার ঘোষণাই বা কেন দেওয়া হচ্ছে? এই গল্পটা আমার ফেসবুক পেজে লেখার পর এক পাঠকের কাছ থেকে উত্তরটা পেয়েছিলাম। এই দলটা এসেছে চে আর মেসির হোমটাউন রোসারিও থেকে। ম্যারাডোনা তাদেরও হৃদয়ে আছেন, তবে ব্যানারে তাঁর জায়গা হয়নি। সেখানে শুধু দুই 'লোকাল বয়'!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×